ঝিনাইদহ জেনারেল হাসপাতালে দুর্নীতিতে জড়িতরা অধরা
মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঝিনাইদহ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল যেন লুটেরার স্বর্গরাজ্য। অনিয়ম-দুর্নীতির খবর ফাঁস হলেও চক্রের সদস্যরা আজও অধরা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সরকারি অর্থ লুটপাটের ভয়ংকর চিত্র।
রাজধানীর সেগুন বাগিচার অডিট অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার ফারুক আহমদ স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে টেন্ডার হাসপাতালটিতে জালিয়াতির ঘটনা সর্বকালের রের্কড ছাড়িয়েছে। লঙ্ঘন করা হয়েছে পিপিআর (সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালা)। ওই অর্থবছরে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে ৫৯ হাজার আইভি ক্যানোলা কেনা হয়। এর জন্য এএস ট্রেডিং করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ২০২১ সালের ২০ জুনে আট লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই হাসপাতালের ৪টি পৃথক কক্ষে মূল্যবান ওষুধ, ইনজেকশন, স্যালাইন, কেমিকেল রি-এজেন্ট, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি মজুত রাখার কথা ছিল। অথচ কেনা গজ ব্যান্ডেজ তুলা হাসপাতাল বাউন্ডারির বাইরে একটি পরিত্যক্ত স্টাফ কোয়ার্টারের নিচতলায় দরজায় সিলগালাহীন রাখা হয়। এমএসআর (মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিক্যাল সামগ্রী) স্টোর সংক্রান্ত বিভিন্ন অফিস আদেশ, বিল রেজিস্টার, সরেজমিন যাচাইকালে এ ঘটনা ধরা পড়ে। ওই অর্থবছরে জিআরএফের বিধি লঙ্ঘন করে অনিয়মিতভাবে গজ ব্যান্ডেজ, কেনার খরচ ৩১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৫০ টাকা দেখানো হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালের ২৯ জুন ভাউচারে (ভাউচার নম্বর ১) ১২ জন আউটসোর্সিং কর্মচারীর জুলাই-২০২০ মাস থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাসের বেতন হিসাবে ২৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪২ টাকা গ্যালেন্স সিকিউরিটি সার্ভিসেস ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। আউট সোর্সিং নীতিমালা-২০১৮ ভঙ্গ করে ওই একই ভাউচারে ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি কোভিডকালীন ১৭ জন আউট সোর্সিং কর্মচারীর বেতন-ভাতার ছয় লাখ ৪৫ হাজার ৪৯০ টাকার চেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের নামে জেলা অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিস থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি (২০২১) নেওয়া হয়েছে।
অনিয়ম ও দুর্নীতির আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালের জুন মাসে। এ সময় টেন্ডারে অংশ গ্রহণের অযোগ্য দুটি চিহ্নিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এমএসআর সামগ্রী সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। দরপত্রের শর্তাবলি লঙ্ঘন করে সরকারের দুই কোটি ৭৬ লাখ পাঁচ হাজার ২০০ টাকার ক্ষতি করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস মন্তব্য করেছে। জানা যায়, কাগজেকলমে আজিজুল হক ও তার স্ত্রী সুপ্তি হকের নামীয় মামুন ড্রাগস এবং অপরাজিত ড্রাগস সদর হাসপাতাল রোড মাগুরাকে বিপুল অংকের ওই টাকা প্রদান করা দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, কিছু অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তির খেয়ালখুশিতে হাসপাতালটির প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক সিএমএসডি বরাবর ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি রেডিওলজি বিভাগের জন্য একটি এক্স-রে মেশিন চেয়ে পাঠান। ৫ জানুয়ারি ৫০০ এমএ ডিজিটাল রেডিওগ্রাফি (সিআর) একটি এক্স-রে মেশিন পাঠানো হয়। যার দাম ৩৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯৮৪ টাকা। ৩০ জানুয়ারি মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মেশিনটি প্রতিস্থাপন (ইনেস্টলেশন) করানো হয়। ২০২২ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত কোনো এক্স-রে ওই মেশিন দিয়ে করানো হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, মেশিনটি কেনা বাবদ সরকারের ৩৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯৮৪ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
দুর্নীতি-অনিয়মের এসব ঘটনার সময় হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন (বর্তমান সহকারী পরিচালক প্রশাসন স্বাস্থ্য বিভাগ খুলনা ) ডা. হারুন-অর-রশীদ। তিনি নিজেকে সৎ হিসাবে দাবি করে বলেছেন, সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে শক্তিশালী একটি চক্র জড়িত। তিনি আরো বলেন, যে সব আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়েছে সেগুলোর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিশেষ একটি সূত্র জানায় বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম ২০২২ সালের ২৯ মার্চ একটি লিখিত জবাব দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। হাসপাতালটির অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের দ্রুত শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ঝিনাইদহ সিটিজেন ফোরাম।