Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

চিকিৎসা ব্যয়ের অভাব

রোগ গোপন করার প্রবণতা বাড়ছে

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রোগ গোপন করার প্রবণতা বাড়ছে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ক্যানসার ইউনিটের সামনে রোববার মায়ের কোলে দেখা যায় ছোট শিশু আরিয়ানকে। পেট ফোলা ও কান দিয়ে রক্ত আসায় বেশ কষ্ট পাচ্ছিল শিশুটি। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে মা ময়না বেগম বলেন, ছেলে দেড় বছর ধরে ব্লাড ক্যানসারে ভুগছে। এখন পর্যন্ত ২২টি কেমোথেরাপি দিতে হয়েছে। সবশেষ গত বছরের মার্চে ৩টি থেরাপি দিয়েছিলাম। এরপর থেকে খরচ জোগাতে পারছি না। কেমো ছাড়া চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ থাকা সম্ভব কি না জানতে এখানে নিয়ে এসেছি। শিশুটির বাবা মোরশেদ বলেন, আমি অন্যের কারখানায় দরজির কাজ করি। ছেলের পেছনে ইতোমধ্যে ৩ লাখ টাকা চলে গেছে। খরচ জোগাতে টাঙ্গাইলের মধুপুরে গ্রামের বাড়ি বন্ধক রেখে নারয়াণগঞ্জে একটি ভাড়া বাসায় উঠেছি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আরও কোমাথেরাপি লাগবে। কিন্তু অর্থাভাবে সময়মতো দিতে পারছি না। ছেলের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। টাকা না থাকায় রোগ পুষে রাখতে হচ্ছে।

শুধু আরিয়ান নয়, গত এক সপ্তাহে রাজধানীর অন্তত ১০টি হাসপাতাল ঘুরে সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক রোগী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এমন বক্তব্য জানা গেছে। চিকিৎসা খরচ জোগাতে না পারায় তাদের অনেকেই রোগ-শোক নিয়ে বসবাস করছেন। পরিস্থিতি মারাত্মক হলে তবেই হাসপাতালে আসছেন।

সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে বলছেন, ওষুধের কাঁচামাল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফিসহ সব ধরনের চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়েছে। রোগীদের প্রতিবার ফলোআপের জন্য চিকিৎসকের ফি, ডায়াগনস্টিকে বাড়তি খরচ, অ্যাম্বুলেন্সসহ পরিবহণ ভাড়া, বাড়তি দামে ওষুধ ক্রয় এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অ্যাটেনডেন্টের থাকা-খাওয়ার খরচও বেড়েছে। ফলে অনেকে পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই মাঝপথে চিকিৎসা নেওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরা যুগান্তরকে বলছেন, দেশে চিকিৎসাসেবার মূল্য নির্ধারণে জাতীয় মানদণ্ড বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন নেই। স্বাস্থ্যসেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো রোগীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে গলাকাটা অর্থ আদায় করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে একদিকে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন, অন্যদিকে চিকিৎসার ব্যয় বাড়ছে। ডলার সংকটে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে গত তিন বছরে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। একইভাবে বেড়েছে ডায়াগনসিস খরচ।

