Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

উপেক্ষিত ৯০ ভাগ সুপারিশ, দায়মুক্তি সাময়িক বরখাস্তে

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উপেক্ষিত ৯০ ভাগ সুপারিশ, দায়মুক্তি সাময়িক বরখাস্তে

জরাজীর্ণ রেলপথ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতিতে দেশে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। লাইনচ্যুতির ঘটনা নিত্যদিনের। মাঝেমধ্যে এক ট্রেনকে অপর ট্রেনের ধাক্কা কিংবা দুই ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে। রোববার কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে একটি মালবাহী ট্রেনকে পেছন থেকে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন ধাক্কা দেয়। এতে যাত্রীবাহী ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সাতটি কোচ দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ৫০ জন যাত্রীও আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পরপরই দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হয়তো তদন্ত কমিটিগুলো প্রতিবেদন দেবে; সুপারিশ করবে। কিন্তু আগের সব ট্রেন দুর্ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সব কমিটি প্রতিবেদন না দিলেও যেসব কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে, সেগুলোর সুপারিশ মোটেও অনুসরণ করা হয়নি। প্রায় ৯০ ভাগ সুপারিশই উপেক্ষা করা হয়েছে। আবার কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে শুধু সাময়িক বরখাস্তের মতো দায়সারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ কারণে অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে না।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, গত এক যুগে লাইনচ্যুতসহ ছোট-বড় প্রায় ৯ হাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪১০ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ১ হাজার ১০০ যাত্রী আহত হয়েছেন। প্রতিটি দুর্ঘটনায় এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি হয়েছে। সাড়ে ৯ হাজারের মতো দুর্ঘটনায় ৮৫০ থেকে ৯০০টি প্রতিবেদনে নানা সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে ৯ থেকে ১০ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ সুপারিশ অন্ধকারে থেকে গেছে।

অভিযোগ-বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও দায়ী ব্যক্তিকে নামমাত্র সাজা দিয়ে পরিস্থিতি ধামাচাপা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুখোমুখি দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু এবং দেড় শতাধিক যাত্রী আহত হন। একই বছর ২৪ জুন সিলেটে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় ছয়জন নিহত এবং ১৫ জন আহত হন। ওই দুই দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ট্রেনচালক ও সহকারী চালকসহ পাঁচ কর্মচারীকে বরখাস্তের সুপারিশ করা হয়। ওইসব দুর্ঘটনায় পূর্বাঞ্চল রেলের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীসহ রেলপথ ও মেকানিক্যাল দপ্তরের প্রকৌশলী-কর্মকর্তারা দায়ী হলেও তাদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।

সূত্র জানায়, দোষীদের মাত্র ৮ ভাগকে সাময়িক বরখাস্তের মতো সাজা দেওয়া হয়। আর মাত্র ২ শতাংশকে বরখাস্ত করা হয়। তবে ২ ভাগের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিরীহ কর্মচারী রয়েছে। অভিযোগ-দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ট্রেনচালক, সিগন্যালম্যান, ওয়েম্যান, গার্ড ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের শাস্তি দেওয়া হয়।

একাধিক ট্রেনচালক জানান, ইচ্ছা করলেই কোনো চালক, গার্ড বা মাঠপর্যায়ে থাকা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেন না। রেলপথ, লেভেলক্রসিং, ব্রিজের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আর এসবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় মহানগর গোধূলি এবং চট্টলা এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হন। ওই দুর্ঘটনায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এক চালককে বরখাস্তের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাউকে দায়ী করা হয়নি। ওই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করেন বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একাধিক শিক্ষক। রেল বিভাগে ওই অনুসন্ধানের প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

রেলওয়ে পরিবহণ দপ্তর সূত্র জানায়, রেলপথে মোট দুর্ঘটনার ৮৫ শতাংশ লাইনচ্যুতির ঘটনা। যুগের পর যুগ সংস্কারবিহীন রেলপথ, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, কোচ ও সিগন্যাল অকার্যকর হয়ে পড়ায় এমন দুর্ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। কুলাউড়ায় আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনাসহ ১০ বছরে অন্তত ২৫টি দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, লাইন মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, চালক-গার্ডদের অবহেলা, স্টেশন মাস্টারের ভুল সিগন্যাল, সিগন্যাল অমান্যই দুর্ঘটনার মূল কারণ। এসব দুর্ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সুপারিশ করা হলেও ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করেই দায় সারেন সংশ্লিষ্টরা। রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী কামরুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, রেলে দুর্ঘটনা কমে আসছে। নতুন লাইন তৈরি করা হচ্ছে। লাইন সংস্কার করাসহ রেলবহরে আধুনিক ট্রেন যুক্ত করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অবৈধ লেভেলক্রসিং দিয়ে বেপরোয়া অন্য যানবাহন চলাচল করা দুর্ঘটনা ঘটছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী শাস্তিও নিশ্চিত করা হচ্ছে।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক জানান, রেললাইন সঠিকভাবে ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে ঝুঁকি বাড়বে। দিনদিন তা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। আবার দুর্ঘটনার তদন্তও যথাযথভাবে করা হয় না। দায়ীদের শাস্তি শতভাগ নিশ্চিত করা হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম