মানববর্জ্য যাচ্ছে সৈকতে
দূষণে বিপর্যস্ত কক্সবাজার
এসটিপি ছাড়াই চলছে হোটেল মোটেল-কটেজ

জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার আজ ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ও অপরিকল্পিত স্থাপনার চাপে বিপর্যস্ত। পর্যটকদের আবাসনের জন্য গড়ে ওঠা পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল-কটেজের মধ্যে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) আছে হাতেগোনা কয়েকটি তারকা মানের হোটেলে। বাকি হোটেল-মোটেলগুলোতে এই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর অভাবে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষার জন্য ১৯৯৯ সালে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়। এই গেজেট অনুযায়ী, সৈকতের বেলাভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ। পরবর্তীতে, ২০১৭ সালে পরিবেশ আইনবিষয়ক সংস্থা ‘বেলা’ রিট দায়ের করলে আদালত ইসিএ এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেন। তবে বাস্তবতা হলো, প্রশাসনের নজরদারির অভাব এবং নিয়ম লঙ্ঘনের প্রবণতায় ইসিএ আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বরং কক্সবাজারের কলাতলী, লাবণী পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। এসব স্থাপনার বেশিরভাগই এসটিপি ছাড়াই চালু রয়েছে, যা ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে উঠেছে।
দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেই : পরিবেশবাদী সংগঠন ‘উই ক্যান কক্সবাজার’-এর প্রধান নির্বাহী ওমর ফারুক জয় বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যটকরা প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ উপভোগ করতে কক্সবাজারে আসেন। কিন্তু পরিবেশ দূষণ এবং অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে পর্যটন শহরের প্রকৃতি তার আকর্ষণ হারাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যে হোটেলগুলো দুই দশক আগে নির্মিত, সেগুলোতে এসটিপি নেই। কিন্তু নতুনভাবে গড়ে উঠা হোটেল-মোটেলেও এসটিপি স্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে, পুরো শহরই ধীরে ধীরে দূষণের কবলে পড়ছে। উই ক্যান কক্সবাজার-এর অভিযোগ, কলাতলী জোনে ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের পূর্বাংশ এবং মধ্য কলাতলীতে নির্মিত বেশ কয়েকটি নতুন স্থাপনায়ও পরিবেশবান্ধব কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব ভবন থেকে সৃষ্ট বর্জ্য সরাসরি নালা হয়ে বাঁকখালী নদীতে গিয়ে মিশছে। বাঁকখালী নদী দূষিত হয়ে বঙ্গোপসাগরেও দূষণ ছড়াচ্ছে।
অপরিকল্পিত নির্মাণে বিপন্ন পরিবেশ : কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ভরা মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে লাখো পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করেন। কিন্তু এসটিপি না থাকায় তাদের ব্যবহৃত বর্জ্য সাধারণ টয়লেট রিংয়ে জমা হয়। সেখান থেকে তা নালার মাধ্যমে সরাসরি নদীতে চলে যাচ্ছে। ফলে পরিবেশের পাশাপাশি সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের বর্জ্য নিঃসরণের ফলে বঙ্গোপসাগরের পানির গুণগত মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এতে কেবল সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যই নষ্ট হচ্ছে না, পর্যটকদের কাছে কক্সবাজারের জনপ্রিয়তাও কমে যাচ্ছে। কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের কর্মকর্তা দীপক শর্মা দিপু বলেন, ইসিএ এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে প্রশাসনিক নজরদারির অভাবে দখলদাররা ইচ্ছেমতো স্থাপনা গড়ে তুলছে। বেশিরভাগ ভবনে পরিবেশবান্ধব নকশা বা এসটিপি ব্যবস্থা নেই। ফলে পুরো শহরই বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলোতে পরিবেশবান্ধব সংস্কার ও এসটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা উচিত। এ ছাড়া, ভবিষ্যতে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ভবন নির্মাণে বাধা দিতে হবে।
প্রশাসনের উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা : পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার জানিয়েছেন, সাড়ে তিন শতাধিক আবাসিক হোটেল-মোটেলকে এসটিপি স্থাপনের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে জায়গার অভাবে অনেক হোটেলেই এটি স্থাপন করা সম্ভব নয়। এসটিপি স্থাপনের জায়গার সংকট মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার সমন্বয়ে সেন্ট্রাল এসটিপি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে পৌর পরিষদের বিলুপ্তির কারণে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় তারকা মানের হোটেলগুলোকে এসটিপি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পৌরসভার তত্ত্বাবধানে কলাতলী জোনে সেন্ট্রাল এসটিপি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ইসিএ এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ এবং উচ্ছেদের প্রক্রিয়া অনেকটা ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুনের মতো। প্রশাসন উচ্ছেদ করে, আবার অন্যরা নতুন করে স্থাপনা গড়ে তোলে। জমি দখল এবং পরিবেশ দূষণ রোধে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কক্সবাজারে পর্যটন প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
পর্যটন শহর রক্ষায় করণীয় : কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানিয়েছেন, পরিবেশ রক্ষায় ইসিএ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ভবিষ্যতে সব নির্মাণ কাজ হবে। দূষণমুক্ত পর্যটন নগরী গড়তে এসটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হবে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজারকে রক্ষায় অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। পরিবেশ দূষণ রোধে প্রশাসন, পরিবেশবিদ এবং নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে।