Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

শুনানির অপেক্ষায় ১০১৯ মামলা

২০ বছরে সর্বোচ্চ ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে

বিচারক নিয়োগ ও বেঞ্চ বাড়ানো প্রয়োজন -ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ * মামলা বাড়ার তুলনায় নিষ্পত্তি কম -রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী

আলমগীর মিয়া

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার বিচার ৬ মাসের মাথায় নিম্ন আদালতে সম্পন্ন হয়েছিল। আদালত ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর মামলার রায়ে প্রধান আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) শুনানি হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। সে মোতাবেক বিচারিক আদালতের রায়ের ৪ মাসের মাথায় এ মামলা হাইকোর্টে শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। ২০২০ সালের ৩ মার্চ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের কার্যতালিকায়ও ওঠে। একপর্যায়ে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চটি ভেঙে গেলে শুনানির জন্য মামলাটি আর কোনো বেঞ্চের তালিকায় আসেনি। হাইকোর্টে মামলাটি সাড়ে ৪ বছর ধরে ঝুলে আছে। শুধু এ মামলাই নয়, এমন শত শত মামলা উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় আছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী হাইকোর্টে এখন ১ হাজার ১৯টি ডেথ রেফারেন্স বিচারাধীন। যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ডেথ রেফারেন্সের বিপরীতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়মিত জেল আপিলও রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বরগুনার রিফাত হত্যা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলাসহ বেশকিছু চাঞ্চল্যকর মামলার ডেথ রেফারেন্স রয়েছে। এসব মামলায় প্রায় আড়াই হাজার ফাঁসির আসামি কনডেম সেলে আছেন বিচার নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। পর্যায়ক্রমে তাদের মামলা একদিন কার্যতালিকায় উঠবে। সে অপেক্ষায় তাদের প্রতি মুহূর্ত কাটে মৃত্যুযন্ত্রণায়। আইনি প্রক্রিয়ার ফেরে পড়ে বছরের পর বছর শত শত আসামিকে থাকতে হচ্ছে কারাগারের কনডেম সেলে।

এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের আইনজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত পেপারবুক তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো রকম লম্বা মুলতবি ছাড়া শুনানি অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া বিশেষ বেঞ্চ বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষ বিচারপতির সংখ্যা বড়ানোর প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডেথ রেফারেন্স শাখার এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স যে হারে বাড়ছে তাতে নিষ্পত্তির হার কম। বর্তমানে এক হাজারের উপরে ডেথ রেফারেন্স রয়েছে শুনানির জন্য। চারটি বেঞ্চে এ শুনানি চলছে।

বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসাবে পরিচিত। নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আর সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা কারাগারে থেকে জেল আপিল করতে পারেন। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করতে পারেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৪ সালে মোট ডেথ রেফারেন্স মামলা ছিল ৪৩৯টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১০১টি। আর বিচারাধীন থাকে ৩৩৮টি। পরের বছর ২০০৫ সালে মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৩। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৪৯টি, বিচারাধীন থাকে ৪৬৪টি। ২০০৬ সালে ৫৭৬টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৬৫টি। ২০০৭ সালে মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১৩টি। নিষ্পত্তি হয় ১৪৮টি, বিচারাধীন থাকে ৪৬৫টি। ২০০৮ সালে ৬০২টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি হয় ১২৮টি। ২০০৯ সালে ৫৫৭টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি হয় ৪৮টি। এভাবে ক্রমান্বয়ে ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭৫টি এবং নিষ্পত্তি হয় ১০০টি। বিচারাধীন ছিল ৭৭৫টি। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস দেখা দেওয়ার পর আদালত বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৯টি। যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছর ৪ মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪টি। আর দায়ের হয়েছে ১৭৩টি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ সালের পর থেকে যে সংখ্যক ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এসেছে তার চেয়ে নিষ্পত্তির হার ছিল কম। আর এ কারণে নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগছে।

দেশের আদালতগুলোতে মামলা জট নিরসনে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয় সুপ্রিমকোর্ট থেকে। যোগদানের পর থেকে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের বিভিন্ন আদালত পরিদর্শন করে যাচ্ছেন। বুধবার লালমনিরহাট জেলা ও দায়রা জজ আদালত পরিদর্শনকালে বিচার কার্যক্রমের গতিশীলতা বাড়াতে তুচ্ছ ও ছোটখাটো বিষয়ে মামলা না করার পরামর্শ দেন তিনি। এ ছাড়া বিচার বিভাগের আধুনিকায়ন ও মানোন্নয়নে আইনজীবীদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়। গত বছরের ১ অক্টোবর নেত্রকোনা শহরে এক নাগরিক সংবর্ধনা সভায় মামলা জট নিরসনে আইনের সংস্কার প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, যুগোপযোগী আইন তৈরি করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

আদালত সূত্র জানায়, বর্তমানে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে চাঞ্চল্যকর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানি চলছে। মামলাটি ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে ওই বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানান, এটি অনেক বড় মামলা। দুটি মামলার (হত্যা ও বিস্ফোরক) প্রায় আড়াই হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক রয়েছে। এছাড়া বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি অসুস্থ থাকায় মামলাটি নিষ্পত্তিতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।

ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে দ্রুত পেপারবুক তৈরিতে গুরুত্ব আরোপ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি করতে হলে কোনো রকম মুলতবি না দিয়ে শুনানি অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া বিচারক নিয়োগ ও বেঞ্চ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেমড সেল) রাখা যাবে না বলে হাইকোর্ট রায় দেন। পরে হাইকোর্টের ওই রায় ২৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম