তীব্র দাবদাহে ওষুধের মান নষ্টের শঙ্কা
৯৫ ভাগ ফার্মেসিতে সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা নেই
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে তীব্র দাবদাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে এবার। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে গড় তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। এদিকে অধিকাংশ ওষুধের মোড়কের গায়ে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণের নির্দেশনা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের বেশির ভাগ ওষুধের দোকানেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। ফলে নির্দেশিত তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ হচ্ছে না। ফলে ওষুধ প্রযুক্তিবিদরা অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের গুণগত মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
তারা যুগান্তরকে জানান, দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী সারা বছর বেশির ভাগ সময় ওষুধ সংরক্ষণে কোনো সমস্যা নেই। এপ্রিল মাসে অতিরিক্ত গরম পড়লে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু ফার্মেসিগুলোতে এ ব্যবস্থা না থাকায় গুণগত মান নষ্টের আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত তিন ধরনের ওষুধ তাপমাত্রায় সংরক্ষণের নিয়ম। বায়োলজিক্যাল বা ভ্যাকসিন-জাতীয় ওষুধ ৪ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক-জাতীয় ওষুধ রাখতে হয় ১২ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। কিছু ওষুধ স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা যায়। এর ব্যতিক্রম হলেই সমস্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুর রহমান বলেন, ওষুধের মোড়কে শীতল পরিবেশ, আলো-বাতাস ও সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণের জন্য লেখা থাকে। দুঃখজনক হলো, হাসপাতাল থেকে শুরু করে কোনোখানেই সেটির শতভাগ অনুসরণ হয় না। টিনের ঘরেও ফার্মেসি করে ওষুধবাণিজ্য চলছে। মার্কেট থেকে ওষুধ নিয়ে সেটি কতটুকু ডিগ্রেডেশন হয়েছে, ডিগ্রেডেশন হওয়ার পর কোনো টক্সিক ম্যাটেরিয়ালে পরিণত হয়েছে কিনা, সেবনে শরীরের জন্য ক্ষতিকর কিনা-কিছুই দেখা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ফার্মেসি কাউন্সিল, ওষুধ মালিক সমিতি, কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি মিলে মাঠপর্যায়ে ওষুধের সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসা উচিত।
জানা গেছে, ওষুধ সংরক্ষণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ওষুধ নীতিমালায় সংরক্ষণ কক্ষের আর্দ্রতা ৬০ শতাংশের নিচে রাখার কথা বলা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সংরক্ষণ কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকার কথাও বলা হয়েছে। কক্ষের আয়তন ভেদে এক বা একাধিক রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার রাখতে হবে। এ থেকে উৎপাদিত তাপ বের করে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে একাধিক এগজস্ট ফ্যানের। বিশেষ করে সেফরাডিন এবং ভিটামিন-জাতীয় ওষুধ ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে রাখতে হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান বলেন, বেশ কিছু ওষুধই তাপামাত্রা সংবেদনশীল। সংবেদনশীলতার মাত্রা ও ওষুধের শ্রেণিভেদে সংরক্ষণও ভিন্ন হবে। যেমন কোনো ওষুধের জন্য রেফ্রিজারেশন, আবার কোনো ওষুধের জন্য সঠিক মাত্রার রুম টেম্পারেচার লাগে। এক্ষেত্রে কোনো ওষুধ সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ এবং কোনো ওষুধ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায়। অনেক ওষুধের গায়ে সংরক্ষণ প্রক্রিয়া লেখাও থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রুম টেম্পারেচার যে পর্যায়ে বাড়ছে তাতে কিছু ওষুধ সংরক্ষণ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সব ওষুধের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে বলা যাবে না। দ্বিতীয়ত, টিনশেড রুমে ওষুধের দোকান ও পাকা ভবনের দোকানের তাপমাত্রা এক রকম থাকবে না। তাপমাত্রার মানের পরিবর্তন হবে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ফার্মেসিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। এজন্য উৎপাদক, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং ফার্মেসি মালিকদের উদ্যোগী হতে হবে। না হলে বর্তমান তাপপ্রবাহে বড় সংখ্যক ওষুধের গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মুখপাত্র) ডা. আইয়ুব হোসেন বলেন, ওষুধের ধরন বুঝে সংরক্ষণের জন্য ফার্মাসি মালিকদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে অল্প সময়েই ওষুধ নষ্ট হয়ে যাবে না। কারণ তৈরির আগে স্টোর সলিউশন করে স্ট্যাবিলটি দেখা হয়। স্ট্যাবিলিটি ডাটা বলছে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয় না। তবু বর্তমান পরিস্থিতিতে সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ২৪ ঘণ্টা ওষুধ সংরক্ষণের জন্য ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের কয়েকটি টারশিয়ারি লেভের হাসপাতালে উপযুক্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে প্রায় ৯৫ শতাংশ জায়গায় শতভাগ ব্যবস্থা নেই। মেডিসিনের সেন্ট্রাল স্টোরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হলেও সেখান থেকে সাব স্টোর ও প্রতিটা বিভাগে ইনডোর স্টোরে প্রচুর ওষুধ পাঠানো হচ্ছে। সেখানে ওষুধের কোল্ড চেইন মেইনটেইন বা কোয়ালিটি হচ্ছে না। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এমনকি স্বয়ং হাসপাতাল পরিচালকদের এদিকে নজর নেই। সেন্ট্রাল স্টোর থেকে ওষুধ বাইরে আনার পর সপ্তাহ মাস খোলা থাকলেও সেগুলোর গুণগতমান ঠিক আছে কিনা দেখতে কোরনা ল্যাবরেটরি টেস্ট করা হয় না। টিনশেড ঘরেও অসংখ্য ফার্মেসির দোকান রয়েছে। চলতি দাবদাহ মৌসুমে সেখানে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত নেই। যেটি বন্ধে কর্তৃপক্ষ তদারকি তো দূরে থাক স্বয়ং স্বাস্থ্য সচিব বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান হলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।