Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

সাপ ধরা, নিধন দণ্ডনীয় অপরাধ

কৃষকের বন্ধু রাসেলস ভাইপার এখন শত্রু

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কৃষকের বন্ধু রাসেলস ভাইপার এখন শত্রু

সাপ ধরায় বেশ দক্ষ সাভারের কিরণ। একসময় ঘুরে বেড়াতেন সারা দেশে। সাপ ধরে ছেড়ে দিতেন জঙ্গলে। প্রথম সাপ ধরেছিলেন নিজ বাড়ির গোয়ালঘর থেকে। সেটি ছিল চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার। সাপটি দেখেই স্থানীয়রা পিটিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিরণ সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে সাপটি ধরে জঙ্গলে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন। আলোচিত এই রাসেলস ভাইপারের প্রধান খাবার ফসলের শত্রু ইঁদুর।

কৃষকের বন্ধু, এই সাপ এখন শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিরণ এখন বেদে দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। সামুদ্রিক মাছের কাঁটা বিক্রিই এখন তার পেশা। সোমবার রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় কিরণের।

কিরণ বলেন, ‘এখন সাপ নেই বললেই চলে। এক সময় বহু সাপ দেখা যেত। ধরা হতো, মারা হতো না। পুষে খেলা দেখানো হতো, হত্যা করা হতো না। সাপ মানুষখেকো নয়, মানুষকে কখনই কামড়াতে আসে না-যদি না মানুষ তাকে তাড়া না করে। মানুষ তাড়া করলে প্রায় শতভাগ সাপ পালিয়ে যায়। দু-একটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে নিজেকে বাঁচাতে ছোবল বসায়। এখন শুনছি ওই সাপ নাকি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ দেশে এখন সাপের আকাল সবচেয়ে বেশি। সাপ তো চোখেই পড়ে না। মানুষ আসলে সাপ ধরে ধরে মেরে ফেলার মহোৎসবে মেতে উঠবে।

কিরণের সুরেই কথা বললেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুসতাক হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘বাঘ মানুষকে হত্যা করে, এজন্য কি সব বাঘ মেরে ফেলতে হবে। পৃথিবীতে অনেক বিষধর প্রাণী রয়েছে, সব মারতে হবে-নিশ্চয়ই না। সাপসহ প্রাণীদের বাসস্থান দিন দিন দখল হচ্ছে। এদের প্রতি দয়াবান না হলে বরং মানুষই সাপসহ প্রাণীদের প্রতি হিংস্র হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে প্রচার চালাতে হবে-একে অপরের (সাপ-মানুষ) দুশমন হবে না। নিশ্চয়ই সাপ মানুষকে খুঁজছে না, মানুষই সাপকে খুঁজছে।’

বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘এ সাপ ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে-এমন তথ্য যথাযথ নয়। রাসেলস ভাইপারসহ সাপ ধরা-নিধন সম্পূর্ণ নিষেধ, দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে এই সাপের কামড়ে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। এজন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, সাপ নিধনে সাধারণ মানুষ উঠেপড়ে নেমেছে। এ সুযোগটি ব্যবহার করে অপরাধীরা সাপসহ বিভিন্ন প্রাণী ধরে পাচারে নেমে পড়বে। সাপ পরিবেশ এবং ফসলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। সাপকে বাঁচিয়েই মানুষ এবং পরিবেশকে বাঁচাতে হবে।’

কয়েকদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে ‘রাসেলস ভাইপার’। ইতোমধ্যে ৩০ থেকে ৩২টি জেলায় এ সাপ ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ এ সাপটি সংরক্ষিত, নিধন নিষেধ। আইনগত অপরাধ। অপরদিকে এ সাপের ছোবলে প্রাণও যাচ্ছে মানুষের। গত কয়েক মাস ধরে এ সাপটি আলোচনার তুঙ্গে। ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জেলায় এক সময় বিলুপ্ত ঘোষণা করা জাতটি। আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অপরদিকে এ সাপ দেখামাত্রই পিটিয়ে মেরে ফেলছে। এ সাপের প্রদান খাবার ইঁদুর, যেটি আবার ফসলের প্রধান শত্রু। যে সাপ কৃষকের বন্ধু, সেই সাপ এখন শত্রুতে পরিণত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে কৃষকরা গামবুট ও লম্বা গ্লাভস পরে কাজ করতে পারেন। সাপ দেখলে না মেরে তাড়িয়ে দিতে প্রচার-প্রচারণাও চালাতে হবে। সাপটি শব্দ করে চলে-সেই ক্ষেত্রে মানুষকে সতর্ক হতে হবে। জানা যায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ বছর ১৭ জন রাসেলস ভাইপারের কামড় নিয়ে ভর্তি হন, যাদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সূত্র বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ৪ বছরে ২০ জন মারা গিয়েছিলেন। তাছাড়া এ সাপগুলো ডিম দেয় না, বাচ্চা দেয়। যার কারণে বাচ্চাদের সারভাইভাল রেটও বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বললেন, এ সাপের জন্য বিশেষ অ্যান্টিভেনম মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে রয়েছে। বাংলাদেশে নেই। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ও সাপ গবেষক ইব্রাহিম আল হায়দারের নেতৃত্বে ২০২৩ সাল থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরির একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। তারা রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টা করছেন।

এখন পর্যন্ত ৩২টি জেলায় এই সাপ দেখা গেছে। জেলাগুলো হচ্ছে-নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. সালাহউদ্দিন শাহ যুগান্তরকে জানান, সাপকে মারলে উত্ত্যক্ত করলে সাপ বেশি ভয়ংকর হয়। ওই অবস্থায় সাপের বিষ মারাত্মক হয়। মনে রাখতে হবে, সাপ কামড় দিলে সিনেমার ন্যায় মুখ দিয়ে বিষ বের করা মানেই যিনি ওই কাজটা করছেন তিনিও বিষে নীল হবেন। সাপ কামড় দিলে অনেকেই কামড় স্থানের ওপরে রশি দিয়ে মারাত্মক ভাবে বেঁধে দেন। ওই কাজ যথাযথ নয়। তাতে বাঁধার নিচের অংশের মাংসে মারাত্মক ক্ষতি হয়। পচন ধরে, কখনও নিচের অংশ কেটে পর্যন্ত ফেলতে হয়। কামড়ালে সবার আগে চিকিৎসকের কাছে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম