
প্রিন্ট: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৭ এএম
অষ্টগ্রামের পনিরের কদর বিশ্বজুড়ে
মোগল দরবার থেকে বাংলাদেশ-ভারতের সরকারপ্রধানদের পছন্দের তালিকায় পুষ্টিগুণসম্পন্ন দুগ্ধজাত এ খাবার

এটিএম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
‘হাওড়-বাঁওড় মাছে ভরা, কিশোরগঞ্জের পনির সেরা।’ এটি শুধু স্লোগান নয়। এ স্বীকৃতি এখন জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় উপজেলা অষ্টগ্রামের গরু ও মহিষের দুধের তৈরি সুস্বাদু-মুখরোচক এবং অসাধারণ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার পনির প্রথমে ষোড়শ শতকে মোগল দরবারের খাদ্য তালিকায় স্থান পায়। এখনো বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারপ্রধানদের পছন্দের তালিকা দখল করে আন্তর্জাতিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেছে এ দুগ্ধজাত খাবারটি। তবে, এ শিল্পের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যক নারী-পুরুষের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি বলে মনে করেন ইতিহাস ঐতিহ্যের সংগ্রাহক ও সমাজ গবেষক ইতিহাসবিদরা।
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে তৈরি ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত দুগ্ধজাত খাবার পনিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে দেশ বিদেশে রপ্তানিরও সুযোগ বেড়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় জনপদ অষ্টগ্রামের পনিরের খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি চার শতাধিক বছরের ঐতিহ্যে লালিত।
স্থানীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও গণমাধ্যম কর্মী দেবব্রত চক্রবর্তী বলেন, ষোড়শ’ শতকে মোঘল সম্রাটের এক বিশেষ বাহিনী অষ্টগ্রামে আস্তানা গেড়ে অবস্থান নেয়। তাদেরই একজন ঊর্ধ্বতন ছিলেন দেলোয়ার খানের ছেলে পনির খান। তিনি এখানকার হাওড়ে অসংখ্য গরু মহিষের বাথান দেখে হতবাক হন। এক পর্যায়ে তিনি নিজ হাতে গরু-মহিষের দুধ দিয়ে এ দুগ্ধজাত খাবার তৈরি করেন। এ খাবার মোগল সম্রাটের দরবারেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠলে তিনি নিয়মিত পাঠাতে থাকেন। পনির খানের হাতে তৈরি বলেই এ দুগ্ধজাত খাবারের নামকরণ করা হয় পনির হিসাবে। আর তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এ এলাকার মানুষ ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পনির তৈরির কাজ শুরু করে। কালক্রমে অষ্টগ্রাম উপজেলার কারবালাহাটি গ্রামটি যেন হয়ে ওঠে পনির পল্লি হিসাবে। এ গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার এখন এ শিল্পকে জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসাবে বেছে নিয়েছে। পরবর্তীতে অষ্টগ্রামের অন্যান্য গ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে বিস্তৃত হতে থাকে এ শিল্পকে জীবিকা করার পরিধি।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ হাওড় জনপদের সন্তান হওয়ার সুবাদে এবার মোগল দরবারের পর বঙ্গভবন, গণভবন এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসবভন জনপথ ভবনেও ঠাঁই পায় অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পনির।
সরকার ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন হাওড় উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন অলওয়েদার সড়কপথ নির্মাণ প্রকল্প শেষ করে। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাওড়ের অলওয়েদার সড়কপথ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অষ্টগ্রামের এ প্রসিদ্ধ পনিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি বিদেশে এ পনির রফতানির অপার সম্ভাবনার কথাও শোনান।
শনিবার কিশোরগঞ্জের হাওড় উপজেলা অষ্টগ্রামের কারবালাহাটি গ্রামের পনির পল্লি সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় বিভিন্ন বাড়িঘরে এবং বাড়ির উঠোনে অগোছালোভাবে পনির তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। এ সময় কথা হয় সবচেয়ে বেশি পনির উৎপাদনকারী নিশান আহমেদ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, ছানা তৈরি করে এক কেজি পনির তৈরি করতে আট কেজি গরুর দুধ অথবা সাত কেজি মহিষের দুধ লাগে। আর এসব পনির আট থেকে নয়শ টাকা কেজি বিক্রি করা যায়। হাওড়ে দৃষ্টিনন্দন অলওয়েদার সড়ক পথ তৈরি হওয়ার ফলে ছুটির দিন হাওড়ে পর্যটকদের ঢল নামে। তাদেরও পছন্দের তালিকায় এ পনির ঠাঁই পাওয়ায় বাড়িতে বসেও অনেক পনির বিক্রি করা যায়।
এ সময় তিনি আরও জানান, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ হাওড়াঞ্চলের সন্তান হওয়ায় তার মাধ্যমে তিনি বঙ্গভবন, গণভবনের পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেও তার তৈরি পনির পাঠাতে পেরেছেন। তাদের প্রত্যেকেই এ পনির খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। তবে, এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গরু ও মহিষের পাল বিত্তশালী লোকজনের হওয়ায় তাদের কাছ থেকে দুধ কিনে এনে পনির তৈরি করতে হয়। দুধের জন্য গরু মহিষ কেনাসহ পনির তৈরিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প রূপ দিতে তিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।
অষ্টগ্রাম সরকারি রোটারি ডিগ্রি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান সমাজ গবেষক ও ইতিহাসবিদ সহকারী অধ্যাপক সৈয়দা নাসিমা আক্তার রীতা যুগান্তরকে জানান, অষ্টগ্রামে তৈরি এ পনির বিভিন্নভাবে দেশ-বিদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে এ কথা সত্যি। তবে এ শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক ভিত্তিতে ছড়িয়ে দিতে সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরি হয়ে ওঠেছে।