সাক্ষাৎকার- ঢাকা ওয়াসার এমডি
আমার স্ত্রী-সন্তান সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের আয় দিয়ে আমার মতো দু-চারজনকে পুষতে পারে
ওয়াসার আয়-ব্যয়ের অনুপাত আন্তর্জাতিকমানের * নমুনা পরীক্ষায় ৯৪ শতাংশ জায়গায় পানি সুপেয়
কায়েস আহমেদ সেলিম
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা ওয়াসাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, নগরবাসীর জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ওয়াসাকে ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। এর অংশ হিসাবে ঢাকাকে ১৪৫ ভাগে বিভক্ত করে পানি বণ্টনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত করতে পানির সিস্টেম লস কমিয়ে আনা হয়েছে। এক সময় গ্রাহক বিলের ৩৬ শতাংশ জলে গেলেও এখন আদায় হয় শতভাগ। রাজধানীর কাওরান বাজার ওয়াসা ভবনের নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তাকসিম এ খান এসব কথা বলেন। তবে ওয়াসাকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রচেষ্টার মধ্যেই একটি স্বার্থান্বেষী মহল তার পেছনে লেগেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। ওয়াসা এমডি বলেন, সরকারের অর্জন ধ্বংস করতে
ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর রয়েছে।
ওয়াসার বিরুদ্ধেও মিথ্যাচারে মেতেছে চক্রটি। আমার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনার মতো জঘন্য মিথ্যাচার তারই অংশ। ১৪টি বাড়ি কেনার যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে তা ডাহা মিথ্যা, বানোয়াট গল্প ও হাস্যকর। বিগত ১৩ বছরে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও কোনোটিই প্রমাণিত হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তাকসিম এ খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কিছু কিনতে হলে ক্রেতার সব তথ্যই ডকুমেন্টেড হতে হয়। যে বাড়িগুলোর সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলোর একটিও আমার নয়। তবে একটিমাত্র অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, যেটি আমার স্ত্রীর। সেখানে আমার স্ত্রী-সন্তান সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের আয় দিয়ে আমার মতো দু-চারজনকে পুষতে পারে। কাজেই আমার এখান থেকে কোনো অর্থ পাঠানোর দরকার নেই। বরং তারাই মাঝেমধ্যে এখানে গিফট ও সহযোগিতা পাঠায়। তিনি বলেন, এখানে তাকসিমের পেছনে লাগা মানে কোনো ব্যক্তির পেছনে লাগা নয়, এটি ওয়াসা তথা সরকারের বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষী মহলের স্পষ্ট ষড়যন্ত্রের অংশ। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। সরকারের অর্জনগুলো যারা স্বীকৃতি দেয় না, বরং ধ্বংস করতে চায়, তারাই এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। ওয়াসায় মঙ্গলজনক যা যা হয়েছে, সেগুলো ধ্বংস করতে এগুলো করা হচ্ছে। এটা অবশ্যই নিন্দনীয়। তাকসিম এ খান বলেন, আমার জীবনের সব উপার্জন হালাল। আমি কখনো হারাম পয়সা খাইনি। আমেরিকায় যে আয় ছিল তা-ও হালাল, এখানে যে উপার্জন তা-ও হালাল। ভবিষ্যতের উপার্জনও হালাল হবে। আমি কোনো অর্থ পাচারে জড়িত নই। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর আগেও তদন্ত করেছে। তদন্তে এসব অভিযোগ ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।
ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বাস্তবায়ন : ওয়াসার এমডি বলেন, পানি ব্যবস্থাপনাকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে প্রধানমন্ত্রীর তাগিদ ছিল। এ কারণে ওয়াসা অ্যাক্ট-১৯৯৬ পাশ হয়। এই আইনের আওতায় বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা, চট্টগ্রাম ওয়াসা, খুলনা ওয়াসা ও রাজশাহী ওয়াসা কাজ করছে। ভবিষ্যতে যখন শহর বড় হবে, তখন ওই শহরের আইনের আওতায় একটি করে ওয়াসা হবে। সরকারের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা আছে। অন্যান্য সংস্থা যেখানে যেসব বিধির আওতায় কাজ করে, ওয়াসা সেসব বিধির আওতায় কাজ করে না। ওয়াসা কাজ করে ওয়াসা অ্যাক্ট-১৯৯৬ আইন অনুসারে। ১৯৯৬ সালে দেশে প্রথমবারের মতো ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সায়েদাবাদ-১) করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে আমরা পানি সরবরাহ করতাম। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ভূউপরিস্থ পানিকে শোধন করার যে সিস্টেম তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম করে দেখিয়েছেন। ২০১০ সালে যখন সায়েদাবাদ-২ উদ্বোধন করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারই ১৯৯৬ সালে প্রথম ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করেছিল, এরপর আর হয়নি। আমরা ভবিষ্যতে আরও একটি প্ল্যান্ট করব।’
নমুনা পরীক্ষায় ৯৪ শতাংশ স্থানে সুপেয় পানি : পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ওয়াসাকে রিফরম করতে বলা হয়। এরপর ২০১০ সালে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় বলে জানান তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে আইন অনুসারে। কিন্তু ওই সময় আইন অনুসারে চলছিল না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা সেভাবেই যাত্রা শুরু করি এবং দুটি মাস্টারপ্ল্যান করি। তিনি বলেন, কোনো প্রকল্পই আমাদের ইচ্ছেমতো নেওয়া হয়নি। প্রজেক্ট মাস্টারপ্ল্যানে আছে, আমরা ক্রমান্বয়ে তা বাস্তবায়ন করছি। এর ফলে আমাদের রাজধানীতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ২০০৮-০৯ সালে ঢাকা শহরে পানির হাহাকার ছিল। ওই সময় মাত্র ৬০ শতাংশ নগরবাসী পানি পেতেন। তখন ঢাকা শহরে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ ছিলেন। পানি না পেয়ে সে সময় কলসি মিছিল ও ঝাড়ু মিছিলও হতো। জনপ্রতিনিধিদের হেনস্তার শিকার হতে হতো। এমনকি ওই সময় পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য সেনাবাহিনী নামানো হতো। বর্তমানে শতভাগ লোক পানি পাচ্ছেন। টেকনিক্যাল ফল্ট ছাড়া শতভাগ পানি পাচ্ছেন সবাই। ২০১০ সালের পর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য আর কোনো দিনও সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথমে পানির কোয়ান্টিটি নির্ধারণ করেছি। এরপর পানির মান উন্নত করেছি। এখন শতকরা ৯৫ ভাগ জায়গায় পানযোগ্য পানি। এখানে আমরা ড্রিংকিং ওয়াটার তৈরি করি না। আমরা ওয়াসা আইন অনুসারে পানযোগ্য পানি তৈরি করি। বাকি ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও পানির পাইপ ফেটে যায়, ময়লা ঢুকে। কোনো কোনো স্থানে সমস্যা হলে ১৬১৬২ নম্বরে কল করলে তাৎক্ষণিক সমাধান করে দেওয়া হয়। এমনকি হাইকোর্টের রুল অনুসারে পানির নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৯৪ শতাংশ জায়গায় সুপেয় পানি রয়েছে। বাকি ৬ শতাংশ স্থানের সমস্যাগুলো সমাধান করে পরে হাইকোর্টে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার পরিবেশবান্ধব নয়। বেশি বেশি পানি উত্তোলন করলে ভূমিধস হতে পারে। এজন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৭০ ভাগ পানি আমাদের আসবে সারফেস থেকে, বাকি ৩০ ভাগ আসবে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে। আমরা সায়েদাবাদ-২, পদ্মা জশলদিয়া, ভাকুরদা, সায়েদাবাদ-৩ শুরু করেছি যা শেষ হয়নি, গন্ধবপুর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করা হচ্ছে।
ওয়াসার সফলতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি লাঘব : তাকসিম এ খান বলেন, ডিজিটালাইজেশন অব ওয়াটার ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক আমরা করেছি। পানির সিস্টেম লস আমাদের মতো শহরগুলোতে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রোগ্রামের মতে, পানির সিস্টেম লস হওয়া উচিত ২৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে পানির সিস্টেম লস ছিল ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। আমাদের টার্গেট ছিল ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। প্রথমে সিস্টেম লস ২০ শতাংশে নামিয়েছি। এরপর ডিএমএ করার পর তা নেমেছে ৫ থেকে ৬ শতাংশে। পানির সিস্টেম লস দুই ডিজিটের নিচে নামার নজির দক্ষিণ এশিয়ার কোনো শহরে নেই। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এটিকে ‘গ্রেট সাকসেস’ বলেছে। ওয়াসার এমডি বলেন, আগে আমাদের বিলের (আয়) ৬৪ শতাংশ টাকা উঠে আসত। অর্থাৎ ৩৬ শতাংশ রেভিনিউ আমরা পানিতে ফেলতাম। দুর্নীতির ঘটনা তো এখানেই। এখন রেভিনিউ অর্জন শতভাগ। অর্থাৎ ১০০ টাকা বিল হলে এখন ১০০ টাকাই আদায় হয়। ওই সময় মোট আয় হতো ৩০০ কোটি টাকা। মূলত আয় হতো ৪৫০ কোটি টাকা। আর ১৫০ কোটি টাকা গায়েব হতো। এখন আয় হয় ২ হাজার কোটি টাকা। যদি ওয়াসা রিফরম না করে চুরি বহাল রাখা হতো তাহলে ওই আয় হয়ে যেত ১৩০০ কোটি টাকা। ৭০০ কোটি টাকা গায়েব হতো। এটাই হলো দুর্নীতি লাঘবের প্রমাণ।