আ.লীগ নেতা বাবুল হত্যা
বাঘায় মূর্তিমান আতঙ্ক মেয়র আক্কাছ
আক্কাছের নামে ২২ মামলা, ১৭ জিডি * রয়েছে সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাছ আলী
রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাছ আলী এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। আধিপত্য বিস্তারে আক্কাছের রয়েছে সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী। পদ্মার বালু লুট থেকে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সীমান্তপথে মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরক চোরাচালান ছাড়াও বহু অপকর্মের মূলহোতাই এই আক্কাছ আলী। আক্কাছ বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
এলাকাবাসী ও দলীয় সূত্র জানায়, সন্ত্রাস ও সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগে একাধিকবার দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন আক্কাছ। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন। পুলিশের প্রতিবেদন বলছে আক্কাছ আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে বাঘা থানা ও আদালতে ২২টি মামলা ও ১৭টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে। এসব মামলার অনেকগুলো এখনো আদালতে চলমান রয়েছে। বাঘা মেয়রের দুর্নীতিবিরোধী মানববন্ধন কর্মসূচিতে ২২ জুন দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম বাবুলের ওপর আক্কাছের সন্ত্রাসী বাহিনী হামলা চালায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুন বাবুল মারা যান। আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল হত্যা মামলার প্রধান আসামি আক্কাছ আলী। এ মামলার ৪৬ আসামির মধ্যে ১০ জন ইতোমধ্যে গ্রেফতার হলেও আক্কাছ আলী এখনো অধরা। পুলিশের দাবি, তারা আক্কাছকে গ্রেফতারে সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদন বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কালো পতাকা প্রদর্শন, মাতাল অবস্থায় নারীকে বিবস্ত্র করা, পৌর কার্যালয়ে বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান, আদালতের কর্মচারী ও পুলিশের ওপর হামলা, চোরাচালানের মালামাল ছিনিয়ে নেওয়া, ধর্ষণ, সহিংসতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি ছাড়াও একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা আক্কাছের বিরুদ্ধে। আক্কাছ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী বলেও পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর মদ্যপ অবস্থায় স্থানীয় সংসদ-সদস্য শাহরিয়ার আলমকে হত্যার হুমকি দিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
পুলিশের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আক্কাছ আলী প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কাজে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় সবশেষ ২২ জুন সশস্ত্র ক্যাডার দিয়ে বাবুলকে হত্যা করেন।
এলাকাবাসী জানায়, আক্কাছের বাড়ি বাঘা পৌরসভার কলিগ্রামে। কলিগ্রাম মহল্লাটি সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত এবং মাদক চোরাচালানের অন্যতম ঘাঁটি। আক্কাছ সীমান্ত চোরাচালানেরও গডফাদার। কোথাও চোরাচালানিরা পুলিশ বা বিজিবির হাতে ধরা পড়লে আক্কাছ দলবল নিয়ে হাজির হয়ে হামলা চালিয়ে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে হন পাকুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। আক্কাছ ২০০৬ সালের ২৯ মার্চ বাঘা পৌরসভার চেয়ারম্যান হন। ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর আবার মেয়র নির্বাচিত হন।
এলাকাবাসী জানান, আক্কাছ একটানা ১২ বছর মেয়র থাকাকালে পৌরসভার বিভিন্ন বরাদ্দ লোপাট করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঢাকায় রয়েছে দুই কোটি টাকার দুটি অ্যাপার্টমেন্ট। কলিগ্রামে পৈতৃক বাড়িটি করেছেন দুই তলা। নিজ এলাকা ও নিজের শ্বশুরবাড়ি এলাকায় কিনেছেন জমি ও সম্পত্তি। বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুর রাজ্জাক আক্কাছ আলীর দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করে দাবি করেছিলেন আক্কাছ আলী বাঘা পৌরসভার বরাদ্দ থেকে ১০ কোটি টাকা লোপাট করেছেন।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা দলীয় এমপি প্রার্থীর পক্ষে বাঘায় নির্বাচনি প্রচারে এলে আক্কাছ কালো পতাকা প্রদর্শন করে আলোচনায় আসেন। ১৯৯৮ সালের ২০ জুলাই বাঘায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে শ্লীলতাহানি করেন।
দীর্ঘদিন কারাবাসের পর মুক্তি পেয়ে আক্কাছ আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হন বাঘায়। ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল বাঘা থানা পুলিশের তৎকালীন এসআই সোহেলকে গালাগাল ও মারধর করায় আক্কাছের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা জজ আদালতের নাজিরসহ ৬ কর্মচারীকে আক্কাছ দলবল নিয়ে হামলা চালান। এ ঘটনায় মামলা হলে আক্কাছ কয়েক মাস কারাগারে থাকেন। মেয়র হিসাবে বাঘা হাইস্কুল মাঠে বিজয় দিবসের কর্মসূচিতে মাতাল অবস্থায় মঞ্চে ফুল দিতে আসা এক ছাত্রীকে জাপটে ধরেন তিনি। বাঘা পৌর কার্যালয়ে প্রকাশ্যে মদ্যপান করে নারী কাউন্সিলরদেরকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন। আক্কাছ বাঘা পৌর এলাকার নারায়ণপুরে গৃহবধূর ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করেন। ২০২২ সালের ২১ মার্চ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন চলাকালে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে আক্কাছ তার দলবল নিয়ে মঞ্চে হামলা চালান।
বাঘা উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক শাহিনুর রহমান পিন্টু বলেন, আক্কাছ আলী একজন সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসের গডফাদার। এরপরও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন।
আক্কাছকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে রাজশাহীর পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান বলেন, আক্কাছের অপরাধের খতিয়ান দীর্ঘ। আমরা তাকে গ্রেফতারে সব চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।