Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

রাষ্ট্রপতির ভ্রমণ উপযোগী বগি ক্রয়ে হোঁচট

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাষ্ট্রপতির ভ্রমণ উপযোগী বগি ক্রয়ে হোঁচট

রাষ্ট্রপতির রেল ভ্রমণে ব্যবহার উপযোগী চার কোচের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেলুনসহ ২০০ বগি ক্রয়ের আগেই হোঁচট খেল রেলওয়ে বিভাগ। ১২৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত প্রকল্পের জন্য বগি ক্রয়ের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। কিন্তু ওই টেন্ডারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রেলওয়ে বিভাগ কিনবে ২০০ বগি। অথচ তারা শর্তে চেয়েছে ৮০০ বগি তৈরি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। প্রকল্পের এমন শর্ত নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ অবস্থায় দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আপত্তির মুখে অভিজ্ঞতার শর্ত পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রকল্পে টেন্ডার দাখিলের সময়ও বাড়ানো হয়েছে।

টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানকে ১০ বছরের মধ্যে ৮০০ বগি তৈরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর রেলওয়ের কাজে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় ৫ বছরের। এ অবস্থায় টেন্ডারে অংশগ্রহণে আগ্রহী একাধিক প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞতার শর্তে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একটি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প পরিচালককে লিখিতভাবে অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিলের আহ্বান জানিয়েছে। টেন্ডারে অংশগ্রহণে আগ্রহীরা মনে করেন, যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করে বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে না। এর কাজ পাবে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান।

প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল ইসলামও বিষয়টি স্বীকার করে সোমবার যুগান্তরকে বলেন, কিছু শর্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, সেসব শর্ত আমরা পরিবর্তন করে দিয়েছি। দরপত্র দাখিলের সময়ও বাড়ানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, যাত্রী পরিবহণে রেলের সক্ষমতা বাড়াতে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (ইআইবি) ঋণে ২০০ ব্রডগেজ কোচ (বগি) কেনার উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে। এগুলোর মূল্য ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৮১ কোটি ৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে, ২০০ কোচের মধ্যে চার কোচের এক সেট সেলুন কেনা হবে। এই সেটটি রাষ্ট্রপতির ভ্রমণে ব্যবহার উপযোগী। এর নিরাপত্তাব্যবস্থাও নিশ্চিদ্র। রাষ্ট্রপতির ভ্রমণ উপযোগী কোচ এই প্রথম রেলওয়েতে সংযোজন করার উদ্যোগ। এছাড়া কেনা হবে তিনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ইনস্পেকশন কার, চারটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্স স্লিপার কার, ২৫টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্লিপার কার, ৪২টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কার, ৮০টি শোভন চেয়ার কার, ১৬টি ডাইনিং ও নামাজের ব্যবস্থা সংবলিত শোভন চেয়ার কার এবং ২৬টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাগেজ ভ্যান সংবলিত পাওয়ার কার।

প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকালে ধরনভেদে প্রতিটি কোচের একক দাম ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ২৮ কোটি ২৩ লাখ, ৭ কোটি ৩ লাখ, ৮ কোটি ১৬ লাখ, ৫ কোটি ১১ লাখ, ৪ কোটি ৭১ লাখ, ৪ কোটি ১৮ লাখ, ৪ কোটি ১১ লাখ ও ৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। যদিও প্রকল্পটি চূড়ান্ত করার সময় ধরনভেদে প্রতিটি কোচের একক দর বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫৩ কোটি ৯৪ লাখ, ১০ কোটি ১৭ লাখ, ৭ কোটি ৫১ লাখ, ৬ কোটি ৩৬ লাখ, ৬ কোটি ২৩ লাখ, ৫ কোটি ৭৮ লাখ, ৫ কোটি ৭৮ লাখ এবং ৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ সব ধরনের কোচের দামই বাড়তি ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে কোচগুলোর দাম ৩৬৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা বা ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি ধরা হয়েছে।

২০২২ সালের ২২ মার্চ এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।

সূত্র জানিয়েছে, ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া প্রতিটি কোচের দাম পড়ছে ৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। রেলের সম্প্রতি কেনা কোচের চেয়ে এ ব্যয় ৪৩ শতাংশ বেশি।

অথচ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণে ২০১৭ সালে রেলওয়ে ২০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ কেনা হয়। এর মধ্যে প্রতিটি ব্রডগেজ কোচের দাম পড়েছিল ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া গড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখ ৭১ হাজার টাকা। আর প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচের প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে গড়ে ৬ কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে গড়ে প্রতি কোচের দাম বেশি ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।

এদিকে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৩০ জানুয়ারি এই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রথমে শর্ত ছিল, ঠিকাদারদের ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে এমন বগি দিতে হবে। সেই শর্ত পরিবর্তন করে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে-এমন বগি চাওয়া হয়েছে। ১৯ মার্চ ওই দরপত্রে আরেক দফা সংশোধনী আনা হয়। আগে চাওয়া হয়েছিল ১০ বছরে ৮০০ বগি তৈরির অভিজ্ঞতা। আর এখন দরপত্র সংশোধন করে চাওয়া হয়েছে ১০ বছরে ৬০০ বগি তৈরির অভিজ্ঞতা। তাছাড়া ২১ মার্চ দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ধার্য থাকলেও শর্ত পরিবর্তনের পাশাপাশি সময় বাড়িয়ে দাখিলের শেষ দিন ধার্য করা হয়েছে ২৭ এপ্রিল।

দরপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথমত দরপত্রে ১০ বছরে অন্তত ৮০০ বগি তৈরি করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে এমন প্রতিষ্ঠান আবেদন করতে পারবে-এমন শর্ত দেওয়া হয়। আর আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারে অংশগ্রহণের সর্বমোট অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় পাঁচ বছরের। দরপত্রে বলা হয়, রেলওয়ের যন্ত্রপাতি এবং এ সংক্রান্ত সেবা প্রদানের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। প্রধান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে সফলতার সঙ্গে ১৫ বছরে ৬০ মিলিয়ন ডলারের কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে অন্তত একটি কাজের সর্বনিু মূল্য হতে হবে ২০ মিলিয়ন ডলার।

২ মার্চ রেল ভবনে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সম্ভাব্য দরপত্র আহ্বানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বৈঠকে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়। বৈঠকে শর্ত শিথিলের আহ্বান জানান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। এরপর ৬ মার্চ একটি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প পরিচালক বরাবরে শর্ত শিথিলের আবেদনও করে। ২ মার্চের বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ৮০০ বগি দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বৈঠকে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তিনি জানান, আগে ৫০০ বগি দেওয়ার অভিজ্ঞতার শর্ত ছিল। এ দরপত্রে ৮০০ করা হয়েছে। ৮০০ না করে আরও বাড়ানো কিংবা কমানো হলো না কেন, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। টেন্ডারে অংশগ্রহণে আগ্রহী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ধারণা করছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা করে দিতেই এমন শর্তারোপ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে ইন্দোনেশীয় প্রতিষ্ঠান পিটি ইনকা তিনবার বগি সরবরাহের কাজ পায়। ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোট ৪৫০টি বগি কেনা হয়। ওইসব বগির অগ্নিপ্রতিরোধ সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম