টেকনাফ বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি
ডলারের দাম ‘যেমন খুশি’ নিচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক
জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডলার সংকটের কথা বলে সরকারি ব্যাংকগুলো লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) দেওয়া বন্ধ করেছে অনেক আগেই। কিন্তু ব্যবসা বন্ধ করে বসে থাকতে পারেননি কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরের সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীরা। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পণ্য খালাস করতে তাদেরকে বেসরকারি ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। আর এই সুযোগে এফডিডি (ফ্র্যাঞ্চাইজ ফরেন ডিমান্ড ড্রাফট) খুলতে সরকার নির্ধারিত ডলারের দামের চেয়ে অতিরিক্ত দাম হাতিয়ে নিচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত এই অর্থ তুলে নিতে মিয়ানমার থেকে আমদানি পণ্য আদা, মাছ, পেঁয়াজ, রসুন শুঁটকি আচারসহ সবকিছুরই দাম রাখছেন। এতেই অস্থির হয়ে উঠছে বাজার।
সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের অতিরিক্ত ৭ থেকে ১০ টাকা বেশি না পেলে এফডিডি দেওয়া হয় না। অর্ডারে আসা মালামাল ছাড়াতে গেলে বাড়তি দামই পরিশোধ করতে হচ্ছে। সোমবার ডলারের দাম ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা থাকলেও টেকনাফে চলতি সময়ে এফডিডি দেওয়া একমাত্র ব্যাংক এবি ব্যাংক ডলারপ্রতি রেখেছে ১১৫ টাকা ২৩ পয়সা। তবে বাড়তি আদায়ের রসিদও দিচ্ছে না ব্যাংক। আবার এসব এফডিডি পেতে আওয়ামী লীগের জেলা ও বিভাগীয় নেতাসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্তাব্যক্তির তদবির লাগে।
তারা আরও জানান, ডলারের দাম অতিরিক্ত হওয়ায় খাদ্যপণ্য আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই মিয়ানমার থেকে আমদানি করা সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতারাও বিপাকে পড়েছেন।
টেকনাফ বন্দরের শীর্ষ ব্যবসায়ী মেসার্স ফারুক ট্রেডার্সের মালিক ওমর ফারুক বলেন, ‘সোমবার একটি এলসিতে ২৯ হাজার ৯৯০ ডলারের বিপরীতে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে ডলারের দাম পড়েছে ১১৫ টাকা ২৩ পয়সা। কিন্তু আমাকে ১০৬ টাকা ৯০ পয়সার রসিদ দেওয়া হয়েছে। এরপরও কাঁচামাল নষ্ট হওয়ার ভয়ে সেই দরেই এফডিডি নিতে বাধ্য হয়েছি। তিনি বলেন, ডলার সংকট দেখিয়ে অনেক আগেই সোনালী ব্যাংক লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। এর পর থেকেই মূলত এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।’
আরেক ব্যবসায়ী আবু আহমদ বলেন, ‘এখন শুধু এবি ব্যাংক এফডিডি দিচ্ছে। চাহিদার পরিবর্তে জোগান কম হওয়ায় সরকার নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত মূল্যে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।’
জানা যায়, প্রতিদিন কম হলেও ১৭টি এফডিডি দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দর থেকে ৭ থেকে ৯ টাকা বেশি নিয়ে প্রতিদিন ৩৫-৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এবি ব্যাংক। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত এই টাকা তুলতে গেলেই বাজারে অস্থিরতা বাড়ে। শুধু তাই নয়, নেতাদের তদবির ছাড়া এফডিডি হয় না। সরকারি দলের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের নেতা বা এমপিদের তদবিরে এফডিডির সিরিয়াল আগে-পরে হয়। তদবিরকারকদেরও ‘নজরানা’ দিতে হয়। আর এই অর্থ তুলে আনতে ভোক্তাদের পকেট কাটা হচ্ছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ, এবি ব্যাংক টেকনাফ শাখা এখন দলীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা এফডিডির তদবির নিয়ে যাচ্ছেন। আর এ সুযোগে অনৈতিকভাবে ডলারে দর বেশি রাখছে এবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নেতা বা বড় আমলার তদবির রক্ষা করতে গিয়ে সিরিয়ালে থাকা অনেক ব্যবসায়ী নিয়ম অনুযায়ী এফডিডি পান না। আর সময়মতো এফডিডি না পাওয়ায় কাঁচামাল নষ্টের ঘটনাও ঘটেছে। সালাম অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আবদু সালাম বলেন, ‘আমি গত বছর ডিসেম্বরে এফডিডির সিরিয়াল পেয়েছিলাম। এরপর থেকে ডলার সংকটের কারণ দেখিয়ে আমাকে আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে সরকারদলীয় নেতা দিয়ে যারা তদবির করাচ্ছেন, তারা নিয়মিত এফডিডির সুযোগ পাচ্ছেন।’
ডলারের দাম বাড়তি নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এবি ব্যাংক টেকনাফ ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মনজুর আলম চৌধুরী। তবে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো কিছু জানার থাকলে এবি ব্যাংক হেড অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’
এদিকে বুধবার তার (ম্যানেজার) বক্তব্য নেওয়ার পর থেকে ওই শাখায় লেনদেন বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দরের ব্যবসায়ীরা।