Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

খামারিদের কাঁদাচ্ছে অবিক্রীত বড় গরু

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খামারিদের কাঁদাচ্ছে অবিক্রীত বড় গরু

ফাইল ছবি

বিশাল আকারের দৃষ্টিনন্দন কুরবানির গরু শুধু আলোড়িতই করে না, অনেক সময় চরম বিপাকেও ফেলে। বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে থাকা অবিক্রীত এমন বড় গরু এখন খামারি বা কৃষকদের দুর্ভাবনার কারণ হয়েছে দাঁড়িয়েছে, তাদের কাঁদাচ্ছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও বড় গরু ঝামেলায় ফেলেছে ক্রেতার সঙ্গে-বিক্রেতাদেরও। সম্প্রতি ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে হাটে তোলা পশুর মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ অবিক্রীত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার বড় গরু ঈদের হাটে বিক্রিই হয়নি। তবে সরকারের দাবি, দেশে প্রতিবছরই পশুর সংখ্যা বাড়ছে। উৎপাদিত পশু দিয়ে এবারও কুরবানির চাহিদা মিটেছে।

তবে সরকারের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন মাংস ব্যবসায়ী, খামারি ও ডেইরি অ্যাসোসিয়েশন নেতারা। তারা অভিযোগ করছেন, সীমান্তপথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে পশু আসা এবং মিডিয়া ও সামাজিত মাধ্যমে পশুর অতিরঞ্জিত মূল্য প্রকাশের কারণে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া ‘ছাগলকাণ্ডে’ বেশি দামে পশু কেনার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ‘দুর্নীতিবাজদের’ সংবাদ প্রকাশের আশঙ্কায় আগামী দিনে বড় গরু বিক্রি আরও কমে আসবে। অন্যদিকে দেশে বড় গরু পালন ও উৎপাদনে খামারিরা বেশ এগিয়ে গেছেন। এ পরিস্থিতিতে বড় গরু পালন এবং উৎপাদন নিয়ে তারাও শঙ্কায় থাকবেন।

তথ্য বলছে, এ বছর সারা দেশে ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি গবাদি পশু কুরবানি হয়েছে। এজন্য প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি পশু। গত বছর সারা দেশে কুরবানি করা গবাদি পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার সাড়ে ৩ লাখ বেশি পশু কুরবানি করা হয়েছে। এ বছরও কুরবানির সংখ্যার দিক থেকে ঢাকা বিভাগ এগিয়ে ছিল, পিছিয়ে ছিল ময়মনসিংহ বিভাগ। এবারের কুরবানি হাটে পশু বিক্রিতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।

অবিক্রীত বড় গরু নিয়ে বিপাকে কৃষক : নারায়ণগঞ্জের কৃষক জয়নাল আবেদিন ৩টি বড় গরু রাজধানীর কমলাপুর হাটে এনেছিলেন। তিন গরুর গড় ওজন ছিল ৭০০ থেকে ১০০০ কেজি। তিনি বলেন, হাটে দুটি গরু বিক্রি হয়েছে। একটি গরু কমমূল্যে বাধ্য হয়েই বিক্রি করতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় গরুটি বিক্রি হয়নি। ৬ দাঁতের ওই গরু নিয়ে এখন চরম চিন্তায় আছি। বিশাল আকৃতির গরুটির এখন বাঁচা-মরার মধ্যে সময় যাচ্ছে।

আগামী কয়েক মাস গরু জবাইও তেমন একটা হবে না। আর বড় গরু এমনিতেই জবাইয়ের জন্য বিক্রি হয় না। কুরবানির জন্যই এসব বড় গরু লালনপালন করা হয়। অবিক্রীত এ বড় গরু নিয়ে এখন কী করব, বুঝতে পারছি না। শুধু জয়নাল আবেদিনই নন, এমন বহু কৃষক ও খামারির কুরবানির জন্য পালিত পশু অবিক্রীত রয়ে গেছে। এর সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এ পশুগুলোকে কৃষক ও খামারিদের আবারও লালনপালন করতে হচ্ছে। বিক্রমপুরের খামারি আশিকুর রমজান জানালেন, অবিক্রীত বড় গরুগুলো আরও এক বছর পালন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। নির্ধারিত বছরের হাটে বিক্রির জন্যই এসব বড় পশু পালন করা হয়। বর্তমানে অবিক্রীত বড় গরু নিয়ে প্রতিদিনই শঙ্কা বাড়ছে। শঙ্কা কমাতে কেজি ধরে বা কসাইয়ের কাছে বিক্রিও করা যাচ্ছে না।

মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যম : রাজধানীর গাবতলী কুরবানির হাটে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ‘জায়েদ খান’সহ বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার নামে গবাদি পশু আনা হয়েছিল। ব্যবসায়ী সোলেন মিয়া জানান, তিনি ২টি বড় গরু গাবতলীর হাটে তুলেছিলেন। একটি বিক্রি হলেও অন্যটি এখন তার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিক্রীত গরুটির দাম চাওয়া হয়েছিল ৯ লাখ টাকা। কিন্তু মিডিয়া তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর দাম প্রচার হয় ১৫ লাখ টাকা। এছাড়া ঈদের আগের দিন মিরপুরের এক ধার্মিক পরিবার গরুটি কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতি এবং ভিডিও ধারণের ভয়ে শেষ পর্যন্ত তারা গরুটি কেনেননি। তিনি ক্রেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের নজর ছিল গরুটি কে বা কারা কিনছেন। রাজধানীর রামপুরা বাজারের এক ইজারাদার জানান, বাজারে সামাজিক মাধ্যমের কারণে ক্রেতা-বিক্রেতারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। বহু বিক্রেতা তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন, ফেসবুক, ইউটিউবারদের তৎপরতায় তারা পশু বিক্রি করতে পারছেন না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে, অভিযোগের পর কিছুই করার ছিল না। তিনি আরও বলেন, আগামী দিনে বড় গরু বিক্রি আরও কমে যাবে। কারণ, যিনি বা যারা কিনবেন, তাদের টাকার উৎস জানতে লেগে পড়বে সংশ্লিষ্টরা। বড় গরু কিনলেই ক্রেতা ভাইরাল হয়ে যাচ্ছেন। বহু ক্রেতা রয়েছেন, যারা বছরের পর বছর বড় গরু কুরবানি দিয়ে আসছিলেন। তাদের বড় একটি অংশ প্রচার চান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর বিশিষ্ট এক ব্যবসায়ী জানালেন, তার মতো ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরা বড় গরু কুরবানি দিলে অর্থের উৎস খোঁজা হয় না। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীদের বেলায় বড় পশু কুরবানি দেওয়া মানেই বিপদ ডেকে আনা। ছাগলকাণ্ডের কারণে আগামী দিনে বড় গরুর বিক্রি আরও কমে যাবে।

অবিক্রীত পশুর সংখ্যা : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, মাঠ পর্যায় থেকে উঠে আসা পশুর সংখ্যা যথাযথ নাও হতে পারে। ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ ছিল ভারত-মিয়ানমার থেকে গরু আসছে। এমন অভিযোগ যে সত্য, এর প্রমাণ বিভিন্ন সীমান্তে পাচার হয়ে আসা বহু গবাদি পশু আটকও হয়েছে। একাধিক খামার মালিক জানান, ২৬ থেকে ২৭ লাখ গরু অবিক্রীত থাকার কথা বলা হলেও ঈদের পর দেখা যাচ্ছে অবিক্রীত পশুর সংখ্যা আরও কয়েক লাখ বেশি। অবিক্রীত গরুর মধ্যে প্রায় ২ শতাংশ বড় গরু-মহিষ রয়েছে। অন্যদিকে অনেকে আছেন নিজেরা পশু লালনপালন করেন, নিজেরাই কুরবানি দিয়ে থাকেন, যা গণনায় উঠে আসে না।

কসাইরা বড় গরু কিনতে আগ্রহী নন : রাজধানীর মতিঝিলে মাংস বিক্রি করেন কসাই জালাল হোসেন। তিনি জানালেন, বড় গরুর মাংস বিক্রি হয় কম। বড় গরুর মাংসে চর্বি থাকে বেশি। তাছাড়া ঝুঁকি তো থাকেই। রাজধানী তথা সারা দেশে বড় পুঁজি নিয়ে কসাইয়ের কাজ করছেন হাতে গোনা কয়েকজন। অধিকাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছোট-মাঝারি আকারের পশু জবাই করেন। ঈদে অবিক্রীত গরু কিছুটা কম দামে বিক্রি করতে চান কৃষক-খামারিরা। কিন্তু কসাইরা বড় গরু কিনতে আগ্রহী নন। কারণ, ঈদের পর অন্তত ১ থেকে দেড় মাস মাংস বিক্রি খুব কম হয়।

বড় গরু পালন ও উৎপাদন বাড়ছে : ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন ও খামার সূত্রে জানা যায়, দেশে আধুনিক উপায়ে দিনদিন বড় গরু-ছাগল ও মহিষ পালন বাড়ছে। খামারি তথা কৃষকও উন্নত জাতের বড় গবাদি পশু উৎপাদন করছেন। মাংসের জোগান বাড়াতে বড় গবাদি পশুর বিকল্প নেই। দেশি জাতের গাভি থেকেই উন্নত জাতের বড় পশু উৎপাদন হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় বড় পশু কেনার ক্ষেত্রে অনীহা এলে সার্বিকভাবে বড় পশু লালনপালনে উৎসাহ হারাবেন খামারিরা। ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ এমরান যুগান্তরকে বলেন, অবিক্রীত পশুর মধ্যে প্রায় ২ শতাংশ বড় গরু রয়েছে। অবিক্রীত বড় পশু এখন কৃষক-খামারিদের চরম শঙ্কায় ফেলেছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক বাজার বা কসাইয়ের কাছেও তা বিক্রি করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, দেশে বড় গরু পালন ও উৎপাদন দ্রুততার সঙ্গে এগোচ্ছিল। একটি বড় গরু দ্রুত সময়ের মধ্যে ৭০০ থেকে ১১০০ কেজি ওজন হয়। মাত্র ২ বছরেই একেকটি পশু বিশাল আকারের হয়। বড় গরু নিয়ে বিপাকে পড়া কৃষক-খামারিদের শঙ্কামুক্ত করতে তেমন প্রতিশ্রুতিও দেখা যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ের পর বড় গরু লালনপালন করা ব্যয়সাপেক্ষ। আবার ঝুঁকির সঙ্গে লোকসানের শঙ্কাও বাড়ে। কারণ, একটা সময়ের পর পশুগুলো আর বাড়ে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম