আউটসোর্সিংয়ের নামে সারা দেশে অরাজকতা
কায়েস আহমেদ সেলিম
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আউটসোর্সিং নিয়ে এক শ্রেণির ঠিকাদার রীতিমতো দোকান খুলে বসেছেন। তারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিব্যি অপকর্ম করে চলেছেন বছরের পর বছর। তাদের সঙ্গে অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েছেন এসব অপকর্মের সহযোগী হিসাবে। বিনিময়ে তারাও পাচ্ছেন অবৈধ টাকার ভাগ। সরকার নির্ধারিত ৫ শতাংশ কমিশনের বাইরে তারা বেতন থেকে টাকা কেটে রাখছেন এবং চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
আউটসোর্সিংয়ে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বেতন ১৭ হাজার ৬৩০ টাকা। কিন্তু দেওয়া হয় ওভারটাইমসহ ৬-৯ হাজার টাকা। নীতিমালায় রয়েছে, বেতনের টাকা সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সেবা প্রদানকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেবে। কিন্তু বেতনের সব টাকা নিয়ে নেয় নিয়োগকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর তারা তাদের নিজের মতো করে ৪-৫ দিন ঘুরিয়ে বেতন দেয়।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন পিয়ন জানান, এখানে চাকরি করেন প্রায় ৮ বছর। বেতন পান ১২ হাজার ৫০০ টাকা কিন্তু তার নামে বেতন বরাদ্দ ১৪ হাজার ৫০০ তাহলে বাকি ২ হাজার টাকা কারা নেয়? তিনি বলেন, আমাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হায়জিন কোম্পানি আর ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ব্যাংক কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের কোনো পরিচয়পত্র কেউ দেয় না। আমাদের কোনো আইডেন্টিটি নেই। এ নিয়ে রাস্তাঘাটে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কোথাও পরিচয় দেওয়া যায় না কারণ তাহলে আমরা কিসের চাকরি করি? এছাড়া আমাদের বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় ক্যাশ। এই অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই? আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদৃষ্টি কামনা করছি। এই চিত্র বেসরকারি সব ব্যাংকে।
হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরেজমিন গিয়ে আইরিন নামের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি প্রায় ৩ মাস ধরে বিমানবন্দরে ৭৫০০ টাকা বেতনে চাকরি করছেন।
সপ্তাহে ১ দিন ওভারটাইম করে সেখানে আরও ২৫০ টাকা পান। একজন জানান, একে টেডার্স বর্তমান উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বাজারে যেভাবে বেতন দিচ্ছে তা অন্যায়। তারা কমিশনও নিচ্ছে আবার আমাদের পরিশ্রমের টাকাও নিচ্ছে। এ কোন দেশে বসবাস করছি? অভিযোগ সম্পর্কে মতামত নেওয়ার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আসলে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, এটা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বলতে পারবে। তবে আমি অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।
সরেজমিন আগারগাঁও দিয়াবাড়ি মেট্রোরেলের স্টেশনে গিয়ে কথা হয় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) সহকারী ম্যানেজার মিলন আল মামুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আসলে এখনো আমরা আমাদের বিভিন্ন প্রজেক্টের জনবল দিয়েই কাজ করছি। নতুন জনবলের জন্য একে টেডার্সকে কাজ দেওয়া হয়েছে সেখানে আউটসোর্সিং ২০১৮ নীতিমালা অনুযায়ী বেতন দেওয়া হবে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন, এখন যারা কাজ করছেন তারা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেই নিয়োগপ্রাপ্ত এবং এদের একজনের সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েকজন আনসার সদস্য বাধা দেন। এবং কোনো তথ্য জানতে হলে উপরের অনুমতি নিয়ে আসতে হবে বলে সরিয়ে দেন। বিজয় সরণিতে মেট্রোরেল স্টেশনের কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি তবে খুব দ্রুতগতিতে সংস্কার কাজ চলছে। পাশেই কাজ করছিলেন ইউরো ভিজিলের নিরাপত্তা প্রহরী আব্দুল মান্নান। কথার ফাঁকে জানালেন, তার বেতন ১১ হাজার ৫০০ টাকা। ডিউটি করেন ১২ ঘণ্টা। অথচ ডিউটির নিয়ম ৮ ঘণ্টা। এখানে যে অতিরিক্ত ৪ ঘণ্টা কাজ করেন তার কোনো পারিশ্রমিক নেই। মান্নান আরও বলেন, এই অতিরিক্ত সময়টুকু অভারটাইম হিসাবে ধরে এই টাকাটা কোম্পানি নিয়ে খেয়ে ফেলে। আমাদের বেতনও শুনেছি প্রায় ১৮ হাজার টাকা অথচ আমাদের দিচ্ছে কত? আমাদের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে তারা অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হয় আর আমরা ভালো করে এক বেলা বাজার করে খেতে পারি না। সারা মাস ধারদেনা করে চলতে হয়। মুখ খুলতে পারি না। কথা বললেই চাকরি থাকবে না। আউটসোর্সিংয়ের নামে কিছু প্রতিষ্ঠান চরম অন্যায়-অবিচার করছে। আগারগাঁও স্টেশনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্য বলেন, আমরা যেভাবে কাজ করি তারাও সেভাবেই কাজ করেন তবে কেন এত বৈষম্য? তাদের প্রতি যে অন্যায় করা হয় তা মনিটরিং করে যথাযথ ব্যাবস্থা নেওয়া উচিত। বর্তমানে বস্তিতে থাকতে গেলেও ৫ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। এরপর বাজার খরচ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, বাচ্চাদের খরচ। এভাবে কি ১১ হাজার টাকায় সারা মাস চলা যায়? আউটসোর্সিংয়ের অন্যায়-অবিচারের লাগাম টেনে ধরতে হবে অথবা এ খাতটির নিয়ন্ত্রণ সরকারের আয়ত্তে রাখতে হবে।
মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায় কয়েকটি ব্যাংকের কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, অরনেট কোম্পানির আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত কয়েকজন মেসেঞ্জার, পিয়ন খুব আক্ষেপের সুরে বলেন, আমরা বেতনের বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। ঈদ বলেন আর যে কোনো উৎসবই বলেন আমাদের এক পয়সাও দেওয়া হয় না। এ কেমন অবিচার? এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। আমাদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দিলেই আমরা খুশি। বর্তমানে যে অবস্থায় আমরা চাকরি করছি তা শুধু পেটের তাগিদে করে যাচ্ছি। এর বাইরে আর কিছু না। আউটসোর্সিং ব্যবসায়ী রাসেল বলেন, নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে কোনো মন্ত্রণালয় বা অফিস আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। সেবাদানকারীর শারীরিক সক্ষমতা থাকতে হবে। সেবা গ্রহণ ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮-এর আলোকে তা নির্ধারণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন, নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স, নিরীক্ষা ও ডাটাবেজ প্রণয়নসংক্রান্ত কার্যক্রম সরকার নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ সম্পন্ন করবে। পাশাপাশি সেবা প্রদানকারীর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও ব্যবস্থাপনাও সরকার নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ সম্পন্ন করবে। সেবার মাসিক মূল্য ও প্রণোদনা এবং সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম কমিশন অর্থ বিভাগের জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে বলেও নীতিমালায় বলা হয়েছে। ফারুক সার্ভিসেস লিমিটেডের মালিক মিজান বলেন, আউটসোর্সিং চাকরি সম্পূর্ণ অস্থায়ী চাকরি এবং যে কোনো সময় কর্তৃপক্ষ চাকরি প্রত্যাহার বা চাকরি হতে অপসারণ করতে পারে। এসব চাকরি সরকারি হয় না, এসব চাকরির নিয়োগ বিধিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয় যে, এটি সম্পূর্ণ অস্থায়ী। কাজ নেই মজুরি নেই ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো কালেই এসব কর্মচারী চাকরি স্থায়ীকরণ বা রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তের আবেদন করতে পারবে না।