Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

৫০টি জীবনরক্ষাকারী টিকা

গবেষণা দেশের এক জেলায়ই

আইসিডিডিআর,বি মতলব কেন্দ্রের উদ্যোগ * বার্জের ভেতর অস্থায়ী কারা প্রকোষ্ঠ এখনো স্মৃতি হয়ে আছে

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গবেষণা দেশের এক জেলায়ই

‘এক চিমটি লবণ, একমুঠো চিনি বা গুড় ও আধা সের পানি’ মিশিয়ে স্যালাইন তৈরির সেই পুরনো বিজ্ঞাপনটি সবার জানা। আগে গ্রামগঞ্জের মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হলে এই পদ্ধতির চিকিৎসা নিতেন। আধুনিক মোড়কে খাবার স্যালাইন বাজারে এলেও গ্রামে পুরনো পদ্ধতির এই চিকিৎসা একেবারে উঠে যায়নি। ডায়রিয়া চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) বিজ্ঞানীদের অনেকগুলো যুগান্তকারী গবেষণার ফসল ছিল এটি।

অবাক বিষয় হলো, এই প্রতিষেধক গবেষণার সূতিগার হলো- বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলা। এই উপজেলায়ই (আইসিডিডিআর,বি) ৫০টিরও বেশি জীবনরক্ষাকারী টিকার সফল গবেষণা হয়েছে- যেগুলো বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষকে জীবন সংহারক রোগ থেকে নিরাপদ রেখেছে এমনটিই জানালেন সংশ্লিষ্টরা। গেল ৩০ জানুয়ারি মতলবে আইসিডিডিআর,বির স্বাস্থ্যসেবাদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিদর্শনে গেলে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) মহামারি আকারে দেখা দেয় কলেরা।

তখন তৎকালীন কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি বা সিআরএল (আইসিডিডিআর,বির পূর্ব নাম) রোগটি নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেয়। তবে ভোলা, বরিশাল না চাঁদপুর, কলেরা নিয়ে গবেষণার জন্য কোন এলাকা ভালো হবে এ রকম একটি সংশয়ে নদীপথে যাতায়াতের সুবিধায় চাঁদপুরের মতলবকে বেছে নেওয়া হয়। এরপর ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে একটি ছোট্ট কলেরা ওয়ার্ড দিয়ে মতলবে যাত্রা শুরু করে। ওই সময় নদীনালা আর জলাভূমির আধিক্যের কারণে এ অঞ্চলে কলেরার প্রকোপ বেশি ছিল। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিআরএল তথা আইসিডিডিআর,বি ওই বছরের সেপ্টেম্বরে একটি বার্জকে (বজরা বা নৌকা) ফিল্ড ডায়রিয়া হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহার শুরু করে। বার্জটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশদের পরিত্যক্ত সম্পদ। যেটিকে মেঘনা নদীসহ আশপাশের জলসীমায় টহল কাজে ব্যবহার করা হতো। ওই সময় নদীর মোহনায় ব্যাপক ডাকাতি ও লুণ্ঠন হতো। ব্রিটিশ সরকার সেই দস্যুদের ধরে এনে বার্জের ছোট অস্থায়ী কারা প্রকোষ্ঠে (মিনি কারাগার) আটকে রাখত।

পরে আইসিডিডিআর,বি মতলবে বার্জের ভাসমান হাসপাতালে রোগী পরিবহণের জন্য বেশ কয়েকটি স্পিডবোট অ্যাম্বুলেন্স হিসাবে ব্যবহার করত। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা বার্জে এসে চিকিৎসা নিতেন। এতে করে ওই এলাকায় কলেরা ও ডায়রিয়াজিনত অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধে ব্যাপক সাফল্য দেখায়।

