Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

রাত নামতেই তৎপর হয়ে উঠে অপরাধীরা

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় খুন ছিনতাই বাড়ছে

যানবাহন সংকটে টহল জোরদার করা যাচ্ছে না

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় খুন ছিনতাই বাড়ছে

দেশের থানাগুলো সচল হলেও কার্যত এখনো নিষ্ক্রিয় পুলিশ। কোথাও পুলিশের টহলও নেই। এ সুযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ পর্যন্ত শুধু রাজধানীতে অর্ধশতাধিক খুন, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০টি, যার অধিকাংশই ছিনতাইকারীদের হাতে। এসব ঘটনায় অপরাধী ধরা পড়ার নজিরও খুবই কম। পুলিশি টহল না থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে অনিরাপদ হয়ে পড়ছে নগরীর রাস্তাঘাট। তৎপর হয়ে উঠেছে পেশাদার অপরাধীরা। যানবাহন সংকটের কারণে টহল জোরদার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশকে মাঠে সক্রিয় করতে জনগণের সহযোগিতা চাইছেন তারা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হিসাবে শুধু রাজধানীতেই ৬ হাজারের বেশি অপরাধী আছে। যাদের ২ হাজারের বেশি ছিনতাই পেশায় জড়িত। বাকিরা ডাকাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রাণভয়ে পুলিশ পালিয়ে গেলে থানা লুট হয়। লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৩৩টি উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো অপরাধীদের হাতে রয়ে গেছে ১৮৮৫টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার নানামুখী চাপ তৈরি করে ১৫ আগস্ট থেকে পুলিশকে কাজে ফিরিয়ে থানাগুলো সচল করে। তবে পুলিশ আগের মতো সক্রিয় হতে পারেনি। এরই মধ্যে থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। নতুন যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বভার নিয়েছেন, তাদেরও অপরাধী এবং অপরাধপ্রবণ এলাকা চিনতে কিছুটা সময় লাগছে। এ সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধীরা।

৬ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি বাসা থেকে বোরহান উদ্দিন সাইমন নামে এক যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, তাকে খুন করা হয়েছে। একই দিন আদাবর থানার শনিরবিল এলাকায় রাতে তুহিন নামে এক বিকাশকর্মীকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। ৪ সেপ্টেম্বর সকালে মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় রইচ বেপারী নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন রাতে ওয়ারী এলাকা থেকে ২৫ বছর বয়সি এক তরুণের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৩ সেপ্টেম্বর রাত ৩টার দিকে কদমতলী মেরাজনগর কাঁচারাস্তার ওপর ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মো. হাশেম (৪৮) নামে এক কাঁচামাল ব্যবসায়ী খুন হন। ৩০ আগস্ট হাজারীবাগে খুন হন ইফতেখার হোসাইন ইমন (২৪) নামে এক তরুণ। একই দিন বনশ্রী এলাকায় নড়াই নদী থেকে মাহফুজুর রহমান বিপ্লব (৪৫) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর একদিন আগে তিনি নিখোঁজ হন। ৩১ আগস্ট ভোরে বাসাবো ফ্লাইওভারের ঢালে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন অটোরিকশাচালক মো. ইউসুফ। একই দিন কদমতলীর মিনারবাগ থেকে মাহবুব (২৫) নামে এক যুবককে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ২৭ আগস্ট ভোরে মিরপুরের দারুসসালাম সড়কে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন সফটওয়্যার প্রকৌশলী প্রীতম। একই দিন যাত্রাবাড়ীতে বাসায় ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে সীমা আক্তার (২২) নামে অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৪ আগস্ট রাজধানীর হাটখোলায় আলআমিন ও নুরুল আমিন নামে দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ১৩ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে এক আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার ও দুই তরুণসহ তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর রাতে আদাবর থানাধীন শ্যামলী এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে রেইড দিতে যান শিক্ষার্থীরা। এ সময় হোটেলের স্টাফদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মারামারির ঘটনা ঘটে। এ সময় লিওন, তন্ময় ও ইমরান নামে তিন ছাত্র আহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে আসে। তারা হোটেল ম্যানেজার নীরবকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরা থানা ঘেরাও করে। ৮ আগস্ট এই হোটেল থেকে লুট হয় ১১ লাখ টাকা।