জানা যায়, চিকিৎসা ব্যয় কমাতে ২০২২ সালের নভেম্বরে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্যাথোলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধরন, স্থান ও বিছানা বিভাজন অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, যা এখনো আলোর মুখ দেখনি।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ব্যয় কমানোসহ সব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। চিকিৎসাসেবার মূল্য নির্ধারণে জাতীয় মানদণ্ড বা গাইডলাইন প্রণয়ন করা হবে। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবা কীভাবে সহজলভ্য হয়, সেই চেষ্টা চলছে। সামনে জাতীয় বাজেট, সেখানে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ অন্যান্য সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হবে।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যমতে, রোগীদের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থই ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। বাকিটা রোগ নির্ণয় বা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসক দেখানো, হাসপাতালে ভর্তি, চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় ও সেবা নেওয়ার পেছনে ব্যয় হচ্ছে। এভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর দেশে ৮৬ লাখ মানুষ আর্থিক সমস্যায় পড়ছেন। ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকছেন।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্যব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ; অর্থাৎ তিন বছরে পর্যায়ক্রমে তা কমেছে। বিপরীতে ওই বছরগুলোয় ব্যক্তির পকেট ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ, অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে তা বেড়েছে। এভাবে চিকিৎসা খরচ বাড়লেও সরকার তাতে লাগাম টানতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী যুগান্তরকে বলেন, ক্যানসার, কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ দীর্ঘমেয়াদি অসুখগুলো সময়মতো চিকিৎসা করালে অর্থ সাশ্রয়সহ রোগীদের জটিলতা থেকে রক্ষা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অনেকের খাবার জোগাড়েই হিমশিম অবস্থা। অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে। স্বাধীনতার পর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চিকিৎসা খাত পুরোটাই সরকারি খাতে ছিল। এরপর এ খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। ৭০ শতাংশ রোগী বেসরকারিভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে মূল বাজেটের পরিমাণ বাড়লেও শতাংশ হিসাবে ৫ শতাংশের আশপাশেই রয়েছে। স্বাস্থ্য বাজেট ১২ শতাংশ হওয়া উচিত। মানসম্মত চিকিৎসা দিয়ে রোগীদের সরকারি হাসপাতালমুখী করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রপাতিসহ অনেককিছু নষ্ট থাকায় চিকিৎসা ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এগুলোর জন্য তদারকি ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে গুণগত সেবা দিতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিপর্যায়ের খরচ কমাতে হলে প্রাইভেট হাসপাতালের খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা হলেই রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসা পাবে। রোগ পুষে রাখার প্রবণতা কমবে।

ব্যয়বৃদ্ধির বড় কারণ ওষুধের দাম : চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির বড় কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। রোগীরা জানান, উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অপসোনিন কোম্পানির তৈরি ১০ পিসের এক পাতা জুলিয়াম ট্যাবলেট ৫ জানুয়ারিতে ২৮ টাকায় কিনতেন। দাম বাড়ায় ফার্মেসিগুলোয় ৩৫ টাকা পাতা বি?ক্রি হচ্ছে।

ত্বকের খোসপাঁচড়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত পেভিসন ক্রিম জানুয়ারিতে ৪৫ টাকা ছিল, বর্তমা?নে তা ৭০ টাকায় বিক্রি করছেন। দাদ, অ্যালার্জি ও চুলকানির চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্কয়া?রের পেভিটিন ক্রিম ৫০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা হয়েছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের তৈরি শিশুদের হার্বাল হজমিকারক ও বায়ুনিঃসারক ১০০ মিলিগ্রাম নওনেহাল সিরাপ ডিসেম্বরে ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ এবং চাহিদা বাড়ায় জানুয়ারিতে ৮৫ টাকা করা হয়েছে।

শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং টনসিলাইটিসের জন্য ব্যবহৃত একমি ল্যাবরেটরিজের ৫০০ এমজির প্রতি পিস অ্যামিজন ক্যাপসুল ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা করা হয়েছে। এভাবে ৬টির এক পাতা ওষুধ ২৭০ থেকে ৩৩০ টাকা অর্থাৎ ২২ শতাংশ দাম বেড়েছে।

ডায়াবেটিস রোগীদের ব্যবহৃত অতিজরুরি ইঞ্জেকশন হুমালগ মিক্স ৫০০ (এক প্যাকেট ৫টি) ৩ এমএলের দাম জানুয়ারিতে ছিল ৪ হাজার টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৭৫০ টাকা। ডায়াবেটিসের ইঞ্জেকশন হিউসুলিন ৭০/৩০ (এক প্যাকেট ৫টি) ১০ এমএলের দাম ছিল ৬০০ টাকা। বর্তমানে ৯৯৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। নরমিক্স সিক্স (এক প্যাকেট ৫টি) ৯৮০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫০ টাকা হয়েছে।

হৃদরোগীর হার্টে প্রতিস্থাপনের জন্য মাঝারি মানের ভাল্ব ছিল ৫০ হাজার থেকে ৫২ হাজার টাকা। বর্তমানে দাম বেড়ে লাখ টাকা হয়েছে। অক্সিজেন কিট আগে ছিল ২২ হাজার টাকা। এখন তা ৫০ হাজার টাকা। এরকম প্রায় সব ডিভাইসের দামই ২ থেকে ৪ গুণ বেড়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম