তামাক ছেড়ে কাজুবাদাম ও কফি চাষে পাহাড়িরা
৩৬ হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ * তিন জেলায় ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প * পালটে যাবে পাহাড়ের অর্থনৈতিক চেহারা : কৃষিমন্ত্রী
ইয়াসিন রহমান, বান্দরবান ও রাঙামাটি থেকে ফিরে
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তিন পার্বত্য অঞ্চল-বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির পাহাড়িরা এক সময় জুম ও তামাক চাষ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারতেন না। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২১১ কোটি টাকার প্রকল্পে পাহাড়ের সেই চেহারা পালটে যাচ্ছে। তামাক ও জুম চাষ বাদ দিয়ে পাহাড়ের কৃষকরা এখন কাজুবাদাম ও কফি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। পাহাড়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজুবাদাম ও কফির চারা বিতরণ করছে। দেশের দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার ধরতে ৩৬ হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কৃষক পারখুপ বম যুগান্তরকে বলেন, আগে জুম ও তামাক চাষ ছাড়া কিছুই চিন্তা করা যেত না। এসব ফসল থেকে পাওয়া সামান্য অর্থে আমাদের চলতে হতো। আশা করছি-কাজুবাদাম ও কফি চাষে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। সরকার ইতোমধ্যে আমাদের কাজুবাদাম ও কফি গাছের চারা দিয়েছে এবং চাষাবাদে সার্বিক সহযোগিতা করছে। গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ভালো হচ্ছে; লাভও হবে। আমাদের আর অর্থনৈতিক সংকটে থাকতে হবে না।
একই অঞ্চলের নন্ন্যাকটা সোনাইছড়ি এলাকার কৃষক মোজাফ্ফর আহমেদ বলেন, ১০০ শতক জমিতে রোবাস্ট্যা জাতের কফি চাষাবাদ করছি। ২০২২ সালের ২৩ জুন ২৭০টি কফি গাছের চারা রোপণ করেছি। ফলন আসতে শুরু করেছে। আমার সাফল্য দেখে অন্য চাষিরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তারাও কফি আবাদে ঝুঁকছেন। পাহাড়ে কফি ও কাজুবাদাম চাষাবাদ প্রকল্পের পরিচালক শহিদুল ইসলাম জানান, পাহাড়ে কাজুবাদাম ও কফির চাষে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২০ সালে তিন জেলায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষ হতো।
এখন ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। এছাড়া ২০২০ সালে ১২৫ হেক্টর জমিতে কফি চাষ হতো। এখন ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩৬ হাজার কৃষককে কাজুবাদাম ও কফি উৎপাদন প্রযুক্তি, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৭০০টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রদর্শনীর আওতায় কাজুবাদম ও কফির ১২ লাখ চারা বিতরণ করা হয়েছে। বছরজুড়ে আরও ২০ লাখ চারা বিতরণ করা হবে।
সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও রাঙামাটির কয়েকটি কাজুবাদাম ও কফি বাগান পরিদর্শন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। এ সময় যুগান্তরকে তিনি বলেন, পাহাড়ে আগে শুধু তামাক ও জুম চাষ হতো। এখন পাহাড়ে নীরব বিপ্লব হাতছানি দিচ্ছে। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে কাজুবাদাম ও কফি আবাদে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। উচ্চফলনশীল ও উন্নত জাতের চারা উদ্ভাবন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন হলে কাজুবাদামের উৎপাদন ২ হাজার টন থেকে ২০ হাজার টন ও কফির উৎপাদন ৮ হাজার টনে গিয়ে দাঁড়াবে। এতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার ধরা সহজ হবে। তিনি আরও জানান, পাহাড়ে সমতলের মতো অনেক ফল ও ফসল চাষ করা হচ্ছে। গোলমরিচ, পেঁপে, আনারস, আম, ড্রাগন, মাল্টাসহ ৮-১০টি অর্থকরী ফসল চাষে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
এসব ফসলের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাত বাড়াতে সরকার কাজ করছে। তিনি বলন, এসব ফসলের চাষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে পাহাড়ের অর্থনৈতিক চেহারা পালটে যাবে। পাহাড়ি এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানের দর্শনীয় উন্নয়ন হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বছরে কাজুবাদামের চাহিদা ৪ থেকে ৫ হাজার টন। ২০১৯ সালে দেশে ৯৬২ টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়েছে। তিন বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৪২ টন। এক্ষেত্রে উৎপাদন বেড়েছে ৯১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পাশাপাশি দেশে বছরে কফির চাহিদা ৯০০ টন। ২০২০ সালে দেশে প্রায় ৫৬ টন কফি উৎপাদন হয়েছে। ২০২১ সালে ৫৮ টন এবং ২০২২ সালে ৬২ টন কফি উৎপাদন হয়েছে।