আদাবর থানার ওসি মাহফুজ ইমতিয়াজ যুগান্তরকে বলেন, তাদের ধারণা ছিল পুলিশ মামলা নেবে না। এ কারণে তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথাবার্তা বলছিল। আমরা তাদের সামনেই এজাহার নিয়ে মামলা রেকর্ড করেছি। ওসি বলেন, মামলা নেওয়া এবং আসামি ধরতে গিয়ে প্রতিনিয়তই পুলিশকে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণ না ঘটলে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা খুবই কঠিন হবে। এছাড়া পরিবহণ সংকটের কারণে টহলও জোরদার করা যাচ্ছে না। রামপুরা থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, শুক্রবার বনশ্রী এলাকায় ওয়ারেন্টভুক্ত এক আসামি ধরতে যায় রামপুরা থানা পুলিশ। এ সময় ওই আসামির পরিবারের লোকজন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে পুলিশ সদস্যদের গালাগাল শুরু করেন। একপর্যায়ে ওই আসামির বোন ফোন করে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, এ সময় আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। পরে খুব কৌশলে আসামিকে থানায় নিয়ে আসা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, এখনো পোশাক পরে বাইরে যেতে ভয় লাগে। বাসা থেকে পোশাক ব্যাগে করে নিয়ে আসি। আবার ডিউটি শেষ হলে পোশাক বদলে ব্যাগে করে নিয়ে যাই। ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, পরিস্থিতি আসলে খুবই খারাপ। এখনো থানায় পুলিশের কাজ করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এখন যারা সরকারে আছেন, তারা পুলিশ সম্পর্কে কোনো বার্তা দিচ্ছেন না। তাদের কেউ কেউ পুলিশের নেগেটিভ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। যে কারণে এখনো পুলিশের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণা রয়েই গেছে। তিনি বলেন, তারা যদি জনগণকে অন্তত এ বার্তাটুকু দেন যে, আইন আইনের গতিতে চলবে। পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া যাবে না। জনগণকে আইন মেনে চলতে হবে। তাহলে হয়তো জনগণের মাঝে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আসবে। মানুষ পুলিশকে কাজ করার সুযোগ দেবে। পুলিশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে না। নানা অপবাদ দিয়ে ভয় দেখাবে না। এতে পুলিশও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, থানাগুলো সচল হলেও আগের মতো মামলা গ্রহণ এবং টহল জোরদার করতে পারছে না পুলিশ। এতে একদিকে বাড়ছে অপরাধ, অন্যদিকে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। হেনস্তার ভয়ে আইন প্রয়োগে সাহস পাচ্ছেন না পুলিশ সদস্যরা। অন্যদিকে কোনো কোনো পুলিশ সদস্য মামলার ভয়ে পলাতকও রয়েছেন। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. ইসরাইল হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, অপরাধ দমনে পুলিশকে সক্রিয় করতে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা আপনাদের মাধ্যমে সব নাগরিককে মেসেজ দিতে চাই, পুলিশের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার না করে সহযোগিতা করুন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে পুলিশের মনোবল আরও চাঙা করতে হবে। নির্ভয়ে পুলিশ যাতে মাঠে কাজ করতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, থানাগুলোর কার্যক্রমে দিনদিন গতি বাড়ছে। যানবাহন সংকটের কারণে টহল জোরদার করা যাচ্ছে না। আগে একেকটি থানায় ৮ থেকে ১০টি গাড়ি ছিল টহলের জন্য। এখন আছে ২ থেকে তিনটি। যানবাহন সংকট দূর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। তাছাড়া আন্দোলনের সময় যেসব পুলিশ সদস্য ঢাকায় ছিলেন, তারা বিশেষ পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। তারা রীতিমতো ট্রমার মধ্যে আছেন। আমরা চেষ্টা করছি, যারা এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি তাদের নিয়ে আসার।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম