ডেঙ্গুর কারখানা থানা কম্পাউন্ড
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছে সব বয়সি ও শ্রেণিপেশার মানুষ। বাদ যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরাও। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) দুজন সদস্য ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে পাণ হারিয়েছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন ডিএমপির ২৭৪ জন সদস্য। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কেবল কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালেই ভর্তি আছেন ১৪৪ জন পুলিশ সদস্য। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে।
এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে ডিএমপি সদর দপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) কার্যালয় থেকে দফায় দফায় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ডিএমপির সব স্থাপনায় পরিচ্ছন্ন অভিযান চালাতে হবে। সকাল-সন্ধ্যায় স্থাপনাগুলোতে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। সচেতনতা তৈরিতে ফোর্সদের নিয়মিত ব্রিফিং হচ্ছে। সরবরাহ করা হয়েছে অটোমাস ক্রিম। কিন্তু কোনো উদ্যোগই যেন কাজে আসছে না। এখনো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানা কম্পাউন্ড। এসব কম্পাউন্ড যেন ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশার বংশবৃদ্ধির নিরাপদ স্থান। কোনো কোনো জায়গায় সিটি করপোরেশনের তৎপরতা থাকলেও কোথাও কোথাও একেবারেই নেই। যুগান্তরের পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টা। গুলশান থানার সামনের ৮৯ নম্বর সড়কের দুই পাশে চোখে পড়ে নয়টি পুরোনো প্রাইভেটকার। এগুলো সবই জব্দ করা আলামত। সরেজমিন দেখা যায়, এসব গাড়ি একেকটা যেন মশা প্রজননের উৎকৃষ্ট স্থান। একেকটি গাড়ি যেন একেকটি ডাস্টবিন। গাড়ির ভেতরে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। কোনো কোনো গাড়িতে জমে আছে পানি। এসব পানিতে মশা-মাছিসহ ঘুরছে পোকা মাকড়। আরও দেখা যায়, ৮৯ সড়কের পাশেই একটি খালি প্লট। ওই প্লটে চোখ পড়তেই দেখা গেল শতাধিক গাড়ি এবং মোটরসাইকেল স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এগুলোও আলামতের গাড়ি বলে জানা যায়। প্রত্যেকটি জব্দ করা আলামত ঘিরেই ভন ভন করে উড়ছিল মশা-মাছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার ওসি বিএম ফরমান আলী সব ঠিকঠাক আছে বলে মন্তব্য করে যুগান্তরকে বলেন, আমার থানা এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। ডিএমপি সদর দপ্তর এবং ডিসি অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ডেঙ্গু সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। থানার চারপাশ পরিষ্কার রাখছি। কোথাও যাতে ডেঙ্গু মশার লার্ভার সৃষ্টি হতে না পারে সে বিষয়ে খেয়াল রাখছি। জব্দ করা আলামতের গাড়ি পরিচ্ছন্ন করেছি।
থানার সামনে ৮৯ নম্বর সড়কে এবং খালি প্লটে যেসব আলামতের গাড়ি রাখা আছে, সেগুলো খুবই অপরিচ্ছন্ন। মশা-মাছির নিরাপদ স্থান বলে সরেজমিন দেখা গেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী-জানাতে চাইলে ওসি বলেন, ওই গাড়িগুলো পুরোনো। তাই চেহেরাই অপরিচ্ছন্ন। বৃষ্টি হলেও ওইসব গাড়িতে পানি জমছে না।
বিকাল ৩টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানা এবং সহকারী পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় কম্পাউন্ডে গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। এ কারণে তৈরি হয়েছে নোংরা পরিবেশ। গরুর মল-মূত্রকে ঘিরে চোখে পড়ে মশার উপদ্রব। ময়লা পানি জমে থাকলেও তা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। তবে গরুর মূত্রের ওপর একজাতীয় পাউডার দিয়ে রাখা। চোখে পড়ে, একজন লোক গরুটিকে খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি নিজের নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেন, এই গরুটি (ষাঁড়) গত কুরবানির ঈদে এক লাখ ৮০ হাজার টাকায় কেনা। আগামী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে এটি জবাই করা হবে। এ কারণে এটি এখানে লালন-পালন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাযহারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু এবং মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই ব্যর্থ হয়েছে। আমার থানা কম্পাউন্ডে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনে কোনো টিম আসছে না। তবে নিজস্ব উদ্যোগে আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করছি।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে কলাবাগান থানায় গিয়ে চারপাশ তুলনামূলক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাওয়া যায়। ৮ তলাবিশিষ্ট ওই ভবনের নিচে অনেক গাড়ি চোখে পড়ে। সেখানে মশার বংশবৃদ্ধি সংক্রান্ত অনুকূল পরিবেশ চোখে পড়েনি। কলাবাগান থানার ওসি সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। কোথাও পানি জমতে দিচ্ছি না। এডিস মশার লার্ভা তৈরি হয় এমন কোনো স্থান থানা কম্পাউন্ডের ভেতর নেই। থানা ও এর চার পাশে নিয়মিত স্প্রে করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের লোকজন এখানে খুব কম আসে। মাঝেমধ্যে এসে ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করে। ওসি আরও বলেন, কোথাও ময়লা আবর্জনা আছে কিনা তা দেখতে আমি নিজে অফিস এবং ব্যারাক পরিদর্শন করি। এখনো এই থানায় কর্মরত কোনো পুলিশ সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মফিজুল আলম বলেন, যে কোনো মহামারির সময়ই থানায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্দেশনা আসে। করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষণে ক্ষণে নির্দেশনা আসত। সাম্প্রতিক ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে থানা আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মশক নিধনের ওষুধ ছিটানোসহ নানা নির্দেশনা এসেছে। আমরা সে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। এছাড়া সিটি করপোরেশন থেকে লোকজন এসে মাঝে মধ্যেই স্প্রে করে যাচ্ছে।
পল্লবী থানার ওসি মাহফুজুর রহমান মিয়া যুগান্তরকে বলেন, থানা ফাঁড়ির কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা পেয়েছি। তিনি বলেন, থানা-ফাঁড়ির বড় সমস্যা হলো জব্দকৃত আলামত। এসব আলামতে বৃষ্টির পানি জমে থাকার আশঙ্কা সব সময়ই থাকে। তাই সবসময় এগুলো পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলমান। ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্য সচেতন হতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসায় অবহেলা না করে দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের জন্য ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে গায়ে মাখার ক্রিম সরবরাহ করা হয়েছে। ওই ক্রিম ব্যবহার করলে মশা কামড়ায় না। পল্লবী থানার আশপাশে সিটি করপোরেশন কর্মচারীদের তৎপরতা নেই বলে ওসি জানান।