অধ্যক্ষের পদটি যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’
শতকোটি টাকা বানিয়েছেন চরফ্যাশনের মাজেদ
মুহাম্মদ আবুল কাশেম
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এম এ মাজেদ। কলেজের অধ্যক্ষের পদটি যেন তার জন্য ‘আলাদিনের চেরাগ’। তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা, সরকারি টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব টাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়িসহ কিনেছেন অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদ। একজন অধ্যক্ষের বেতন-ভাতা কত? তিনি এত সম্পদ কিভাবে করেছেন তা নিয়ে এলাকায় চলছে কানাঘুষা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালে কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়। কিন্তু কলেজের প্রতিষ্ঠাকাল পাঁচ বছর আগে দেখিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় বেতন-বিল ভাউচার করে সরকারের ৪-৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। কলেজে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একই পদের জন্য একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কলেজের উন্নয়নমূলক কাজ, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি ফি, ফরম ফিলাপ, রেজিস্ট্রেশন ফি, উন্নয়ন তহবিল বাবদ অর্জিত তহবিলের বিপুল সরকারি অর্থ এখনো আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, কলেজের অধ্যক্ষ পদ পাওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জাল অভিজ্ঞতার সনদ ও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ পান তিনি। ছয়জন শিক্ষকের পদ বোর্ডের স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ভুয়া স্মারকে জাল কাগজপত্র তৈরি করে বিল উত্তোলন করে নেন। উক্ত বিল পাওয়ার জন্য তদবিরের কথা বলে প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে চার লাখ টাকা করে ২৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক জাকিরসহ কয়েকজনের কাছ থেকে চার লাখ টাকা করে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। তিনি ছয়জন শিক্ষককে অনেক আগে যোগদান দেখিয়ে ৯০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও আট লাখ টাকা করে ঘুস নিয়েছেন। বর্তমানে কলেজে ২৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। প্রত্যেকের নিয়োগের শুরুতে আট লাখ টাকা করে মোট দুই কোটি আট লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আটজনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা ঘুস নেন অধ্যক্ষ এম এ মাজেদ।
আবদুল্লাহ আল জ্যাকব ডিগ্রি কলেজ ছাড়াও অধ্যক্ষ এম এ মাজেদ আরও একাধিক কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি ওসমানগঞ্জ ইউনাইটেড কৃষি ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন। সেখানে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি আগে লালমোহন উপজেলার গজারিয়া বাজারে দুই হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। এখন দুর্নীতির মাধ্যমে শতকোটি টাকার মালিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এম এ মাজেদ ২০১৬ সালে ভোলার চরফ্যাশন বাজারের ভদ্রপাড়ায় ৯০ লাখ টাকায় ১২ শতক জমি কেনেন। পরে ওই জমিতে ১টি তিনতলা এবং অন্য অংশে চারতলা বিশিষ্ট দুটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এ ভবন এবং জায়গা প্রথমে নিজের নামে থাকলেও পরে দুদকের ভয়ে স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের নামে করে দেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরে রয়েছে ১টি ফ্ল্যাট। ঢাকার পোস্তগোলায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকায় কিনেছেন ৫ কাঠা জমি। বরিশালে কিনেছেন ৮০ লাখ টাকায় ২টি প্লট। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জে ৩ একর জমি রয়েছে। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। অধ্যক্ষ নিজকে ভূমিহীন দাবি করে চরফ্যাশন উপজেলার চরপাতিলা এবং চর কুকরিমুকরিসহ বিভিন্ন চরে প্রায় ৫০ একর জমি লিজ নেন। তিনি ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার জায়গা ক্রয় করেছেন। কলেজের জন্য আড়াই একর জমি ক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি দেখিয়ে কয়েক লাখ টাকা কলেজের তহবিল থেকে আত্মসাৎ করেছেন। সৌদি আরবেও অধ্যক্ষ এম এ মাজেদের ব্যবসা রয়েছে।
আব্বাস নামে স্থানীয় এক ভুক্তভোগী যুগান্তরকে বলেন, ২০০৪ সালে আমার স্ত্রী এ কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। পরে কলেজ এমপিওভুক্ত করার অজুহাতে আমার কাছ থেকে কয়েক দফায় পাঁচ লাখ টাকা আদায় করেন অধ্যক্ষ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে কলেজটির এমপিও আদেশ হয়। দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষ আমাকে জামায়াত-শিবিরের তকমা দেন এমপি জ্যাকবের কাছে। পরে অন্যজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে আমার স্ত্রীর নাম বাদ দিয়ে দেন। পরে আমার টাকা ফেরত চাইলে এমপির ক্ষমতা দেখিয়ে উলটো আমাকে মামলা-হামলার হুমকি দেন।
এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ এম এ মাজেদের সঙ্গে তার কলেজের অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেননি। পরে তার দুটি মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস দিলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।