পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬ বছর
মৌলিক শর্তগুলো বাস্তবায়িত হয়নি আজও
সুশীল প্রসাদ চাকমা, রাঙামাটি
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৬ বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো আজও অবাস্তবায়িত। ফলে প্রতিষ্ঠা পায়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান। প্রতিষ্ঠিত হয়নি স্থায়ী শান্তি। আজও অস্ত্রের ঝনঝনানি রয়ে গেছে পাহাড়ে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে খোদ চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকারদলীয় পক্ষ বলছে, এগুলো বাস্তবায়ন দরকার। এতটা বছরেও পার্বত্য শান্তিচুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ নানামুখী বাধা ও জটিলতা।
চুক্তি সম্পাদনকারী অপরপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতারা বলছেন, তারা এতটা বছর ধরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন দাবি জানিয়ে এখন হয়রান হয়ে গেছেন। কিন্তু সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
দীর্ঘ সংলাপ শেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন সংঘাতময় পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহŸায়ক আবুল হাসনাত আবদুলাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীর পক্ষে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা চুক্তিতে সই করেছিলেন।
চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি কমিশন গঠিত হলেও তা এখনো অকার্যকর। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন নেই। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন অকার্যকর। গঠিত হয়নি বিশেষ পুলিশ বাহিনী। জমি ফেরত পাননি ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থীরা। পুনর্বাসন করা হয়নি অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের।
জনসংহতি সমিতি বলছে, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম (উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসহ জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে সংগতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনগুলো সংশোধন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়নি। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভ‚মি ও ভ‚মি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শর্ত মোতাবেক জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমাসহ ১৭০০ জন সদস্য সরকারের কাছে অস্ত্র সংবরণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। তাদের অনেককে পুলিশের চাকরিতে নিয়োগ দেয় সরকার। এ ছাড়া যাদের পূর্বে চাকরি ছিল তাদের পুনর্বহাল করা হয়। ভারতে আশ্রয় নেওয়া উপজাতীয় শরণার্থীরা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, উপজাতীয় শরণার্থী পুনর্বাসন টাস্কফোর্স, পার্বত্য ভ‚মি কমিশন এবং তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির দীর্ঘ ২৬ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফেরেনি। আসেনি রাজনৈতিকভাবে স্থায়ী সমাধান। বন্ধ হয়নি রক্তপাত, হানাহানি। আঞ্চলিক দলের একাধিক বৈরী সশস্ত্র গ্র“পের মধ্যে প্রতিনিয়তই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। রয়ে গেছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), তাদের বিরোধীয় সংস্কারপন্থি গ্র“প জেএসএস (এমএন লারমা), ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), তাদের বিরোধীয় গ্র“প ইউপিপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ছাড়াও বর্তমানে মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টসহ (কেএনএফ) বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা বিদ্যমান রয়েছে। এসব সংগঠনের সশস্ত্র গ্র“পের মধ্যে প্রতিনিয়তই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে একাধিক গ্র“পের ক্যাডার বাহিনী। ফলে পাহাড়ে আজও বিরাজ করছে অশান্তি। এ ছাড়া বরাবরই শান্তিচুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে বাঙালিভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। সংগঠনটি পার্বত্য চুক্তির সংশোধনীর দাবিও জানাচ্ছে।
জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, আমরা এখন হয়রান হয়ে গেছি। এতটা বছর ধরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা নেই। আমরা আর কোনোভাবেই দাবি জানাব না। শুধু ধরে নেব সরকার দ্রুত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করবে।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেছেন, আমরা স্বীকার করি পার্বত্য শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্ত ও ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়ন হতে পারেনি। কিন্তু এর মূল বাধা যারা সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং চুক্তির বাস্তবায়ন দাবি করছে। তারা ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করেছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। কিন্তু তারা বুঝতে চাইছে না শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে চুক্তির উভয়পক্ষকে সমঝোতায় আসতে হবে। আমরা চাই শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন। তাই এটির চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছে। এ সরকারই শান্তিচুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আজ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, গণসমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে গণসমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনা সভার আয়োজন করেছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং জেলা আওয়ামী লীগ।