মাদক সম্রাট কবির গাজী ভোলায় গড়ছে নতুন সাম্রাজ্য
অমিতাভ অপু, ভোলা
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভোলার আলী নগরে এক সময়ে মুরগি চুরির অপরাধে তাড়া খাওয়া হুমায়ুন কবির গাজী (কবির গাজী) ঢাকার গুলশান ও বনানী এলাকার মাদক সম্রাট হিসাবে কুখ্যাত। বর্তমানে নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে তিনি ভোলার আলী নগরের ৮নং ওয়ার্ডে গড়ে তুলছেন গাজী বাজার। রাজধানীতে তার রয়েছে একাধিক আবাসিক ভবন, গুলশান মার্কেটে রয়েছে একাধিক দোকান।
শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া কবির গাজী নিজেকে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের ওয়ার্ড সহসভাপতি দাবি করে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। বর্তমানে নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে তিনি ভোলার আলী নগরের ৮নং ওয়ার্ডে গড়ে তুলছেন গাজী বাজার। চাচাতো ভাই আনছার আলীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়ে বাড়ি ছাড়া করে দখল করে নিয়েছেন তিন একর সম্পত্তি। আনছার আলীর মালিকানাধীন অর্ধকোটি টাকা মূল্যের কয়েকশ গাছ কেটে, দোকান ঘর ভেঙে নতুন ভবন ও দোকান নির্মাণ করছেন কবির গাজী ও তার ভাই মাসুদ গাজী। ওই সম্পত্তির ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছেন না এই দুই প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী। শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে দুই ভাইয়ের দখল-তাণ্ডবের ছবি তোলার সময় এলাকার কলেজ শিক্ষক মাকসুদুর রহমান তুহীন ও তার ভাই লিটন জানান, তাদের জমি ও দোকানঘর জোর করে দখল করে নিচ্ছে কবির গাজী। এর কাছে তারা এখন অসহায়। এলাকার মানুষ টাকার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
কবির গাজীর অত্যাচারের শিকার অসহায় আনছার আলী ৯৯৯ নাম্বারে কল করে ৩ দফা পুলিশ নিয়েও কোনো সুফল পাননি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও রক্ষা করতে পারছেন না নিজের কেনা ও পৈতৃকসূত্রে পাওয়া প্রায় ৩ একর সম্পত্তি। গেল সপ্তাহে ভোলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের সাহায্য চেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য বৃদ্ধ আনছার আলী। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, কবির গাজী ও তার ভাই মাসুদ গাজীর বিরুদ্ধে বনানী ও গুলশান থানায় কয়েকটি মাদক মামলা রয়েছে। এরা এলাকায় মাদক ঘাঁটি বানাচ্ছে কিনা তা পুলিশ নজরদারি করছে।
হুমায়ুন কবির গাজী মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয় অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, তার বিরুদ্ধে ৬-৭টি মাদক মামলা রয়েছে। তিনি রড-সিমেন্টের ব্যবসা করেন। এছাড়া তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির তিনি সহসভাপতি। রাজধানীর নতুনবাজার এলাকায় তার ৯ তলা একটি বাড়ি রয়েছে। গাজীপুরের বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছেন। ভোলার আলী নগরে বর্তমানে তার কেনা জমিতে তিনি বাড়ি ও দোকান নির্মাণ করছেন।
এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে ১৩টি মাদক মামলা রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে মাদক পরিবহণের সময় পুলিশের এক এসআইকে হত্যারও অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের খাতায় কবির গাজী মাদক ব্যবসায়ী হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। বনানী থানায় ২০১৭ সালের ৯ মার্চ এফআইআর নং ৯। ওই মামলায় পলাতক আসামি হিসাবে কবির গাজীর নাম উল্লেখ রয়েছে। একই বছরে আরেকটি মামলা রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুলশান থানায়ও একটি মামলা রয়েছে। বনানী থানার ২০১৮ সালের ২১ মার্চও একটি এফআইআর দায়ের হয়েছে।
কবির গাজীর ভাই মো. মাসুদ গাজী ও এক ভাগ্নে তার মাদক ব্যবসা পরিচালনা করত। মাসুদ গাজীর বিরুদ্ধেও গুলশান ও বনানী থানায় মামলা রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এসব মামলা করা হয়। গত বছর মাসুদ গাজীর নামে লাইসেন্স করা একটি গাড়িতে মাদক পরিবহণের সময় পুলিশ গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিলে ওই গাড়ি পুলিশের গায়ের ওপর তুলে দেয়। এ সময় মারা যান এক এসআই। ওই মামলা এখনও চলমান।
মাসুদ গাজীও নিজেকে রড-সিমেন্টের ব্যবসায়ী বলে দাবি করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন এক সময় তার ভাই কবির গাজী মদ বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অন্য ব্যবসা করছেন বলে তিনি যুগান্তরকে জানান।
গাজীপুর জেলার কামারঝুরি খালপার সাইনবোর্ড বাজারে ৯ তলা ভবনের মালিক কবির গাজী। বর্তমানে রাজধানীর নতুনবাজারে রয়েছে আরও একটি ৯ তলা ভবন। ওই ভবনেই তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকেন। এ ভবন থেকে তিনি প্রতি মাসে ভাড়া পান ৫ লাখ টাকা।
কবির গাজীর উত্থান : অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পারিবারিক অর্থ সংকটের কারণে লেখাপড়া ছেড়ে এলাকায় রাইস মিলে কাজ শুরু করেন হুমায়ুন কবির। বাবা খালেক গাজীর ৭ মেয়ে ও ২ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে কবির। মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়েই খালেক গাজী তার জমিজমার সবটাই বিক্রি করে দেন। খালেক গাজীর বিরুদ্ধে একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে। বাউন্ডুলে কবির লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এক সময় এলাকায় নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। কয়েক দফা হাঁস-মুরগি চুরির দায়ে তাকে মারধরও খেতে হয়। পরে তিনি ছোট একটি মেশিন দিয়ে ধান ভাঙানোর কাজ শুরু করেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে কবির বিএনপি সরকারের সময় ঢাকায় গিয়ে মদ বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাদকবিরোধী অভিযানে তাকে কয়েকবার জেলেও যেতে হয়। তখন ডজনখানেক মামলা মাথায় নিয়ে ২০০১ সালে বিএনপির ক্ষমতার সময় ফের এলাকায় ফিরে ত্রাস শুরু করেন কবির গাজী। এ সময় ওপেন মদ ও মাদক ব্যবসায় কপাল খুলে যায় কবির গাজীর। দুই শতাধিক কিশোর ও যুবককে দিয়ে রাস্তায় গাড়ি থামিয়েই মদ বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেন কবির। ওই সময় যুগান্তরের সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল ওই অবৈধ মাদক ও মদ বিক্রির ঘটনা।
ভোলার হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার ফোরামের সভাপতি মোবাশ্বির উল্যাহ চৌধুরী জানান, তাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে যে, ওই মাদক সম্রাট কবির গাজী ও তার ভাই মাসুদ গাজী ভোলার আলীনগরে নতুন করে সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে আনছার আলীসহ কয়েকজনের জমি জোর করে দখল করেছেন। পিটিয়ে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে আনছার আলীকে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান মানবাধিকার সংস্থার এই প্রতিনিধি।
এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. বশির আহম্মেদ জানান, কবির ও তার ভাই মাদক ব্যবসায় জড়িত এটা ওপেন সিক্রেট। ভোলা থানার ওসি শাহীন ফকির জানান, আনছার আলীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তারা কয়েকবার ওই এলাকায় গিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ পেলে তারা কবির ও তার ভাই মাসুদ গাজীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। নির্মাণ কাজ ও গাছ কাটা বন্ধ রাখতে কবির গাজীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান ওসি।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে প্রশাসনের নির্দেশ উপেক্ষা করেই কবির ও মাসুদ গাজী রাত-দিন তাদের ভবন ও আস্তানা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনের আগে তারা (কবির ও মাসুদ) তাদের আস্তানা মজবুত করতে চান। এই আস্তানাই হবে এলাকার সব অপকর্মের অশনি সংকেত এমনটা জানান বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল কলেজের শিক্ষক মাকসুদুর রহমান তুহীন।