দাপ্তরিক কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহার
জনবল সংকট বাবাকোর পর্যাপ্ত অর্থ নেই
প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ভাষা মুখপাত্রের পদ সৃষ্টির তাগিদ
আমিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারি অফিসের চিঠিপত্রে বাংলা বানানে অনেক ভুলভ্রান্তি থাকছে। বাংলায় লেখা চিঠিতে অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়। সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব এবং সচিবদের কাছে উপস্থাপন করা নোটেও থাকছে ভুল। ভুল বানান থেকে বেরিয়ে আসতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি অনুবিভাগ সৃষ্টি করেছে। ওই অনুবিভাগের একটি অংশ হচ্ছে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো)। ওই কোষের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, দাপ্তরিক কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনা না মানায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, এসব উদাসীনতার ফসল। জনবল সংকট ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুদ্ধভাবে করা যাচ্ছে না।
এদিকে দাপ্তরিক কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সৃষ্ট বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষে (বাবাকো) ভাষা বিশেষজ্ঞের বড়ই অভাব। প্রশাসন ক্যাডারের তত্ত্বাবধানে কোষ পরিচালিত হলেও তারা ভাষা প্রমিতীকরণে কোনো কাজ করেন না। তারা প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখভাল করেন। মূল কাজটি করেন ভাষা বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বাবাকোতে একজন ভাষা বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। এছাড়া একজন সিনিয়র অনুবাদ কর্মকর্তা, একজন অনুবাদ কর্মকর্তা এবং একজন অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার কাজ করছেন। এর মধ্যে দুজন সহযোগী অধ্যাপক এবং দুজন সহকারী অধ্যাপক। এ চারজনের তিনজন বাংলা ভাষা প্রমিতীকরণের কাজ করেন। মাত্র একজন করেন ইংরেজি ভাষা প্রমিতীকরণের কাজ।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে তাদের প্রেষণে আনা হয়েছে। এ কোষের জন্য আউটসোর্সিংয়ের আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। অর্থাৎ ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন অনেক প্রবীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকলেও আউটসোর্সিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় এবং আউটসোর্সিংয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কাজগুলো করা যাচ্ছে না। ভাষা কোষের নেই কোনো প্রকল্প। অন্য অনুবিভাগগুলোর মতো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাজেটে এ কোষ পরিচালিত হয়। এ কোষের যাবতীয় প্রকাশনা বিজি প্রেস থেকে ছাপানো হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, জনবল সংকট রয়েছে, বিষয়টি আমার জানা নেই। এখন খোঁজখবর নিয়ে দেখব। কর্মকর্তাদের উপযুক্ত রুম নেই। রুমের সংকটের কথা স্বীকার করে সচিব জানান, সচিবালয়ে নতুন একটি ভবন হচ্ছে, ওই ভবনে অনেকের বসার সুযোগ হবে। তখন আর রুম সংকট থাকবে না। মূল্যবান অনেক গ্রন্থ অনুবাদের জন্য ভাষা কোষ আউটসোর্সিংয়ের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে সচিব জানান, চলতি অর্থবছর গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রেখেছি। উইং প্রধান চাহিদা দিয়ে অর্থ বরাদ্দ নিতে পারবেন।
বাবাকোর শুরুর দিকে জনবল ছিল ২৩ জন। বর্তমানে কর্মরত মাত্র ১২ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। কাজের জায়গায় লোক না থাকায় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অনেক সময় ভুলভ্রান্তি থেকে যায়। জনবল কমলেও ভাষা কোষের কাজের পরিধি বেড়েছে। এখনো অনেক বড় বড় আইন, বিধি, নীতিমালা প্রমিতীকরণের কাজ বাকি বলে জানা গেছে। আগে বছরে ভাষা কোষে ৬ থেকে ৮টি আইন প্রমিতীকরণের জন্য আসত। এখন বছরে ৮০ থেকে ১০০টি আইন, বিধিমালা, নীতিমালা প্রমিত করার জন্য আসে। অথচ ভাষা কোষে জনবল কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাখা পর্যায়ে নোট দেওয়ার কথা শাখা প্রধানের। নোট দিচ্ছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) কিংবা কম্পিউটার অপারেটর বা স্ট্যানোটাইপিস্ট। ফলে ভুলভ্রান্তি হচ্ছে। অনেক সময় ভুলসহ চিঠিপত্র জারি হয়ে যাচ্ছে। ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলা বানান ভুল ঠেকাতে শাখা পর্যায়ের ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের (এও) লাগাতার প্রশিক্ষণ এবং বাধ্যতামূলক অনুশীলন সমস্যার সমাধান হতে পারে। এছাড়া প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এবং অধীনস্থ দপ্তর সংস্থায় একটি করে ভাষা বিশেষজ্ঞের পদ সৃষ্টি করে নিয়মিত অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
জানতে চাইলে বাবাকোর সাবেক অতিরিক্ত সচিব আলম আরা যুগান্তরকে বলেন, বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা দিয়েই আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু এবং শেষ হয়। কর্মজীবনে এসে এর প্রভাব পড়ে। অধিকাংশ শিক্ষক বাংলা ভাষা বানানরীতি জানেন না।
তার মতে, সরকারি অফিসের চিঠিপত্রের ভুল উদাসীনতার ফসল। ভাষার প্রতি আমাদের উদাসীনতার কোনো শেষ নেই। কেউ শিখতে চায় না। এ উদাসীনতা একক কোনো ব্যক্তির নয়। বরং মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর উদাসীনতাই এ ধরনের ভুলভ্রান্তির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তিনি। তার মতে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, শিক্ষা বোর্ড, অধিদপ্তর, দপ্তর এবং পরিদপ্তরে একটি করে বাংলা ভাষা মুখপাত্রের পদ সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। তিনি আরও বলেন, সরকারি চিঠিপত্র, সভার কার্যবিবরণী যেন প্রমিত বাংলায় লেখা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাজার সমস্যার মধ্যেও বাবাকো ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৪২১টি আইন, বিধি এবং নীতিমালা প্রমিতীকরণ করেছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৪৮টি আইন, বিধি এবং নীতিমালা প্রমিতীকরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রশাসনিক পরিভাষা ও সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা, ২০১৭ সালে সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম এবং ২০১৯ সালে পদবির পরিভাষা প্রণয়ন করে তা অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে বাবাকো। এছাড়া বাবাকোর শতভাগ ফাইল ই-নথিতে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। প্রতিবছর কর্মচারীদের পরিসংখ্যান সংক্রান্ত পুস্তক প্রকাশ করে বাবাকো। বাংলাদেশ সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪ হালনাগাদ করে প্রকাশের কার্যক্রম চূড়ান্ত করেছে বাবাকো।