প্রতিরোধ ব্যবস্থা দরকার দুর্যোগ আসার আগেই
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুগান্তর কার্যালয়ে মঙ্গলবার ‘সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ : নগর দুর্যোগ মোকাবিলা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অতিথি ও আলোচকরা -যুগান্তর
‘অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতা জরুরি। যে কোনো দুর্যোগের পর কার্যক্রম পরিচালনার চেয়ে দুর্যোগ আসার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাহলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। সেই সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে সচেতনতা, আবাসিক ভবনে মিশ্র ব্যবহারে সচেতনতা এবং আইন ও বিধিমালা মেনে চলার বিষয়ে সব পক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে।’ মঙ্গলবার বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (বিডিআরসিএস) জলবায়ু ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (ডিসিআরএম) বিভাগের ডিজি ইকো পাইলট প্রোগ্রাম্যাটিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আয়োজনে ‘সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ : নগর দুর্যোগ মোকাবিলা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ কথা বলেন। এতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে ডিজি ইকোর আর্থিক ও পিপিপি প্রকল্প, আইএফআরসি, জার্মান রেড ক্রস, ড্যানিশ রেড ক্রস এবং সুইডিশ রেড ক্রস। রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে দৈনিক যুগান্তর কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়। এতে সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিল যুগান্তর।
গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উপমহাসচিব সুলতান আহমেদ। প্রধান অতিথি ছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (রুটিন দায়িত্ব) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক ফিরোজ উদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. দিলারা জাহিদ।
দৈনিক যুগান্তরের সিটি এডিটর মিজান মালিকের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় আরও অংশ নেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহর নঈম ওয়ারা, যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান আসিফ রশীদ, চিফ রিপোর্টার মাসুদ করিম, ডিসিআরএম’র পরিচালক এমএ হালিম, জিআরসি’র সিনিয়র রিপ্রেজেনটেটিভ গৌরভ রায়, আইএফআরসি’র সিনিয়র ম্যানেজার (প্রোগ্রাম সাপোর্ট) রাকিবুল আলম, ঢাকা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক দিন মনি শর্মা, ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং কমপ্লেক্সের অ্যাডজুটেন্ট মো. মামুন, যুগান্তরের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আবুল খায়ের চৌধুরী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ইয়ুথ অ্যান্ড ভলান্টিয়ার ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রাম অফিসার মরিয়ম বিবি রশ্নি, বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মিনার হোসেন, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শফিকুল ইসলাম, আরবান স্বেচ্ছাসেবক মো. সোহেল প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পিপিপি প্রকল্পের কমিউনিকেশন অ্যান্ড রিপোর্ট অফিসার শামিউল ইসলাম শোভন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতার বিকল্প নেই। প্রতিটি ব্যক্তির সচেতনতা দরকার। ফায়ার সার্ভিস একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো দুর্যোগে সবার আগে যায়। তবে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের ব্যাপক ভূমিকা দরকার। সেই সঙ্গে অন্য সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রতিটি উপজেলা এবং বাজার এলাকায় ফায়ার স্টেশন করা হবে। দেশের ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা এখন ২৪ তলা পর্যন্ত আগুন নেভাতে কাজ করতে সক্ষম। সেই সঙ্গে রোবটিক যন্ত্রপাতি আনার প্রয়োজন রয়েছে।’
