এমপি আনার হত্যা
গ্যাস বাবুর যেভাবে উত্থান
মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুর রিমান্ডের খবরে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। তিনি ঝিনাইদহ পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। তার উত্থান নিয়েও ব্যাপক আলোচনা চলছে।
শাসক দলের অভ্যন্তরে বাবুকেন্দ্রিক ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে নানা গুজব। গ্যাস বাবু জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের খুবই আস্থাভাজন। আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া গ্রেফতারের পর গ্যাস বাবুর আচার-আচরণে পরিবর্তন আসে। অনেকের জানা ছিল না, আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন ও দায় স্বীকার করা পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক কমান্ডার শিমুল ভূঁইয়ার আত্মীয় বাবু।
এ বছরের ৫ জুন একটি মোবাইল ফোন হারানোর ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করেন বাবু। ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন উদ্দীন বলেন, ওই জিডি করার সময় ঝিনাইদহ সদর থানায় সশরীরে হাজির হন বাবু। ফোন হারানোর ঘটনায় নানা প্রশ্ন করেন ওসি। সন্দেহজনক ওই জিডির খবর পেয়ে যান ঢাকা ডিবি। এরপর বৃহস্পতিবার (৬ জুন) রাতে বাবুকে আটক করা হয়। পরে তাকে আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এখন রয়েছেন রিমান্ডে।
কে এই গ্যাস বাবু : ২০০১ সালে গ্যাস বাবু জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বর্তমান জেলা কমিটির ৬নং সহসভাপতি আব্দুল খালেকের হাত ধরে পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এর আগে তার রাজনৈতিকভাবে কোনো পরিচয় ছিল না। জেলা শহরের চান্দা সিনেমা হলের সামনে একটি ছোট্ট দোকানে গ্যাস বিক্রি করতেন। ভাগ্য খুলে যায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০০৯ সাল) পরবর্তী সময়ে।
বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী মসিউর রহমানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমবার এমপি হন জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি শফিকুল ইসলাম অপু। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে এমপি অপুর নিকটজন হিসাবে গ্যাস বাবু বিত্তবান হয়ে ওঠেন। অভিযোগ রয়েছে, অপুর সময়ে দরপত্রসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালিত হয়েছে বাবুর মাধ্যমে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর পর সভাপতির দায়িত্ব পান সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম অপু। তিনিও বাবুর বিষয়ে মুখ খুলেছেন। গ্যাস বাবুর কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা পাবেন বলে দাবি করেছেন অপু। ২০১৪ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমির পক্ষ নেয় বাবু। নৌকা প্রতীক পাওয়ার পরও পরাজিত হন শফিকুল ইসলাম অপু। এরপর আরও সম্পদ বাড়তে থাকে বাবুর।
ধীরে ধীরে গ্যাস বাবু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। গত বছর অনুমোদিত জেলা কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক পদ পেয়ে যান তিনি। শুধু তাই নয়, জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন গ্যাস বাবু।
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, থানায় কোনো অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। বর্তমানে জেলা শহরের শেরেবাংলা সড়কে (নতুন হাটখোলা) গ্যাস বিক্রির বিশাল দোকান রয়েছে তার। পাশেই রয়েছে বড় আকারের গুদামঘর। সেখানে থরে থরে গ্যাসের সিলিন্ডার সাজানো। বসুন্ধরা (এলপি) গ্যাসের ডিলার তিনি (বাবু)। দোকানের নাম ‘গ্যাস ঘর’।
বাবুর মা কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের দাউদ হোসেন ওরফে বিষু বিশ্বাসের বোন ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির থিঙ্কট্যাঙ্ক ক্রসফায়ারে নিহত মিজানুর রহমান ওরফে টুটুল ডাক্তারের ফুপু। সেই সূত্রে শিমুল ভূঁইয়ার নিকটাত্মীয় বাবু।
শিমুলের বোনের (প্রবাসী) বিয়ে হয় মিজানুর রহমান ওরফে টুটুল ডাক্তারের সঙ্গে। এলাঙ্গী গ্রামের আসাদুজ্জামান ওরফে কাটু বিশ্বাসের চাচাতো ভাই ডাক্তার টুটুলের বাবা দাউদ হোসেন ওরফে বিষু বিশ্বাস। আসাদুজ্জামানের তিন ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে আক্তারুজ্জামান শাহীন ছোট। কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহীদুজ্জামান সেলিম বড় ও আমেরিকা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার মনিরুজ্জামান মেজো।
পুলিশের একটি সূত্র যুগান্তরকে বলেন, ফোন হারানোর জিডির সূত্র ধরে ফেঁসে গেছে বাবু। ২২ মে আনার ভারতে খুন হন। তার আগেই গোয়েন্দাদের দ্বারস্থ হন আনারকন্যা ডরিন। গোয়েন্দারা চারদিকে জাল বিস্তার করায় আটকা পড়েন বাবু।
জানা গেছে, এমপি আনার হত্যার সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক বিরোধের যোগসূত্র আছে কিনা তা নিয়ে সিআইডির একটি দল আগে থেকেই কাজ করছে। গোপনে চিহ্নিত বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন তারা।
কালীগঞ্জকেন্দ্রিক শাসক দলের মধ্যকার বিরোধের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। সেক্ষেত্রে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতার গতিবিধির ওপর চোখ রাখছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা। ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার পর নিহত হন এমপি আনার।