গরমে কদর বেড়েছে হাতপাখার
নিকলীর ‘হাতপাখা গ্রামে’ কারিগরদের ব্যস্ততা
এ টি এম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তীব্র দাবদাহের কারণে চাহিদা বাড়ায় হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের নিকলীর সূত্রধরপাড়া গ্রামে -যুগান্তর
দেশ বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় এলেও বছরের এই সময়টাতে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ, বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাই তালপাতার তৈরি হাতপাখার কদর বেড়ে যায়।
পাশাপাশি বৈশাখী বারুণী মেলা উপলক্ষ্যে হাতপাখার চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। এই ‘জো’ (মৌসুম) ধরার বছরব্যাপী অপেক্ষায় থাকেন হাওড় জেলাখ্যাত কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার তিনটি গ্রাম সূত্রধরপাড়া, টেকপাড়া ও মালপাড়ার নারীরা। এখানকার প্রায় সব নারী তালপাতার তৈরি হাতপাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। পুরুষরা তাদের এই কাজে সহযোগিতা করেন। একসঙ্গে এই ৩ গ্রাম ‘তালপাখা গ্রাম’।
তালপাখা গ্রামের ৩শ পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে সদস্যরা হাতপাখা তৈরির কাজে নিয়োজিত আছেন। তবে পুরুষরাও হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারাও পাখা তৈরির কাজে নারীদের সহযোগিতা করেন, যাকে বলে ‘জোগান’ দেন। এখানে পাখা তৈরির ইতিহাস অর্ধশতাব্দীরও বেশি প্রাচীন।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বর্ণনাতীত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন নিকলী উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকরা। সহায়- সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হন। অনেকেই স্বজনহারা হন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে জীবিকার তাগিদে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ প্রথম শুরু করেন টেকপাড়ার শুভা রানী সূত্রধর। তিনি তার বাবার বাড়িতে এই কাজ শিখে এসে স্বামীর বাড়ি এলাকার নারীদের শেখান। আস্তে আস্তে মালপাড়া ও সূত্রধরপাড়ার নারীরাও পাখা তৈরির কাজ শিখে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেন।
শুভা রানীর বয়স এখন ৯০ বছর ছুঁইছুঁই। এই বয়সেও তিনি পরিবারের সদস্যদের পাখা তৈরির কাজ তদারকি করেন। অন্যদের উৎসাহ জোগান।
এখানকার হাতপাখার পরিচিতি দেশময় পড়িয়ে পড়েছে। পাইকাররা দূর-দূরান্ত থেকেও পাখা কিনতে আসেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলার মৌসুমে দোকানিরা এসে নিয়ে যায়। তালপাতা, প্লাস্টিক সুতা, বাঁশ ও বেতজাত কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় একেকটি হাতপাখা তৈরিতে খরচ ৩৫-৪০ টাকা। কারুকাজ ও নির্মাণশৈলীভেদে পাইকারি দাম ৮০-৯০ টাকা। কুটির শিল্পজাত তালপাতার হাতপাখা তৈরির কাজ এই ৩ গ্রামের মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, পাখা তৈরির ভরমৌসুমে গ্রামগুলোতে এখন উৎসবের আমেজ বইছে। ঘরের ভেতর, বারান্দা, উঠান-আঙিনা সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাতপাখা তৈরির সরঞ্জাম। পাতা সেলাই ও তার ওপর নানারকমের বুননকর্মে মনোযোগের সঙ্গে কাজ করছেন কারিগররা।
শুভা রানীর আফসোস, তালপাতার হাতপাখা তৈরির মতো সম্ভাবনাময় কুটির শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে, টিকিয়ে রাখতে কোনো মহল থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নেই। অথচ সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্পে আরও বেশিসংখ্যক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতো।
এ ব্যাপারে নিকলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাকিলা পারভীন বলেন, পশ্চাৎপদ হাওড় অঞ্চলের এই নারীরা ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। খোঁজ নিয়ে সম্ভাব্য সব রকমের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।