সুলতান আহমেদ বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো দুর্ঘটনায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রিভেনশন মডিউল দরকার। সেটি শুধু আগুন নয়, যে কোনো দুর্যোগই এর মধ্যে যুক্ত থাকবে। আমাদের রেড ক্রিসেন্টের সাত লাখ ভলান্টিয়ার আছে। এ রকম সব সংস্থার ভলান্টিয়ারদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের মডিউল তৈরি করতে হবে।’
ফিরোজ উদ্দিন বলেন, ‘দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজাস্টার কাউন্সিল কাজ করছে। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রী এবং দুর্যোগ সচিবের নেতৃত্বেও আলাদা কমিটি আছে। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিও সব বিপদে পাশে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘যুগান্তর দুর্যোগ বিষয়ে সব সময়ই সচেতন থাকে।’
আসিফ রশীদ বলেন, ‘মানুষ সচেতন হলে অনেক দুর্ঘটনাই প্রতিরোধ সম্ভব। এজন্য সমন্বিত সচেতন কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার।’
মাসুদ করিম বলেন, ‘আমরা যুগান্তরের মাধ্যমে শুধু অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনার নিউজ কাভার করেই দায়িত্ব শেষ করি না। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরে সচেতনতা বাড়ানোর কাজটাও করে থাকি।’
ড. দিলারা জাহিদ বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডসংক্রান্ত কী কী দুর্যোগ হতে পারে সে সম্পর্কে গবেষণা দরকার। নতুন নতুন যেসব বিষয় আছে, সেসব জানা দরকার।’
এমএ হালিম বলেন, ‘অপরিকল্পিত স্থাপনা, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে দিন দিন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু বছরের পর বছর সিলিন্ডারের ত্রুটি পরীক্ষা করা হয় না। এ কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে।’
গওহর নঈম ওয়ারা বলেন, ‘ঢাকা শহরের সব বিল্ডিং বোমার ওপর বসে আছে। একটি (গ্যাস সিলিন্ডার) বিস্ফোরণ হলে পুরো এলাকা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।’
মিজান মালিক বলেন, ‘যে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি করা হয়। এই কমিটিগুলো কী সুপারিশ দেয়, তা জনসম্মুখে উপস্থাপন করা হয় না।’ তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শুধু ভবন মালিককে গ্রেফতার না করে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ দিন মনি শর্মা বলেন, ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-কে যদি আরও বেশি সুবিধা দেওয়া হয়, তা হলে মনে হয় দুর্ঘটনার খবর পাওয়া সহজ হবে।’
মো. মামুন বলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্যে আমরা প্রবেশ করেছি। তাই আগুনের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর দেশে ২৪ হাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল এবং টানেলের মতো বিষয় মানুষের জীবনে চলে এসেছে। তা হলে এখন ভাবতে হবে করণীয় কী?’ গৌরভ রায় বলেন, ‘আমরা অনেক বাড়িতে যাই। ৫-৬ ঘণ্টা কাটাই। খাওয়া-দাওয়া করি। কিন্তু জানি না যে ওই বাড়ি কতটা ঝুঁকিতে আছে।’
আদিল মোহাম্মদ বলেন, ‘নগর দুর্যোগে অগ্নিকাণ্ড আমাদের বড় সমস্যা। এ সমস্যা শুধু ঢাকায়ই নয়, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে বিদ্যমান। এমনকি গ্রাম এলাকাতেও অগ্নিঝুঁকি আছে। আগুন যে কোনো জায়গায় যে কোনো মুহূর্তে লাগতে পারে।’
মরিয়ম বিবি রশ্নি বলেন, ‘ভিকটিমদের সেবা দেওয়ার সময় স্বেচ্ছাসেবী ও ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। কোনো আগুনের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয় না।’
রাকিবুল আলম বলেন, ‘অগ্নিদুর্ঘটনার ব্যাপারে ডিজিটাল প্রচারণা বাড়াতে হবে। ভিডিও কন্টেন, ফেসবুক পোস্টসহ ডিজিটাল মাধ্যমে নানাভাবে কাজ করা যেতে পারে।’ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিমতলীতে আমাদের একটি দোকান ছিল। সেদিনের আগুনে তার ছোট ভাই মারা গেছে। দুজন মেয়ে কাস্টমার ছিল, তারাও মারা গেছে। ছোট ভাইয়ের দুটি বাচ্চা রয়েছে। তারা সরকারি তেমন কোনো সহযোগিতা পায়নি।’ মো. সোহেল বলেন, ‘নিমতলী আগুনের শুরু থেকেই আমি ছিলাম। কেমিক্যালের কারণে মানুষ আগুনের ধারেকাছেও যেতে পারছিল না। মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যায়।’