চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে অর্ধশত পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ
দেরিতে হাসপাতালে যাওয়া ও অসচেতনতার কারণে বাড়ছে মৃত্যু
এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অর্ধশত শিশু-কিশোর ও যুবক-নারীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শিশু-কিশোর ২৬ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী তিনজন। এসব মৃত্যুতে কেউ হারিয়েছেন আপনজন, কেউ হয়েছেন সন্তান হারা। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুতে কেউ কেউ অথৈ সাগরে ভাসছেন।
মারা যাওয়াদের মধ্যে অছে ৬ মাস বয়সি রুবেল, ৭ মাস বয়সি লাবিব, ১০ মাস বয়সি আরিয়ান, ২ বছর ৬ দিনের আবদুল্লাহ আতাহার আহমেদ, সাড়ে ৩ বছরের ফাতেমা আক্তার, ১১ বছরের শ্রাবন্তী সরকার, ১৮ বছরের সরফুদ্দিন চৌধুরী সজিব, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আফনান নাছির বর্ষা ও ৩২ বছরের পুলিশ সদস্য এমাদুল হোসেন। চট্টগ্রামে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপরও মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না। দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ৩০ আগস্ট ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আফনান নাছির বর্ষা। তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না পরিবার। তার ছোট ভাই আদনানও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে বর্ষার অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। পরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া পর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় বর্ষা। বর্ষা পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা ইউনিয়নের বিনানিহারা গ্রামের নাছির উদ্দিনের মেয়ে। বড় মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল নাছির উদ্দিনের। সেই স্বপ্ন এখন পরিণত হয়েছে চোখের জলে। এর আগে ৪ জুলাই শ্রাবন্তী সরকার নামে ১১ বছর বয়সি এক শিশুর মৃত্যু চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর ভয়াবহতার জানান দেয়। আক্রান্তের চার দিনের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শ্রাবন্তী। সে নগরীর সেন্ট স্কলাসটিকা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মেয়ের লাশ সৎকার শেষে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকেও ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এই খবর সামাজিক মাধ্যমসহ ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।
১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যায় সাড়ে তিন বছরের ফাতেমা আক্তার। বাহরাইন প্রবাসী সোলায়মান ও শাহনাজ দম্পতির একমাত্র মেয়ে ছিল ফাতেমা। তাদের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা হাসপাতাল থেকে ফাতেমাকে রেফার করা হয়েছিল চমেক হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত ফাতেমাকে বাঁচানো যায়নি। মৃত্যুর পর থেকে এখনো তার খেলনা ও জামা-কাপড়ে একমাত্র কলিজার টুকরোর স্পর্শ খোঁজেন এই বাবা-মা। কেবল ফাতেমা নয়, এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না আড়াই বছরের মরিয়ম জান্নাত, ১০ মাসের রাজশ্রী ধর, দেড় বছরের মেহেরিম আক্তারসহ ১০ মাসের মো. আরিয়ানের বাবা-মাও। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদনে এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ১০ মাসের শিশু আরিয়ানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। আরিয়ান চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মো. পারভেজের ছেলে। বুধবার রাতে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। সন্তান হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে যাওয়া মো. পারভেজ বলেন, ‘১৭ সেপ্টেম্বর চমেক হাসপাতালে নেওয়ার পর জানতে পারি আমার সন্তান ডেঙ্গু আক্রান্ত। এরপর থেকে চিকিৎসকরা যা বলেছেন, তাই করেছি। কিন্তু আমার ১০ মাসের সন্তানকে এভাবে হারাতে হবে তা কল্পনাও করিনি।’
চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত, রোগ নিয়ে অবহেলা, দেরিতে হাসপাতালে যাওয়া ও অসচেতনতার কারণে নারী-শিশুর মৃত্যুহার বেশি বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। সব বয়সি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও নারী ও শিশুরা আক্রান্ত হয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছেন। এ ছাড়া আগে থেকে অন্যান্য রোগে যারা ভুগছেন, তাদের ডেঙ্গু জেঁকে ধরছে। অন্যদিকে যারা দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের শারীরিক অবস্থাও খারাপ হচ্ছে বেশি।
শুক্রবার সকাল ৮টার পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে নতুন করে আরও ১২১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৫৩৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৩৭০ জন। বাকিরা সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন।