বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড
চাই আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন
ডা. কামরুল হাসান খান
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিশ্ব ইতিহাসে এক ঘৃণ্য, নিষ্ঠুরতম ঘটনা। যিনি সারা জীবন বাঙালি জাতির মুক্তি, স্বাধীনতা, সুন্দর-সমৃদ্ধ জীবনের জন্য ব্যয় করেছেন, তাকে সেই জাতির কতিপয় হিংস্র দানব নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আর এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা একটি জাতির স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। কেন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল? এ নিয়ে গবেষণা চলছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চিত উপসংহারে পৌঁছানো যায়নি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে বেশকিছু ধারণা পাওয়া গেছে। তবে এ নিয়ে দ্রুত একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, এরকম হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধকল্পে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি মসৃণ পথ তৈরির লক্ষ্যে।
বাঙালির অধিকার, স্বাধীনতা না চেয়ে বঙ্গবন্ধু অনায়াসে হতে পারতেন মোনায়েম খাঁর পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। ’৭০ সালের নির্বাচনের পর তিনি হতে পারতেন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, অর্থ চাইলে ছয় দফার বিনিময়ে গ্রহণ করতে পারতেন জেনারেল আইয়ুব খানের ব্ল্যাংক চেক, হতে পারতেন জেনারেল মোটরস কোম্পানির ৪৯ পারসেন্টের মালিক এবং পূর্ব পাকিস্তানের সোল এজেন্ট। তাকে এসবের কিছুই দিতে পারেনি; কারণ, তিনি কেবল চেয়েছেন বাঙালির স্বাধীনতা-বাংলার মানুষের সুখী-সমৃদ্ধ জীবন, যে কারণে তাকে বাঙালি জাতির জন্য সমগ্র জীবনের পরে প্রাণটাও দিতে হলো।
’৪৭ এ দেশ বিভাগের পর থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালিদের অধিকার অস্বীকার করে আসছিল। অবশেষে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকার অর্থাৎ স্বাধীনতা আদায়ে চূড়ান্ত নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তান সরকার বারবার বাঙালিদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমাদের প্রাপ্য অর্থ-সম্পদ প্রতারণা করে ফেরত দেয়নি। তারা বারবার তাদের এ দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানাতে চেয়েছে। নানাভাবে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন কাজে পাকিস্তানের এ দেশীয় এজেন্টরা বিরোধিতা করে যাচ্ছে, নানা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারী পাকিস্তান রক্ষায় তৎকালীন সরকারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে কাজ করেছে, কিন্তু স্বাধীনতার পর তারাও বহাল তবিয়তে ছিল। অপরাধবোধ এবং প্রতিনিয়ত ধরা পড়ার শঙ্কায় ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারাও সুযোগের ব্যবহার করে। কিছুসংখ্যক পাকিস্তানফেরত কর্মচারী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
বঙ্গবন্ধু ঘুণাক্ষরে চিন্তা করতে পারেননি যে, কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে। ‘এক বিদেশি সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার কোয়ালিফিকেশন কী? তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন-I love my people . What is your disqualification? জবাবে তিনি বলেছিলেন, I love them too much. যে কারণে অনেক সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি তার নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন এ অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং বিশ্বাস কিছুটা উপেক্ষা করে নিরাপত্তার বিষয়ে একটু নজর দিতেন, তাহলে জাতি পিতৃহারা হতো না এবং অল্প সময়ে বাংলাদেশ হতো বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রতি হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত বিরাগ দালিলিকভাবে প্রমাণিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার বিশ্বাস ছিল না। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকেই সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব-গুঞ্জন ঢাকা, ইসলামাবাদ ও দিল্লির মার্কিন দূতাবাস এবং ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ ডেস্ক কর্মকর্তাদের আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছিল। কিসিঞ্জার নিবিড়ভাবে এসব পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ১৯৭৫ সালের মার্চে ‘অভ্যুত্থানের গুজব’ নিয়ে মার্কিন দূতাবাস খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এসব বিষয়ে প্রকাশিত মার্কিন দলিলে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকারের অগোচরে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আলোচনা করতে। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই একইভাবে সংগ্রহের জন্য যায় ফারুকের ভায়রা মেজর আবদুর রশিদ।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃতে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠন প্রশ্নে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের সঙ্গে ‘পূর্ব যোগাযোগ’ ঘটেছিল। হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭৯ সালে তার ‘হোয়াইট হাউজ ইয়ারসে’ লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত এলকে ঝায়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিল। ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন সম্পৃক্ততার বিষয়টিকে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ একাত্তরের ওই ‘পূর্ব-যোগাযোগের’ আলোকেই দৃঢ় ভিত্তি দিতে সচেষ্ট হয়েছেন।
নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ১৯৮১ সালে লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ আর যাই হোক, সেটা খাদ্য কমে যাওয়ার কারণে ঘটেনি। তবে ওই সময়ে বাংলাদেশকে খাদ্য না দিতে মার্কিন প্রশাসনের রাজনীতিটাও অস্বীকার করা যাবে না।’ অধ্যাপক রেহমান সোবহান লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এক প্রকট দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে খাদ্য সাহায্যকে ব্যবহার করল। সেই চাপ ছিল এমন একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার জন্য, যার ফসল হলো ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তন।’ এমা রথচাইল্ড ১৯৭৬ সালে লিখেছেন, ‘কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রদ না করা পর্যন্ত মার্কিন খাদ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।’
সেসময়ের ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ ঘটনার কিছুদিন আগে মেজর ডালিম এবং মেজর নুরসহ কিছু অফিসারের সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানিয়েছিলেন। এরপর ব্রিগেডিয়ার রউফের আর কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি। ১৪ আগস্ট বিকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সব প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে শেষ বৈঠক, নাইট প্যারেডের নামে সেনা সমাবেশ, অস্ত্রাগার খুলে দিয়ে অস্ত্র ও গুলি বিতরণ, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা, সেনাদের উদ্দেশে ব্রিফিং, ট্যাংকসহ বিকট শব্দে ক্যান্টমেন্টের ভেতর দিয়ে দীর্ঘসময় যাতায়াত, সবকিছু প্রকাশ্যেই হয়েছে। যাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তারা কেন কিছুই জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি, বুঝতে চায়নি-এটি একটি বড় প্রশ্ন।
১৯৭৫ সালের মার্চে কুমিল্লা বার্ডের গোপন বৈঠক, ’৭৫-এর জুনে মোশতাকের গ্রামে, জুন-জুলাইয়ে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে, মোশতাকের আগামসী লেনের বাসায় কিছু রাজনৈতিক-আমলা-সেনাসদস্যদের এত প্রকাশ্য বৈঠক গোয়েন্দা নজরদারি কীভাবে এড়িয়ে গেল।
অবশ্যই প্রশ্ন আছে, কেন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাসদস্যদের কাছ থেকে সব গুলি নিয়ে যায়? কেন সেনাসদর, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং গণভবনে বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করার চেষ্টা করে কাউকে পেলেন না? যাদের পেলেন একমাত্র কর্নেল জামিল ছাড়া অন্য কেউ ঘণ্টাখানেক সময় পেয়েও কেন কোনো পদক্ষেপ নেননি? এসবের জবাব নতুন প্রজন্মকে পেতে হবে।
কেন একটি দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এবং রাষ্ট্রপতির সব নিরাপত্তা বাহিনীগুলো তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে গেল? এসব প্রশ্নের জবাব একদিন দেশের মানুষের সামনে কাউকে না কাউকে উন্মোচন করতে হবে। নতুন প্রজন্ম গবেষণা আশ্রয়ী, সত্য আশ্রয়ী, ইতিহাস আশ্রয়ী-এসবের জবাব একদিন তারা খুঁজে বের করবেই।
২০২৩ সালের শোকের মাসে জনতার দাবি :
১. আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে : বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র রক্ষা, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চিরতরে বন্ধ করার জন্য একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে কোনো পরিস্থিতিতেই এর কার্যক্রম বাধাপ্রাপ্ত না হয়। এটি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জাতীয় বেইমানদের সঙ্গে অনেক আন্তর্জাতিক মহল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়ে লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃতে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করেছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আপ্রাণ চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পাননি বলে সে বিচার করা যায়নি।
২. বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামিদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে।
ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলবে-এটাই নিয়ম, কিন্তু অন্ধকারাছন্ন জায়গাগুলো আলোকিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
ডা. কামরুল হাসান খান : অধ্যাপক , সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়