নতুন শিক্ষাক্রম বুঝতে হিমশিম শিক্ষকদের
হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষাবর্ষের শেষদিকে এসে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। চলতি বছরে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান চলছে তিনটি শ্রেণিতে। আগামী বছর আরও চারটি শ্রেণিতে চালু হবে এই শিক্ষাক্রম। পরবর্তী বছরগুলোতে অন্যান্য শ্রেণিতেও এই শিক্ষাক্রম চালু করার কথা রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান প্রক্রিয়ায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগের মতো কেবল শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সীমিত নয়। এই শিক্ষা পদ্ধতি বেশির ভাগ শিক্ষকের কাছে নতুন হওয়ায় তাদের কাছেও বিষয়টি অনুধাবন করা সময়সাপেক্ষ ও জটিল মনে হচ্ছে। এ শিক্ষাক্রম বোঝা ও পাঠদানের জন্য শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মাত্র পাঁচ দিন। অনেকে এই প্রশিক্ষণও পাননি।
এদিকে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সামষ্টিক মূল্যায়নের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। একটি সেশন অনুষ্ঠিত হবে সর্বোচ্চ ৯০ মিনিট। এর আগে বুধবার নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নভিত্তিক অ্যাপ ‘নৈপুণ্য’ উদ্বোধন করা হয়। এই অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। সামষ্টিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কেমন এবং কীভাবে করতে হবে, তার টুলস (নির্দেশিকা) ৫ নভেম্বর স্কুলে পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এতে শিক্ষাক্রমের নানান দিক বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকরা।
চলতি মাসে সামষ্টিক মূল্যায়ন নিয়ে মাউশির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমে পারদর্শিতার সূচক (পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হবে। সূচক ধরে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ চিহ্ন দেবেন শিক্ষকরা। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি করে বিষয়। সেগুলো হলো-বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। সব বিষয়েই চিহ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা।
নির্দেশিকার ‘শ্রেণি উন্নয়ন নীতিমালা’ অংশের তথ্যানুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে দুটি বিষয় বিবেচনা করা হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীর স্কুলে উপস্থিতির হার এবং দ্বিতীয়ত, বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতা। ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিতি থাকলে তাকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসাবে ধরা হবে এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা যাবে। দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ তিনটি বিষয়ের ট্রান্সক্রিপ্টে সবগুলো পারদর্শিতার নির্দেশকে কোনো শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা যদি ‘চতুর্ভুজ’ স্তরে থাকে, তবে তাকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণের জন্য বিবেচনা করা যাবে না। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমানোর পাশাপাশি হাতে-কলমে শেখা। কিন্তু বছর শেষে উলটো চিত্র দেখছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষকের কাছে মূল্যায়ন রাখায় শিক্ষার্থীদের জিম্মি হয়ে পড়ার আশঙ্কা করেছেন তারা। সন্তানের ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষকের বাসায় বাসায় ধরনা দিচ্ছেন অনেক অভিভাবক।
এদিকে শিক্ষকরা বলছেন, এখন আগের চেয়ে তাদের কাজের চাপ বেড়েছে। স্কুলে সময় দিতে হচ্ছে বেশি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নেও সময় লাগছে। শ্রেণি-কার্যক্রমের ব্যাপারটি ঠিকমতো বুঝে উঠতে সময় লাগছে। নতুন পদ্ধতিতে ব্যাবহারিক শিক্ষার পাশাপাশি তাত্ত্বিক শিক্ষার গুরুত্ব কম। এখন শিক্ষার্থীরা লিখতে গিয়ে বানান ভুল করছে। তারা আনন্দের সঙ্গে যা জানছে, তা পরবর্তীকালে মনে রাখতে পারছে না।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের শিখন যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে কতটা অগ্রসর হয়েছে, তা ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত ইত্যাদি সূচকের মাধ্যমে ট্রান্সক্রিপ্টে উল্লেখ করা হচ্ছে। এসব সূচক দেখে অভিভাবকরা বুঝতে পারছেন না যে, শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশ কোন পর্যায়ে আছে। স্কুলে তারা কী পড়ছে এবং বাসায় কী পড়াতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রকল্প বানানোর জন্য নানারকম শিক্ষা উপকরণ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এদের মাঝে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়ছেন মফস্বল ও গ্রামের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে এ বিষয়টি প্রভাব রাখবে কি না, তাও প্রশ্নের বিষয়।
অভিভাবকরা জানান, শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে খারাপ করছে, কোন বিষয়ে ভালো করছে, তা জানার ভালো উপায় নেই। নতুন নির্দেশিকা প্রকাশের পর উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে তাদের। তিন বিষয়ে চতুর্ভুজ পেলে সন্তান পরের ক্লাসে উঠতে পারবে না, এটা নিয়েই এখন তাদের বেশি উদ্বেগ। অভিভাবকদের অভিযোগ, পাশ-ফেল নেই বলে এনসিটিবি, মাউশি ও স্কুলের পক্ষ থেকে এতদিন যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। এখানে ত্রিভুজকে সবচেয়ে দক্ষ বা ভালো, বৃত্তকে মোটামুটি ভালো এবং চতুর্ভুজকে খারাপ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। সামষ্টিক মূল্যায়নের মাত্র চার দিন আগে এগুলো জানানো হচ্ছে।
এছাড়া স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের নিজেদের হাতে তৈরি করার জন্য কিছু প্রকল্প দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা পরিবারের কাউকে দিয়ে কিংবা অন্য কোথাও থেকে করিয়ে আনছে প্রকল্পটি। এতে শিক্ষার্থীর শেখার কাজ হচ্ছে না। একক প্রকল্পের মতো নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে দলগত প্রকল্পের কাজ। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়ার ফলে দলগত কাজের ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় পড়তে হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষকদের কয়েকদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই নতুন শিক্ষাক্রম চালানো সম্ভব নয়। তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। না হয় সৃজনশীল পদ্ধতির মতো মুখ থুবড়ে পড়বে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যে কেউ চাইলে এই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। নতুন বছরে শিক্ষকদের এক সপ্তাহ বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়ে অভিভাবকদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, যে টুলস শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে, তাতে খুব স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। একজন শিক্ষার্থীকে চাইলেই চতুর্ভুজ দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েকটি সূচকের মাত্রা মিলিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। মূল্যায়ন অ্যাপে শিক্ষকদের এদিক-সেদিক করার সুযোগ নেই। তাই অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের চিন্তা না করাই ভালো।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, নতুন এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ফলাফল খারাপ করলে সব দায়ভার শিক্ষকদের। তাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানে সক্ষম না হন তাহলে সেখানে নতুন শিক্ষক দেওয়া হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ধীরে ধীরে আরও বাড়ানো হবে। বর্তমান শিক্ষাক্রম পদ্ধতিটা সহজ। এটার চ্যালেঞ্জ অন্যরকম। এটা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ফলাফলনির্ভর মানসিকতা দূর করবে। আগে কোনো শিক্ষার্থী ফেল করলে তাকে স্কুল থেকে বের করে দিত, এখন সেটি করবে না। ১৪ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের স্কুলে রাখতেই হবে। ফেল করেছে বলে এখন কোনো শিক্ষার্থীকে হেয় করতে পারবে না বলে জানান তিনি।
‘নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা’ : লেখক ও গবেষক এবং শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রায় বলেছেন, নতুন প্রণীত শিক্ষা কারিকুলাম শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন আয়োজিত নতুন কারিকুলাম বাতিল ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পদ্ধতি বন্ধ করা হয়েছে। পরীক্ষা ছাড়া প্রকৃত শিক্ষা হবে না। এ শিক্ষাব্যবস্থায় বাচ্চারা নষ্ট হয়ে যাবে। ইংরেজি বই দেখলে চোখে পানি আসে। বইয়ের ভেতর কিছুই নেই। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইগুলোতে বয়ঃসন্ধিকালে কী কী পরিবর্তন হয়, মাসিক, পিরিয়ডের কথা লেখা রয়েছে। এগুলো কখনো বই দেখে শিখতে হয় না।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা নতুন কারিকুলাম সম্পূর্ণ বাতিল ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালুসহ ৮ দফা দাবি জানিয়ে বলেন, ত্রিভুজ চিহ্ন বাতিল করে আগের মতো নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি করা হোক। নতুন এই কারিকুলামটি এ দেশের জন্য অনুপযুক্ত। এটি সংস্কার করে অন্তত ৫০-৬০ নম্বরে দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু এবং নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন করা হোক।