এ ধারাবাহিকতায় কয়েক গত যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিনামূল্যে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাসেবা পেয়ে বদলে গেছে মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলার আড়াই লাখ মানুষের জীবন। স্বাস্থ্যসেবাদানে অসামান্য অবদান রাখায় বর্তমানে ঐতিহাসিক বার্জটি মতলবে আইসিডিডিআর,বির আন্তর্জাতিক ট্রেইনিং সেন্টারে ও মতলব হেলথ রিসার্স সেন্টারে ‘কলেরা রিসার্স হাসপাতাল’ জাদুঘর হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের (মতলব) সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. চন্দ্র শেখর দাস জানান, এই বার্জে বসেই ডায়রিয়া চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার স্যালাইন নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই আবিষ্কারের প্রধান বিজ্ঞানী ডেভিড নেলিন, রিচার্ড ক্যাস, রফিকুল ইসলাম ও মজিদ মোল্লা এ চারজনই এই বার্জের গেস্ট হাউসে থেকে গবেষণা করেছেন। খ্যাতিমান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রিতা কলওয়েল, ডেভিড সেক, হেনরি মজলে, বব ব্লাক, লিঙ্কন চেনসহ ৫০-এর অধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বার্জটি ব্যবহার করেছেন। আইসিডিডিআর,বির সাবেক নির্বাহী পরিচালক জন ক্লেমেন্স ১৯৮৫ সালের দিকে কলেরার প্রথম ওরাল ভ্যাকসিন বা মুখে খাওয়ার টিকা পরীক্ষার গবেষণার সময় এই বার্জে অবস্থান করেছিলেন। এছাড়াও ডেভিড সেক, রিচার্ড ক্যাস, হেনরি মজলে, বব ব্লাক, লিঙ্কন চেন এই বার্জ ব্যবহার করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা থেকে শুরু করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হার্ভার্ড, জন হপকিন্সসহ বিশ্ব স্বাস্থ্যে কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন এ রকম দেশি-বিদেশি অনেক বিজ্ঞানী, গবেষক, অধ্যাপক মতলবের এই বার্জে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন। বার্জটিতে শুরু হওয়া স্বাস্থ্যসেবাদান পরে চাঁদপুরের মানুষের জীবনমান বদলে দিয়েছে। এই এলাকায় আইসিডিডিআর,বির স্বাস্থ্যসেবাদান ও অসংখ্য গবেষণা সারা বিশ্বে ‘মতলব মডেল’ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

জানা যায়, আইসিডিডিআর,বি ১৯৭৭ সাল থেকে মতলবে ‘সমন্বিত মা-শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম (এমসিএইচএফ) প্রকল্প শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় সারা দেশে ১৫ হাজারের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল তৈরি করে প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে সরকার।

৩১ জানুয়ারি মতলব দক্ষিণের আইসিডিডিআরবির সার্ভিস এরিয়া ‘নাগদা ফিক্স সাইট ক্লিনিক’ গিয়ে সেখানে ৩০ শিশু ও দশজন মাকে টিকা নিতে আসতে দেখা যায়। সেবা নিতে আসা বেবি আক্তার বলেন, তিনি গর্ভধারণের আগ থেকে সন্তান জন্মদানের পরও এখানে নিয়মিত সেবা নিচ্ছেন। ক্লিনিক থেকে সব ধরনের টিকা, আয়রন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। না এলে ক্লিনিকের লোকজন ফোন করে খোঁজ নেন।

জানা যায়, মতলব উত্তর ও দক্ষিণ দুই উপজেলায় আইসিডিডিআর,বির মোট ৩৫টা ফিক্স সাইট ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিকে ৩৫ জন কমিউনিটি হেলথ রিসার্স ওয়ার্কার (সিএইচআরডব্লিউ) সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে সেবা দেন। ক্লিনিকগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সেবাদান ছাড়াও বর্তমানে শ্বাসকষ্টের রোগীদের মর্ডানার টিকা নিয়ে গবেষণা করছেন আইসিডিডিআর,বির চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. কে জামান।

ফিক্স সাইট ক্লিনিকের সিএইচআরডব্লিউরা ১৯৬৬ সাল থেকে হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক তথ্য সংগ্রহ করছে। প্রত্যেক মাসের ১৭ দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে মতলব হেলথ রিসার্স সেন্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখছে। ৩১ জানুয়ারি মতলব হেলথ রিসার্স  সেন্টারে সংরক্ষিত অজুফা খাতুন নামে একজনের রেকর্ড ফাইল ঘেঁটে দেখেন এই প্রতিবেদক। ফাইলে লিপিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে জন্ম নেওয়া অজুফা খাতুনের বিয়ে হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর ’৯৪ সালে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যান তিনি। সেখান থেকে ১৯৯৫ সালে অন্য এলাকায় বসবাস শুরু করে ১৯৯৭ ও ২০০১ সালে দুই সন্তানের মা হন। এরপর ২০০১ সালে শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসার পর ২০০৭ সালে স্বামীর সঙ্গে আলাদা বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকে ২০০৮ সালে বাবার বাড়ি গিয়ে আরেকটি সন্তানের জন্ম দেন। বাবার বাড়ি থেকে ২০০৯ সালে স্বামীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকে ২০১২ সালে মতলবে ফের স্বামীর বাড়িতে বসবাস করছেন। এভাবে প্রত্যেক রেকর্ড বইয়ে একজন মানুষের আট ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে জন্ম ও মৃতু্য তারিখ, মাইগ্রেশন (অন্যত্র স্থানান্তর), বিয়ে, সন্তান জন্মদান, মা ও শিশুর স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য ইত্যাদি। এভাবে মতলবের আড়াই লাখ জনগোষ্ঠীর তথ্য সংরক্ষণ করেছে আইসিডিডিআর,বি। প্রতি তিন মাস পরপর ৩০ জন সিএইচআরডব্লিউ দিনে ৪০ থেকে ৪৫টা খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রেকর্ড ফাইল আপডেট করে থাকেন।

