যশোর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান
‘গাছখেকো’ সাইফুজ্জামানের পকেটে শতকোটি টাকা
যশোর ব্যুরো
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাইফুজ্জামান পিকুল। ছবি: সংগৃহীত
যশোর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুল চেয়ারম্যান পদে বসে সাত বছরে কামিয়েছেন শতাধিক কোটি টাকা। জেলা পরিষদের মালিকানাধীন সড়ক-মহাসড়কের গাছ বিক্রি করে পকেটে ভরেছেন কয়েক কোটি টাকা। বরাদ্দ প্রকল্পের টাকা লুটপাট, নিয়োগ বাণিজ্য, জমি ইজারা ও দোকান বরাদ্দের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। জেলা পরিষদে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই চালিয়েছেন দুর্নীতি-লুটপাট। জেলা পরিষদের মালিকানাধীন সড়কের গাছ পানির দরে দেদার বিক্রি করায় ‘গাছখেকো পিকুল’ নামে পরিচিতি পান তিনি। তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস ছিল না কারও। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান সাইফুজ্জামান পিকুল। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করায় তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সোমবার দুপুরে পিকুলের মোবাইল ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মারা যান যশোর জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ হাদিউজ্জামান। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুল। চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তিনি আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও সৎ নেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর বদলে যায় তার রূপ। শুরু করেন নিজের আখের গোছানোর মিশন। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর দ্বিতীয় মেয়াদে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন পিকুল। দুই দফায় প্রায় সাড়ে ৭ বছর তিনি চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
‘গাছখেকো পিকুল’ : জেলা পরিষদের মালিকানাধীন বিভিন্ন সড়কের গাছ পরিবেশবাদী ও সচেতন যশোরবাসীর আপত্তি উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থে পানির দরে বিক্রি করেছেন। যশোর-খুলনা মহাসড়ক, যশোর-ঝিনাইদহ ও যশোর-নড়াইল মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কের হাজার হাজার গাছ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে পিকুল সিন্ডেকেট। জেলা পরিষদের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে তাদের মালিকানাধীন চারটি সড়ক-মহাসড়কের চার হাজার ২১০টি গাছ কাটা হয়েছে। যার দাম প্রায় ১৪ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর যশোর-খুলনা মহাসড়কের শেষ সীমানা পর্যন্ত চার গ্রুপ ও যশোর ঝিনাইদহ সড়কের হৈবতপুর ব্রিজ পর্যন্ত এক গ্রুপ মোট পাঁচ গ্রুপে এক হাজার ৯৬২টি শতবর্ষী মেহগনি ও রেইন্ট্রি গাছ বিক্রির টেন্ডার নামে-বেনামে বাগিয়ে নেন চেয়ারম্যান পিকুল ও তার ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিব নওশাদ পল্লব। প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের গাছ বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে মাত্র সাড়ে ৫ কোটি টাকায় কিনে নেন। একইভাবে যশোর-নড়াইল ও যশোর-চুকনগর সড়কের গাছের টেন্ডারও নিজেদের নামে বেনামে ক্রয় করেন বাবা-ছেলে। নিজ ক্ষমতাবলে সরকারি টেন্ডারের টাকা জেলা পরিষদের হিসাবে জমা না দিয়েই বের করে নেন কার্যাদেশ। এর পর ওই কার্যাদেশ ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন মেসার্স বাবলু এন্টারপ্রাইজসহ একাধিক ঠিকাদারের কাছে।
পাঁচ বছরে সম্পদ বৃদ্ধি চার গুণ : ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদ নির্বাচনের হলফনামার সম্পদের বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫ বছরে সাইফুজ্জামান পিকুলের সম্পদ বেড়েছে চার গুণ। নিজ নামের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানরাও বিপুল সম্পদের মালিক। ২০২২ সালে পিকুলের বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে ছিল চার লাখ টাকা। ২০২২ সালে অস্থাবর সম্পদ ছিল নগদ ৬৬ লাখ ৮১ হাজার ৭৭ টাকা, বন্ড-ঋণপত্র ইত্যাদি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সোনা ১০ তোলা যা ২০১৭ সালের হলফনামার তুলনায় দ্বিগুণ। স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে এক হাজার ৮০৭ শতক জলকর জমি ও অকৃষি জমি দশমিক শূন্য ৮ শতক। স্থাবর সম্পদ ২০১৭ সালের হলফনামায় না থাকলেও ২০২২ সালে পিকুলের স্ত্রীর ৩ একর জলকর (জমি), অকৃষি জমি ১০ দশমিক ৭৫ শতক ও তিনতলা বাড়ি দেখানো হয়েছে। আর নির্ভরশীলদের নামে চার দশমিক শূন্য ৮ একর কৃষিজমি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনি যে পরিমাণ টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন বৈধ সম্পদ বিবরণীতে তার কিছুই আসেনি।
কমিশন, ঘুস ও নিয়োগ বাণিজ্য : একাধিক সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য জানান, জেলা পরিষদের প্রকল্প বরাদ্দে পিকুলকে দিতে হতো ২৫ শতাংশ কমিশন। তিনি ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল নির্মাণ প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ থাকলেও তিনি জেলা পরিষদ থেকে একাধিকবার বরাদ্দ দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতি বছর শীতবস্ত্র বিতরণ, দরিদ্রদের ঈদসামগ্রী বিতরণ ও দরিদ্রদের আর্থিক সহায়তার বরাদ্দের বেশির ভাগ আত্মসাৎ করেছেন। জেলা পরিষদের মালিকানাধীন যশোর শহরের খাজুরা বাসস্ট্যান্ড ও যশোর টাউন মাঠসংলগ্ন মার্কেটের দোকান বরাদ্দের নামে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ঘুস নিয়েছেন। গাছ বিক্রি, দোকান বরাদ্দ, ভুয়া প্রকল্প, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন।