
প্রিন্ট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৯ এএম
ভুয়া দাতা-গ্রহীতা সাজিয়ে ৮ কোটি টাকার জমি দখল!

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জমির দাতা, গ্রহীতা, দলিল লেখক বা মুসাবিদাকারক-সবই ভুয়া। এমনকি সাক্ষীও ভুয়া। অস্তিত্বহীন ও কাল্পনিক ব্যক্তিদের দ্বারা উপস্থাপন করা দলিল চট্টগ্রাম সদর সাবরেজিস্ট্রার রেজিস্ট্রি করেছেন। হাটহাজারী এসি ল্যান্ডের স্বাক্ষরে নামজারি খতিয়ানও সৃজন করা হয়েছে। এভাবে চিহ্নিত তিন ভূমিদস্যু রেমিট্যান্সযোদ্ধার ১৭ শতক জমি হাতিয়ে নিয়েছে। বায়েজিদ বোস্তামী থানার জালালাবাদ মৌজায় মোহাম্মদ আনোয়ারের ৮ কোটি টাকার জমি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভুয়া দলিলে জমির মালিক বনে যাওয়া তিনজন হলেন মো. মুছা, পারভেজ মাসুদুর রহমান ও আবু তালেব।
জমি হস্তান্তরের খবর শুনে জমির মালিক আনোয়ার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। তাকে আমমোক্তারদাতা সাজিয়ে তার জমি বেচাবিক্রি হয়ে গেছে। ভিন্ন দলিলে আরও ৫ শতকসহ ২২ শতক জমি হারিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ। তিন ব্যক্তি এতই ক্ষমতাশালী যে, সাফ কবালা দলিল সম্পাদনের মাত্র ১০ কর্মদিবসে নামজারি খতিয়ান সৃজন করা হয়েছে। অবিশ্বাস্য গতিতে ফাইল চলেছে। এ জালজালিয়াতির ঘটনায় আনোয়ারের পক্ষে তার বোন শামসুন্নাহার মামলা করেছেন। পিবিআই মামলা তদন্ত করে আলোচ্য জমির আমমোক্তার দাতা ও গ্রহীতা যে ভুয়া, তা প্রমাণসহ প্রতিবেদন দিয়েছে।
প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, আমমোক্তার দাতা হিসাবে মো. আনোয়ার নামে যার এনআইডি দেওয়া হয়েছে, সেই এনআইডি নম্বরের ব্যক্তি জমির মালিক আনোয়ার নন। একইভাবে গ্রহীতা হিসাবে এসএম হাবিবুল ইসলাম নামে যে ব্যক্তির এনআইডি জমা দেওয়া হয়েছে, সেই এনআইডির ব্যক্তিও হাবিবুল ইসলাম নন। তার প্রদত্ত টিআইন নম্বরটিও ভুয়া। আমমোক্তারনামা দলিলের লেখক বা মুসাবিদাকারক হিসাবে মোহাম্মদ রুবেল নামে এক আইনজীবীর নাম দেওয়া হয়েছে। সেই আইনজীবীও বলছেন, তিনি ওই দলিল লেখেননি। তার স্বাক্ষর জাল। মামলা তদন্ত করে ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি পিবিআই পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনের পর প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া পারভেজ কারাগারে যান। একজন জামিন নিলেও অন্যজন আত্মগোপনে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জমির মালিক আনোয়ারের বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার নাঙ্গলমোড়া এলাকায়। তার বাবা হাজি মোখলেছুর রহমান। ২০১৭ সালের ২৪ জুন সংযুক্ত আরব আমিরাতে (দুবাই) আনোয়ার যান। তার কোনো এনআইডি নেই। বায়েজিদ বোস্তামী থানার জালালাবাদ মৌজায় তার নামে ৩৯ শতক জমি রয়েছে। এ খতিয়ান থেকে ২২ শতক জমি জালজালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া দাতা-গ্রহীতা সাজিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়।
শামসুন নাহার যুগান্তরকে বলেন, ভুয়া আমমোক্তার সৃজনের অভিযোগে আদালতে মামলা করেছি। মামলায় পিবিআই তদন্ত করে আমমোক্তার দাতা ও গ্রহীতার কোনো অস্তিত্ব পাননি। একইভাবে হাটহাজারী ভূমি অফিসে খতিয়ান বাতিলের আবেদন করেছি। আবেদনের সাত মাস পরও সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ বিষয়ে আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেননি। তবে প্রতারণা ও জালিয়াতি প্রমাণ হওয়ায় পারভেজ নামে এক ভূমিদস্যু কারাগারে যান। শামসুন নাহার আরও বলেন, এখনো মূল মালিকের নামে গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ লাইন রয়েছে। বিলও আসে। জমি তারা দখলে রেখেছে। অস্তিত্বহীন ও কাল্পনিক ব্যক্তির কাছ থেকে কীভাবে জমি কিনলেন জানতে চাইলে তিন দখলদারের একজন মোহাম্মদ মুছা যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। এ জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আইনজীবী রুবেল জানান, তার নাম বসিয়ে জাল স্বাক্ষর করা হয়েছে। এ বিষয়ে পিবিআইকে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। একইভাবে দলিলে সাক্ষী হিসাবে সেলিম নামে একজনের নাম দেওয়া হয়েছে। সেই সেলিম অস্তিত্বহীন।
হাইকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাশেদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো দলিলের ভিত্তিতে নামজারি করার আগে দাতা ও গ্রহীতাকে নোটিশ দিতে হয়। তিনি বলেন, উচ্চপর্যায়ে কোনো তদবির থাকলেও নামজারি খতিয়ান সৃজনে ন্যূনতম এক থেকে দুই মাস সময় লাগত। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র ১০ কার্যদিবসে সম্পন্ন হয়ে যায়। এভাবে একজন রেমিট্যান্সযোদ্ধার জমি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই না করে রেজিস্ট্রি করার জন্য সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রার যেমন দায়ী, তেমনই সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে তড়িঘড়ি করে নামজারি খতিয়ান সৃজনের জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ড। তিনি বলেন, ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে ত্রুটিপূর্ণভাবে সৃজিত নামজারি খতিয়ান রিভিউর মাধ্যমে বাতিলের সুযোগ রয়েছে।