উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন সাড়ে ১৪ লাখ
মান না থাকায় কিছু প্রতিষ্ঠানে ভর্তিযুদ্ধ
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
উচ্চশিক্ষা স্তরে পর্যাপ্ত আসন আছে। লেখাপড়া করার জন্য শিক্ষার্থীও আছে। তবু প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকে আবার শিক্ষা বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন। কেউবা উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। আর একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে প্রবেশ করেন কর্মজীবনে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তাতে আসন সংকটের কারণেই এমনটি ঘটছে। বিশেষ করে কম খরচের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। অন্যদিকে নিজের অর্থে পড়ার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বেশির ভাগের ওপর আস্থা নেই শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের। এ অবস্থায় মানসম্মত গ্রাজুয়েট তৈরির লক্ষ্যে যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মান উন্নয়ন এবং উপযুক্ত তদারকির মাধ্যমে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি সদস্য এবং কুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, কোনো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর কাছে আকর্ষণীয় করে তার গুডউইল বা ইতিবাচক ভাবমূর্তি। প্রাজ্ঞ ও সুনামধারী শিক্ষক, শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণা, আবাসিক হল ও খাবারের মান, চাকরির বাজারে বা বহির্বিশ্বে ওই প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদির সমষ্টির নামই হচ্ছে ভাবমূর্তি বা সুনাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে খুবই কম সেই সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। ভাবমূর্তির অভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় নয় অনেক প্রতিষ্ঠান। তবে এই সুনাম যেসব প্রতিষ্ঠানের আছে কেবল সেগুলোতেই ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীরা প্রাণান্ত চেষ্টা করে।
তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে থাকে সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ঢাকার বাইরে ও নতুন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সেই জায়গা তৈরি করতে পারেনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের বেশির ভাগের আস্থার ঘাটতি আছে। তাই পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী থাকার পরও আসন যেমন খালি থাকে, তেমনি কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য রীতিমতো লড়াইয়ে নামছে। তাই শিক্ষার মান নিশ্চিতে যেসব দিক জরুরি সেগুলোর সঙ্গে কিছুতেই আপস করা যাবে না। পর্যাপ্ত না হলেও সরকার বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে। এখন দরকার বাজার ও বৈশ্বিক চাহিদা সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ খোলা। উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম-দুর্নীতি একটি প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি পিছিয়ে দেয়। সেগুলো বন্ধ করা। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এনে অলাভজনক ও সেবার মানসিকতায় পরিচালনায় বাধ্য করা। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামের স্বীকৃতি (অ্যাক্রেডিটেশন) ও রেটিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। এটা করতে পারলে স্বয়ংক্রিয় প্রতিযোগিতার কারণে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়বে। তখন আর শুধু কিছু প্রতিষ্ঠানের দিকে শিক্ষার্থীদের নজর থাকবে না।
দেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার মতো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে আসন আছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ।
এর মধ্যে সাধারণত বুয়েট, মেডিকেল, বড় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সাকুল্যে ৯০ হাজারের মতো আসনের প্রতি ভর্তিচ্ছুদের চোখ থাকে। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির শর্ত অনুযায়ী সাধারণত জিপিএ ৩ দশমিক ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ পায়। এবারে (২০২২ সালে) এইচএসসি ও সমমান পাশ করেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন। তাদের মধ্যে ভর্তির শর্তপূরণ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা সোয়া আট লাখের বেশি। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। আর জিপিএ-৫ এর নিচে ৩.৫ এর মধ্যে শিক্ষার্থী আছে ছয় লাখ ৬০ হাজার ২১০ জন। উল্লিখিত ৯০ হাজার আসনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এই সোয়া আট লাখ শিক্ষার্থী। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলমান ভর্তিযুদ্ধে লড়াইটা হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীর মধ্যেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানে কেবল জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীই চান্স পায় না। লিখিত পরীক্ষায় ভালো করে মধ্যম মানের বা জিপিএ ৩ দশমিক ৫ পর্যন্ত গ্রেডধারী শিক্ষার্থীদের অনেকেও ভর্তি নিশ্চিত করে ফেলে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, জিপিএ-৫ পেয়েও অনেকেই ভর্তি হতে পারছেন না কাঙ্ক্ষিত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত প্রতিযোগিতা করে হলেও ভর্তি হতে চায় সেগুলো ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা মাদ্রাসা হিসেবে চিহ্নিত। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই আসে সরকারি ও বিদেশি সংস্থা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাত কলেজ এবং হাতেগোনা বড় ও পুরোনো আলিয়া মাদ্রাসার নাম। এ ছাড়া নার্সিংসহ কিছু প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে আসন আছে সাড়ে ১৪ লাখের মতো।
অন্যদিকে গত বছর (২০২১ সালে) উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উল্লিখিত বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে সর্বসাকুল্যে ৯ লাখ। এটা পাশ করা শিক্ষার্থীর হিসাবে প্রায় ৬৫ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে, এইচএসসি পাশের পর অন্তত ৩০ শতাংশ কর্মজীবনে ভিড়ে যান। বাকি ৫ শতাংশের অনেকে বিদেশে পাড়ি জমান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় দিক হচ্ছে, ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির পরও অন্তত সাড়ে সাত লাখ আসন খালি থাকে।