হাসপাতালটিতে সাধারণত ডায়রিয়া, কলেরা ও সন্তানসম্ভাবা মায়েদের গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা (এএনসি), স্বাভাবিক ডেলিভারি, গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা (পিএনসি) ও ক্যাংগারু মাদার কেয়ার সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এভাবে মাসে গড়ে ৭০টির মতো স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে সহায়তা করা হয়।

এছাড়া হাসপাতাল ল্যাবে রোগীদের বিনামূল্যে সব ধরনের মাইক্রোবায়োলজিক্যাল, প্যাথলজিক্যাল ও বায়োকেমিস্ট টেস্ট ছাড়াও বেশ কিছু পরীক্ষা ঢাকার আইসিডিডিআর,বি থেকে করে আনা হয়। ২০২২ সালের মে মাস থেকে বাইরের রোগীদের নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সব মিলে মানসম্মতভাবে প্রায় ৭০ ধরনের পরীক্ষা করা হয় ল্যাবটিতে। হাসপাতালে বর্তমানে ৩০ জন রিসার্স স্টাফ, ৩০ জনের মতো চিকিৎসক ছাড়াও নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য জনবল সেবাদানে নিয়োজিত রয়েছে। মতলব হাসপাতাল এই অঞ্চলের ৩৫টি উপজেলার মানুষ বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারছে।

মতলব হেলথ রিসার্স সেন্টারের প্রধান ডা. আল-ফজল খান যুগান্তরকে বলেন, ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে আইসিডিডিআর,বি এখানে প্রথম কলেরা টিকার গবেষণার জন্য কাজ শুরু করে। এখন পর্যন্ত ৫টি ইনজেক্টবল এবং একটি মুখে খাওয়াসহ ৬ ধরনের কলেরা টিকা নিয়ে গবেষণা হয়েছে হাসপাতালটিতে। গবেষণায় সফলতা পাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৬০টি দেশে এসব টিকা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। টিকার বাইরে মা, শিশু স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গবেষণা হয়েছে। এর বাইরে নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কারজনিত মৃত্যু রোধ ও গর্ভবতী মায়েদের টিটেনাস টক্সিয়েড টিকার ওপর গবেষণা হয়েছে। রোটাভাইরাস, জন্ডিস, পোলিও, রক্ত আমাশয়সহ ৫০টির বেশি টিকা নিয়ে এখানে গবেষণা হয়েছে। মা ও শিশুর পুষ্টি, আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব রোধে গবেষণা হয়েছে। সম্প্রতি অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে গবেষণা চলছে। মতলবের গবষণা নিয়ে বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়। অসংখ্য গবেষণা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশ তাদের স্বাস্থ্যনীতিতে গবেষণার ফলাফল অনুসারে কর্মসূচি নিয়েছে। মতলবের কলেরা টিকার গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইনজেকটেবল টিকা বাতিল করে।

গবেষকরা আরও বলেন, মতলব হাসপাতালের ডায়রিয়া ইউনিটে বছরে প্রায় ৬০ হাজারের বেশি ডায়রিয়া রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। অন্যদিকে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় এমসিএইচ ক্লিনিক ইউনিটে এই এলাকার ৬৭টি গ্রামে প্রায় ২০ হাজার বিবাহিত নারী সেবা নেন। এছাড়া ৫ বছরের কম সর্দি-কাশি রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, মারাত্মক নিউমোনিয়া, নবজাতকদের জন্ডিস, জন্মের সময়ের জটিলতাকলীন হাইপোথার্মিয়া সেবা দেওয়া হয়। সবমিলে বছরে প্রায় ১৮ হাজার শিশু বিনামূল্যে চিকিৎসা নিয়ে থাকে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম