সাক্ষাৎকার: এবি ব্যাংক এমডি
খেটে খাওয়া মানুষ টাকা মারে না
স্মার্টকার্ডে সরাসরি ঋণ পাচ্ছেন কৃষক * জামানতবিহীন ঋণে কৃষকের আনন্দ অশ্রু
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খাদ্য উৎপাদনে কৃষির বিকল্প নেই। এতে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রান্তিক কৃষক সহজ শর্তে ঋণ পান না। ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। সম্প্রতি কৃষি উন্নয়ন ও অর্থায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। সেখানে অন্যতম সহচর হিসাবে এগিয়ে এসেছে ব্যাংকগুলো। আর ডিজিটাল মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষকে
জামানতবিহীন কৃষি ঋণ দিচ্ছে এবি ব্যাংক। অর্থাৎ স্মার্টকার্ডে সরাসরি ঋণ পাচ্ছে কৃষক। জামানত ছাড়া ঋণ পেয়ে অনেক কৃষক আনন্দে আত্মহারা। এমন ঋণের বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারিক আফজাল। তারমতে, ব্যাংক খাতে বড় সমস্যা উচ্চ খেলাপি ঋণ। বিশেষ করে খাতটিকে বিপদে ফেলেছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা।
এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দিতে হবে ছোট ছোট ঋণ। যার ভোক্তা হবেন প্রান্তিক মানুষ ও গ্রামীণ কৃষক। এসব খেটে খাওয়া মানুষ কখনও ব্যাংকের টাকা মারেন না। প্রায় ৯৮ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা ঋণের টাকা ফেরত দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-হামিদ বিশ্বাস।
যুগান্তর : কৃষি ঋণ বিতরণে হঠাৎ বাড়তি আগ্রহের কারণ কী?
তারিক আফজাল : বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান চালিকা শক্তি কৃষি খাত। দেশের উন্নয়ন করতে হলে কৃষকের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দরকার কৃষকের মাঝে প্রয়োজনীয় ঋণ বিতরণ। বিশেষ করে পল্লি অঞ্চলে ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করা। আর কৃষকের মাঝে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হলেই কৃষি উৎপাদন বাড়বে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে।
পাশাপাশি কৃষিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশের বেকারত্ব কমবে। একটা পর্যায়ে দেশের দারিদ্র্যের হার কমে আসবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে কৃষির জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকের মাঝে বিতরণ করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো নিজস্ব তহবিল থেকেও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে।
যুগান্তর : কৃষি ঋণ বিতরণে এবি ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই?
তারিক আফজাল : দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। আর বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি অভিঘাতে জর্জরিত, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসাবে সহজ শর্তে কৃষি ঋণ বিতরণে বিশেষ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে কৃষকদের ঋণ বিতরণে এগিয়ে রয়েছে এবি ব্যাংক। পাশাপাশি এবি ব্যাংক নিজস্ব তহবিল থেকেও কৃষি ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকটি প্রান্তিক এবং ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে জামানতবিহীন এবং সহজ শর্তে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে সরাসরি ঋণ প্রদান করছে। এমনকি এবি স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে কোনো ঝামেলা ছাড়াই কৃষকের মাঝে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
যুগান্তর : স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বাস্তব অনূভূতিটা কেমন?
তারিক আফজাল : এবি ব্যাংক কৃষকদের মাঝে স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে কৃষি ঋণ বিতরণ শুরু করে গোপালগঞ্জ জেলায়। শেখ ফজলুল হক মনি আউটার স্টেডিয়ামে এ ঋণ বিতরণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। চার শতাধিক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়।
এ ঋণ বিতরণে সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। শুধু স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়ে ঋণ পেয়ে অনেক কৃষক আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন। ঋণ পাওয়ার পরে ছবি তুলতে কেউ কেউ সংকোচ বোধ করেছেন। কারণ অনেকের পরনে ছিল লুঙ্গি। এরপর বরিশাল বিভাগেও একই পদ্ধতিতে ১০৩ জন কৃষককে ঋণ দেওয়া হয়।
যুগান্তর : জামানতবিহীন ঋণের ঝুঁকি কিভাবে দেখছেন?
তারিক আফজাল : স্মার্টকার্ডে ঋণ পেয়ে কৃষকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন। তারা ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করবেন। হাস-মুরগি পালন করবেন। কোনো না কোনো উৎপাদন কাজে ব্যবহার করবেন। কৃষকদের প্রত্যয় উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছে। তারা টাকা সময়মতো ফেরত দেবেন। কেউ মনে হয় না খেলাপি হবেন। তাদের ঋণ আদায় নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কারণ কৃষকের উন্নয়ন হলেই দেশের উন্নয়ন হবে। প্রয়োজনে তাদের ঋণের অঙ্ক বাড়ানো হবে। অল্প ঋণের ঝুঁকি নিয়ে ভাবার তো কিছু নেই। বরং বড় ঋণ নিয়ে ঝুঁকি বেশি।
যুগান্তর : গোপালগঞ্জের গিমাডাংগায় নাকি ক্রেডিট কার্ড বিতরণ করেছেন?
তারিক আফজাল : বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত বিদ্যাপীঠ হিসাবে গিমাডাংগা (জি.টি) মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গিমাডাংগা (জি.টি) উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকমণ্ডলীর মাঝে সহজ শর্তে ক্রেডিট কার্ড প্রদান করা হয়েছে। এটা এবি ব্যাংকের করপোরেট কাজের অংশ। তবে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির স্কুলের শিক্ষকদের ক্রেডিট কার্ড দিতে পেরে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে।
যুগান্তর : ব্যাংক খাতের মূল চ্যালেঞ্জ কী?
তারিক আফজাল : ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই বড় চ্যালেঞ্জ। এটি খুবই প্রয়োজন। এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ের বিকল্প নেই। এজন্য ঋণ বিতরণ ও আদায়ে মনে রাখতে হবে কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নন। বড় বড় ঋণ নিয়ে এবং অর্থ আত্মসাৎ করে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা জানে টাকা মেরে দিলে কিছুই হয় না। শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে মামলা করেছি। কিন্তু মামলার ভবিষ্যৎ কী? কোর্ট রায় দিচ্ছেন না। কীভাবে টাকা আদায় করব?
এটি বিচারাধীন বিষয়। আদালতকে অবশ্যই অর্থ ঋণের এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে, যাতে টাকা পুনরুদ্ধার করা যায়। সবাই ব্যাংক, ব্যাংকারদের ওপর দায়ভার দেন। কিন্তু ব্যাংকের তো কোনো দায় নেই। মামলার রায় না হলে ব্যাংক টাকা আদায় করবে কীভাবে? ট্রায়াল কোর্টের সংখ্যাও কমে গেছে। চট্টগ্রামের ট্রায়াল কোর্ট ছিল তিনটা, এখন আছে একটা। সিলেটে একটাও ট্রায়াল কোর্ট নেই। ট্রায়াল কোর্ট বাড়াতে হবে।