Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

রাজধানীতে নির্মাণকাজ ঘিরে নীরব চাঁদাবাজি

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীতে নির্মাণকাজ ঘিরে নীরব চাঁদাবাজি

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নীরবে চাঁদাবাজি চলছে। কোনো স্থানে বাড়ি কিংবা ভবন নির্মাণ শুরু হলে চাঁদাবজরা চাঁদা দাবি করে। না দিলে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। স্থানীয়ভাবে এসব চাঁদাবাজ চক্রকে ‘বোবা ফিটিং’ গ্রুপ নামে ডাকা হয়। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এরা নীরবে বছরের পর বছর চাঁদাবাজি করে চলেছে। ঝামেলার ভয়ে অনেকেই এদের সঙ্গে মিটমাট করে কাজ চালিয়ে যান। প্রতিকার চেয়ে কেউ মামলা করতে গেলে তাকে পড়তে হয় বিপদে।

চাঁদাবাজির ঘটনায় গত পাঁচ বছরে কিংবা গত এক বছরে কতগুলো মামলা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। তবে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯-এর পরিসংখ্যান বলছে, চাঁদা চেয়ে হুমকির ঘটনায় গত বছর থেকে ২৪৯২টি কল এসেছে তাদের কাছে। গত জানুয়ারি মাসে ১৬০টি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে তারা ২০১টি ফোনকল পেয়েছে। রাজধানীর উত্তরখানে বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে চাঁদা দাবির ঘটনার মামলা করে প্রতিকার পাচ্ছেন না আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তিনি যুগান্তরকে জানান, তারা ২১ জন মিলে উত্তরখানের শ্যামলীবাগ এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করছেন। পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্মাণ কাজে নানাভাবে বাধা দিয়ে আসছে জনৈক মঞ্জুরুল আলম পলাশ ও তার সহযোগীরা। দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় তারা কাজ বন্ধ রাখতে বলছে। শুধু তাই নয়, নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসা গাড়ির চালকের কাছেও চাঁদা দাবি করে তারা। বিষয়টি তিনি প্রথমে উত্তরখান থানার ওসিকে জানান। পুলিশ মামলা না নেওয়ায় ২ জানুয়ারি তিনি আদালতে মামলা করেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় পলাশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মামলা করে উলটো আমি নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি।’ শ্যামলীবাগ এলাকার আরেক বাসিন্দা (একটি গার্মেন্টের পরিচালক) যুগান্তরকে বলেন, ‘পলাশের বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ করায় সে আমাকে চুরির মামলা দিয়ে অপদস্ত করেছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার দলিল উদ্দিন মিয়া অভিযোগ করেন, মঞ্জুরুল আলম পলাশ ও তার সহযোগিদের অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকায় সে এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। এছাড়াও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি মঞ্জুরুল আলম পলাশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও হয়রানির অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মঞ্জুরুল আলম পলাশ যুগান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। মামলা তদন্তাধীন আছে। মামলায় প্রমাণ হবে আমি দোষী না নির্দোষ। ওসি, ডিসি সাহেব বিষয়গুলো দেখছেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আসেন একদিন বসে ইফতার করি এবং বিস্তারিত কথা বলি।’ এ সময় তিনি বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকে নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দেন। এ প্রসঙ্গে পুলিশের উত্তরা বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার রাকিবা ইয়াসমিন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করি। কে কার নাম ভাঙাল সেটা দেখার বিষয় নয়। চাঁদাবাজিসহ অপরাধ দমনের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছি।’

১০ ফেব্রুয়ারি ২১৪ পশ্চিম আগারগাঁওয়ে চাঁদার দাবিতে টিউনিক দেলোয়ার প্যালেস নামে আটতলা ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় একটি চক্র। এরপর ভবন মালিকের কাছে ৫০ লাখ ও ডেভেলপার কোম্পানির কাছে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। শুধু তাই নয়, ভবন মালিক দেলোয়ার হোসেন ও তার ছেলে পাভেলকে মারধর করে। এ ঘটনায় পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি থানায় দুটি মামলা রেকর্ড হয়।

ভুক্তভোগী দেলোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, মামলা করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মামলা তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। যোগাযোগ করা হলে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বোবা ফিটিং গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। গ্রুপের এক অংশ বিভিন্ন ভবন মালিক ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। আরেকটি অংশ কৌশলে তাদের কাছে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। চক্রের অধিকাংশ সদস্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতার আশীর্বাদপুষ্ট। বাড়ি নির্মাণ করতে চাইলে তাদের কথামতো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ইট, বালু, সিমেন্ট কিনতে হয়। রাজি না হলে চলে হুমকি-ধামকি। শারীরিক নির্যাতন করা হয়। যারা তাদের কাছ থেকে নির্মাণসামগ্রী কেনেন তাদের চড়া দাম দিতে হয়। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই নির্মাণ কাজের মান খারাপ হয়।

নতুন বাড়ি করার সময় চাঁদা না দেওয়ায় গত বছর রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে নৃশংসভাবে খুন হন বাবুল নামে এক ব্যবসায়ী। শহিদ ফারুক রোডে ৬-৭ চাঁদবাজ ও মাদককারবারি মিলে তাকে খুন করে। ওই সময় রতন নামে এক সন্ত্রাসীকে আটক করে জনতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ডেভেলপার ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, নগরীর প্রত্যেক এলাকায় চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয়। তাদের টাকা পয়সা দিয়েই ভবন তৈরি করতে হয়। তাছাড়া চক্রের কাছ থেকে নিম্নমানের নির্মানসামগ্রী কিনতে হয়। এ কারণের কাজও নিম্নমানের হয়।

জানতে চাইলে ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের ডিসি মো. ফারুক হোসেন বলেন, কেউ চাঁদা দাবি করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। থানায় অভিযোগ দিতে হবে। অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা পুলিশের কাজ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম