Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

পাওয়ার আগেই হারানোর শঙ্কায় ভূমিহীনরা

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাওয়ার আগেই হারানোর শঙ্কায় ভূমিহীনরা

বরিশালের বাবুগঞ্জে ভূমিহীনদের জন্য ঘর উঠছে বিরোধপূর্ণ জমিতে। যে জমিতে উঠছে ঘর তার মালিকানা নিয়ে রয়েছে একাধিক মামলা। আদালতের সমনও রয়েছে জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং ভূমি দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তারপরও বেশ জোরেশোরেই নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। বিরোধপূর্ণ জমিতে আশ্রয়ণের ঘর না তোলার জন্য বলেছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তা না শুনে জমি চূড়ান্ত আর কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চালিয়ে যান কর্মকর্তারা। বর্তমানে চলছে ইট গাঁথুনির কাজ। চলমান মামলায় মালিক দাবিদাররা জিতলে ভবিষ্যৎ কী হবে এই প্রকল্পের? সেই প্রশ্ন এখন ঘর বরাদ্দ পাওয়া ভূমিহীনদের। প্রশাসনের কর্মকর্তারা অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন সেই আশঙ্কা। তারা বলছেন, কোনো অবস্থাতেই সরকার মামলায় হারবে না। হারলেও সহজ নয় জমি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া। ফলাফল ভূমিহীনরাই থাকবেন ওই জমিতে।

বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নের রাউতকাঠী গ্রামে সৃষ্টি হয়েছে এই জটিলতার। সেখানে চলছে গৃহহীনদের জন্য ২০টি ঘর নির্মাণের কাজ। যার প্রতিটি নির্মাণে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে দিচ্ছে সরকার। সরেজমিনে দেখা গেছে, সন্ধ্যা নদীর উত্তর পাড়ে বড় একটা জায়গাজুড়ে চলছে এসব নির্মাণ। সমতলের বেশ খানিকটা ওপর পর্যন্ত উঠে গেছে ইটের গাঁথুনি। কাজ করছেন বেশ কয়েক শ্রমিক। সাংবাদিক শুনে ততক্ষণে জড়ো হন বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। তাদেরই একজন নূরজাহান বেগম। দাবি করলেন এই জমি তাদের। তার বাবা মুনসুর কাজী ছিলেন জমির মালিক। উত্তরাধিকার সূত্রে এখন মালিক তিনি ও তার দুই ভাই। কথা হয় নূরজাহানের ভাই আনসার কাজীর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এস.এ পর্যন্ত আমার বাবার নামেই ছিল জমি। বিএসের কাজ চলার সময় টাকা চেয়েছিল মাঠ জরিপে নিয়োজিতরা। দরিদ্র বলে দিতে পারিনি। পরে শুনি আমাদের জমির বড় একটা অংশ খাস খতিয়ানে তুলে দিয়ে গেছে তারা। মারা যাওয়ার আগে এই ঘটনায় বাবা মুনসুর কাজী মামলাও করেন। সেই মামলা এখনো বিচারাধীন। মামলার বিষয়ে নোটিশসহ অন্য সবকিছুই পেয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তারপরও তারা এই জমি নির্ধারণ করেছে ভূমিহীনদের জন্য।

জমির মালিক দাবিদার আরেক পরিবারের সদস্য খালেক হাওলাদার বলেন, রাউৎকাঠী মৌজায় আমাদের দুই পরিবারের মোট জমির পরিমাণ ৫ একর ২৪ শতাংশ। ৪টি দাগে রয়েছে এই জমি। বি.এস পর্চায় ৩ একর ৩৬ আমাদের নামে এলেও বাদ পড়ে বাকি ১ একর ৮৮ শতাংশ। ওই জমি খাস খতিয়ানে তুলে দিয়ে যায় মাঠ জরিপ কাজে নিয়োজিতরা। কেবল খাস খতিয়ানই নয়, কিছু জমি সড়ক ও জনপথের নামেও তুলে দেওয়া হয়েছে। দুই নামে তুললেও জমি যে আমাদের দখলে তা উল্লেখ করা হয় সেখানে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসে গেলে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিল তারা। ফলে এ নিয়ে আর কোথাও যাইনি। হঠাৎ দেখলাম এখানে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। পরে বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা করি। ওই মামলায় গত ২০ মার্চ জেলা প্রশাসকসহ ৫ জনকে সমন দিয়েছেন আদালত। আগামী ৭ মে আদালতে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে তাদের।

মামলার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে মিলেছে সমন জারি হওয়ার সত্যতা। বাবুগঞ্জ সহকারী জজ আদালতে হওয়া ওই মামলার নম্বর ৫৩/২৩। আদালতের সেরেস্তাদার জানান, জেলা প্রশাসক ছাড়াও আরও ৪ জনের নামে জারি হয়েছে সমন। এরা হলেন-সড়ক ও জনপথ বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী, বাবুগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার ভূমি এবং দেহেরগতী ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে দেহেরগতী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ প্রশ্নে জমি বাছাই করে সরকার। এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। আমার ইউনিয়নের ক্ষেত্রে অন্তত তা মানা হয়নি। বাছাই পর্বেই এই জমি নিয়ে আপত্তির কথা বলেছিলাম। জমির মালিকানা নিয়ে চলমান মামলা এবং বিরোধপূর্ণ জমিতে ঘর না করার জন্য অনুরোধও জানিয়েছি। উপজেলা প্রশাসন তা শোনেনি। নিজেদের মতো করে সব চূড়ান্ত করার পর শুরু হয়েছে ঘর নির্মাণ। এখন তো আরও একটা মামলা হলো। শেষ পর্যন্ত যদি মালিকানা হারায় সরকার তো ভূমিহীনদের কী হবে? অনুরোধ না শোনার পরপরই বিষয়টি থেকে সরে এসেছি। পরবর্তীতে আর কোনো খোঁজখবরও নেইনি।

এই প্রকল্পে কারা ঘর পাবে তার তালিকাও এরই মধ্যে চূড়ান্ত করেছে প্রশাসন। যদিও সেই তালিকা এখনো পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি। যারা ঘর পাবেন তাদের ৩/৪ জনের নাম জেনেছে যুগান্তর। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এদের একজন বলেন, সরকারিভাবে ঘর পাব জেনে যতটা আনন্দে ছিলাম তার চেয়ে এখন বেশি ভয় পাচ্ছি। ঘরে ওঠার কয়েক বছর পর যদি দেখি যে তা ছেড়ে দিতে হবে তখন কোথায় যাব? তার চেয়ে যে জমিতে ঝামেলা নেই সেখানে আমাদেরকে ঘর দিক প্রশাসন। তাহলে আর এই ভয় থাকবে না। আমরাও থাকব নিশ্চিন্তে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাবুগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূসরাত ফাতিমা’র সঙ্গে। শুরুতেই তিনি উড়িয়ে দেন জমির মালিকানা হারানোর আশঙ্কা। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ঘরগুলো নির্মাণ হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। যুগান্তরকে ইউএনও বলেন, ২০-২৫ বছর আগেও সেখানে কোনো জমি ছিল না। নদীতে চর পড়ে জমি সৃষ্টি হয়েছে। বিধান অনুযায়ী এই ধরনের জমির মালিক সরকার। এটি প্রিন্টেড শিকস্তি জমি। আলোচ্য মৌজা এবং দাগে তাদের (মালিকানা দাবিদার) জমি রয়েছে এটা ঠিক। তবে সেই জমি এটি (যেখানে ঘর উঠছে) নয়। সেখানে তাদের ৫২ শতাংশ জমি ছিল। আমরা তা মেপে বুঝিয়ে দিয়েছি। জমি বুঝে পাওয়ার বিষয়ে তারা প্রশাসনের কাছে লিখিতও দিয়েছে। আদালত থেকে আসা এই সংক্রান্ত নোটিশের জবাবও দিয়েছি। কোনো অবস্থাতেই ওই জমির মালিকানা বদল হবে না। সরকারের জমি সরকারেরই থাকবে। পরবর্তী মালিকানা হবে ভূমিহীনদের।

বরিশালের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর রাকিবুল হাসান বলেন, সরকারের জমি হাতিয়ে নিতে অনেকেই মামলা করে। মামলা হওয়া মানেই তো জমি তাদের নয়। এ রকম প্রকল্পের ক্ষেত্রে জমি নিষ্কণ্টক কি না তা বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেই আমরা। কেবল তো নিম্ন আদালতে মামলা হয়েছে। বিচারের অনেকগুলো পর্ব রয়েছে। দেখা যাক কী হয়।

মামলায় যদি তারা জেতে তাহলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জজ আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, আপিলেট ডিভিশন, রিভিশন বেঞ্চ এরকম অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। তারপরও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই সরকার হেরেছে, তবু জমি বুঝে পাওয়া সহজ নয়। খাস জমির মালিকানা সরকারের হাত থেকে ব্যক্তি মালিকানায় যাওয়া আর দখল পাওয়া অনেক কঠিন। আমরা এই নিয়ে টেনশন করছি না। আদালতেই সবকিছুর ফয়সালা হবে এবং জমি সরকারের মালিকানায়ই থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম