প্রদীপের নিচে অন্ধকার
নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেননি রামগড়ের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রদীপ কুমার * নিকটাত্মীয় প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়

সমির মল্লিক, খাগড়াছড়ি
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্ব প্রদীপ কুমার কার্বারী ত্রিপুরা রামগড় উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকও। সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও খাগড়াছড়ির সংসদ-সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ভাগনিজামাই হওয়ার সুবাধে প্রভাব খাটিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেননি তিনি। নাম বিশ্ব প্রদীপ হলেও ভেতরে ছিল ঘোর অন্ধকার। তার দখলবাজিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্থানীয় সংখ্যালঘুরাও। নিজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য শত বছরের মন্দির ও প্রতিবেশীর জায়গা দখল করে সরকারি প্রকল্পে রাতারাতি পাকা রাস্তা বানিয়ে করেছেন জায়গা দখল। কাজ না করে কালী মন্দিরের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকাও আত্মসাৎ করেছেন। অন্যের জমি দখল করে তিনি কয়েকশ একর পাহাড়-টিলায় গড়ে তুলেছেন ফলদ বাগান। প্রায় ১০৫ বছর আগের প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী দক্ষিণেশ্বরী রামগড় কালী মন্দিরের জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বরাদ্দকৃত প্রায় ৩২ লাখ টাকার কোনো কাজ না পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেছেন। আ.লীগ নেতা বিশ্ব প্রদীপ কুমার ত্রিপুরার সাড়ে ১৫ বছরের নানা অপকর্মের প্রতিবাদ এতোদিন করতে না পারলেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষ এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। স্থানীয় জগন্নাথপাড়ার বাসিন্দা মৃণাল কান্তি শীল বলেন, ‘সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ ত্রিপুরা রাতারাতি জোরপূর্বক আমাদের বসতবাড়ির জায়গা দখল করে তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তা বানিয়েছেন। আমরা এর কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি।’ এলাকার ভুক্তভোগী এক নারী জানান, ‘বিশ্ব প্রদীপ আমার জায়গা দখল করে নিয়েছেন। তার ক্ষমতার কারণে আমরা কিছু বলতে পারিনি।’ স্থানীয় বাসিন্দা দিলীপ দত্তসহ আরও অনেকে অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ব প্রদীপ ক্ষমতার দাপটে এলাকার একটি খাল ভরাট করায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে এক ধরনের বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। এতে শত শত মানুষের ক্ষতি হয়েছে। বর্ষায় খালের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় রাস্তা ভাঙা শুরু হয়েছে। তিনি ক্ষমতার দাপটে অনেক মানুষের ক্ষতি করেছেন।’ শ্রীশ্রী দক্ষিণেশ্বরী রামগড় কালী মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক শুভাশিষ দাস বলেন, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে পুরোহিত শেড নির্মাণের জন্য প্রায় ৩২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। সেটির ঠিকাদার ছিলেন বিশ্ব প্রদীপ কার্বারী নিজে। কিন্তু প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করে কোটি টাকার বাণিজ্য, পাহাড় কেটে মাটি বিক্রির সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। এভাবে শত কোটি টাকার সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। তার মামাশ্বশুর সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার প্রভাব খাটিয়ে সরকারি অর্থে বাগান, সোলার প্যানেল স্থাপন, রাস্তা, বৈদ্যুতিক লাইনসহ নানা প্রকল্প নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা জেলা আ.লীগের নেতৃত্বে আসার পর বিশ্ব ত্রিপুরা এখানে রামরাজত্ব কায়েম করেছেন। বিভিন্ন দপ্তরের দরপত্র অনুযায়ী কাজ না করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অর্থ আগেই উত্তোলন করে নিয়েছেন। প্রকল্প আছে কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয়দের বঞ্চিত করে নিজের বাগানে যাওয়ার রাস্তা নির্মাণ করেছেন। তার বাগানে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করেছেন। টিআর, কাবিখা প্রকল্পের অর্থও তিনি আত্মসাৎ করেছেন। চিনছড়িপাড়া, তৈচালাপাড়া, পাতাছড়া ও খাগড়াবিল এলাকার মানুষের অন্তত ৫০০ একর জমি তিনি এবং তার স্ত্রীর নামে দখল করা হয়েছে।’ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাস্টিট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানায় তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এরপর থেকে পলাতক রয়েছেন বিশ্ব প্রদীপ কার্বারী ত্রিপুরা। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।