সবই চিকিৎসকদের সুরক্ষায়, নজর নেই রোগীদের প্রতি
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নিজেদের সুরক্ষা ও দাবি আদায়ে চিকিৎসকদের প্রায় অর্ধশত সংগঠন বা সোসাইটি সক্রিয়। নিরাপদ কর্মস্থল ও দাবি পূরণের অজুহাতে তারা কর্মবিরতি পর্যন্ত পালন করেন। ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারে কিছু আইন ছাড়া নির্দিষ্ট ও একক কোনো আইন নেই। রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে দুটি নামকাওয়াস্তে সংগঠন রয়েছে। এছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগও নেই।
বিভিন্ন সময় চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসা নিয়ে বাদানুবাদ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালে নবজাতকের মৃত্যুর পর প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। অভিযোগ-ভুল চিকিৎসা, দায়িত্বে অবহেলা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণার কারণে এমন ঘটেছে। তবে এ ঘটনায় চিকিৎসক, হাসপাতাল ও রোগীর স্বজনরা পরস্পরের দিকে অভিযোগের তির ছুড়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন-এসব ঘটনায় চিকিৎসক, হাসপাতাল ও রোগী-সব পক্ষ নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছে। ১ মার্চ এক চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে খুলনা জেলা ও মহানগরীর সব হাসপাতালের চিকিৎসকরা টানা চার দিন কর্মবিরতি পালন করেন। দাবি আদায়ে গত সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকরা অনুপস্থিত ছিলেন। এসব কারণে বিভিন্ন সময় চিকিৎসাবঞ্চিত হয়ে রোগী ও স্বজনদের নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
জানা যায়, দেশে চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), বাংলাদেশ ন্যাশনাল চিকিৎসক পরিষদ, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্র্যাক্টিশনার্স অ্যাসোসিয়েশন, প্রাইভেট পোস্টগ্যাজেুয়েট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন, প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন, স্বাধীনতা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পরিষদ (স্বাহোচিপ), বাংলাদেশ গ্র্যাজুয়েট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পরিষদ, হোমিওপ্যাথিক ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল অফিসার অ্যাসোসিয়েশন, স্বাধীনতা দেশজ চিকিৎসক পরিষদ, ইউনানি আয়ুর্বের্দিক ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ রয়েছে।
রোগভিত্তিক চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি, মেডিসিন সোসাইটি ও অর্থপেডিকস সোসাইটি। এর বাইরে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। ফিজিওথেরাপিস্ট, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ হাসপাতালে কর্মরত তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদেরও সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠন নিজেদের অধিকার আদায়ে নানা সময়ে নৈতিক-অনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে থাকে। অপরদিকে রোগীদের পক্ষে ‘স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন’ এবং ‘নিরাপদ চিকিৎসা চাই’ ব্যানারে দুটি সামাজিক সংগঠন থাকলেও তেমন কার্যকর নয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই-মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ঘাটতি আছে। নতুন করে পরিকল্পনা না করা গেলে এটি পূরণ হবে না। বিরূপ পরিস্থিতি উত্তরণও সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসাক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের অবহেলা রোগী মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই রাষ্ট্র যতক্ষণ উদ্যোগী না হয়ে কাজ করবে, ততক্ষণ এ সমস্যা চলতে থাকবে।
এদিকে, বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দাবি করেন, বিএমএ চিকিৎসকদের পাশাপাশি রোগীদের সুরক্ষা নিয়েও ভাবে। এজন্য বিএমএসহ চিকিৎসকদের সব সংগঠন এ সংক্রান্ত আইন পাশের কথা বলে আসছে। আইনটি শুধু চিকিৎসক সুরক্ষা নয়, বরং স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন হবে। সেখানে চিকিৎসক, রোগী ও হাসপাতাল সবই সুরক্ষা পাবে। এটি পাশ হলে এবং আইনের প্রয়োগ হলে সবাইকে জবাবদিহির মধ্যে থাকতে হবে। বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল আরও বলেন, বিভিন্ন সময় যে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, সেজন্য সবাই কমবেশি দায়ী। এসব কারণে রোগীরা আস্থাহীন হচ্ছে, অনেকে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নজর নেই। ৯ বছর ধরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে কথা হলেও পাশ হচ্ছে না। এ দায় মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।
ভুল চিকিৎসা অথবা চিকিৎসায় অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বা অপূরণীয় ক্ষতির শিকার একাধিক ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলসহ (বিএমডিসি) বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। বিএমডিসিতে ৮৮ শতাংশ অভিযোগ পড়ে আছে। বিএমডিসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৩ বছরে সংস্থাটিতে ২৬৮টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি ঘটনার নিষ্পত্তি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ৫০ চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট যাচাই চলছে, আর ২৮টি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। সম্প্রতি অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে দুই চিকিৎসককে চিঠি দিলেও উত্তর মেলেনি। অভিযোগের প্রমাণ মিললেও শাস্তি হচ্ছে হাতেগোনা কয়েকজনের। ১৩ বছরে একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল এবং ১২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
‘নিরাপদ চিকিৎসা চাই’ আন্দোলনের মহাসচিব উম্মে সালমা যুগান্তরকে বলেন, দেশে অসংখ্য ভুয়া চিকিৎসক ছাড়াও বিএমডিসি লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ অসংখ্য চিকিৎসক নির্বঘ্নে কাজ করছেন। অনেক হাসপাতালের নিবন্ধন নেই বা নবায়ন হয়নি। কিন্তু নজরদারি হচ্ছে না। যখন ঘটনা ঘটে, তখন আলোচনা হয়। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, আইনের কিছু ক্রুটির কারণে এমন হচ্ছে। এজন্য রোগী সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন জরুরি।