ভোটের অধিকারের জন্য রাজপথে নেমেছিলাম
ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
কোটা সংস্কারের যে দাবি নিয়ে প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়, তখন এর সঙ্গে আমি খুব একটা সম্পৃক্ত ছিলাম না। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে যখন ১ জুলাই থেকে অসহযোগ আন্দোলনে নামে ছাত্রসমাজ, তখন রাজপথে না থাকলেও তাদের প্রতি একটা সমর্থন ছিল। চার দফা দাবিতে তখন শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে ৮ জুলাই আমার ফেসবুক পেজে ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ শিরোনামে আমি একটা গান প্রকাশ করি। তখনো সেভাবে আন্দোলন নিয়ে কথা বলিনি। যে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা, আর তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়, সেদিন কথা বলতে বাধ্য হয়েছি। যখন দেখেছি তাদের মেরে রক্তাক্ত করে হাসপাতালে পাঠানো হলো, আবার সে হাসপাতালে গিয়েও ছাত্রলীগ আহতদের পেটাল, তখন আর চুপ থাকতে পারিনি। তখনো আমি রাজপথে নামিনি, তবে প্রতিবাদ করেছিলাম, আওয়াজ তুলেছিলাম।
আমাকে ঘর থেকে বের করে আবু সাঈদ। যেদিন রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে রাজপথে গুলি করে মারে পুলিশ, সেদিন আমি আমাকে আর ঘরে আটকে রাখতে পারিনি। এর মধ্যে ছয়-সাতজনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে গেছি। টিএসসিতে তাদের গায়েবানা জানাজা হওয়ার কথা ছিল। সে জানাজায় মানুষকে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। টিএসসিতে জলকামান বসিয়েছে পুলিশ। কিন্তু কোনো অবস্থায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে পারে না তারা। কোনো অবস্থায় ছাত্রদের মারা যায় না। কিন্তু তবুও মানুষ মারা হয়েছে। আমি রাজপথের মানুষ নই, আমি একজন শিল্পী। কিন্তু তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, এখন যদি রাজপথে না যাই, তাহলে কখন যাব? নিজেই নিজেকে বারবার প্রশ্ন করলাম। রাজপথে নামলাম, ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলাম। এরপর গানে গানে, পথে পথে প্রতিবাদ করে গেলাম। তখনো এক দফার কথা মাথায় আসেনি। এটা ভাবিওনি। এক দফা আমার দাবি ছিল না। আমার দাবি ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট দেব। গ্রহণযোগ্য ভোট দিয়ে তাকে (শেখ হাসিনা) পরাজিত করব। কিন্তু তখন অনুভব করেছি বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ওই মুহূর্তে তাকে চায় না। মানুষের চাওয়াটাই তখন আমার পথ ছিল। আমার পথ বন্দুকের নয়, আমার পথ মানুষকে আক্রমণের নয়, আমার পথ ভোটের। তুমি আমাকে ভোট দিতে দিচ্ছ না, তাহলে আমি কী করব? ভোটের অধিকার তারা আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে রাজপথে থাকব না তো কোথায় থাকব? আমার তো কোনো অস্ত্র নেই।
মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে চলে যায়, সেটার একটা ধাপ আন্দোলনের সময় গভীরভাবে অনুভব করলাম। বাচ্চারা লাঠি নিয়ে রাস্তায় বের হলো, কারণ সেসময় ওদের লাঠি ছাড়া কিছুই ছিল না। সেসময়টা আমার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি ছাত্রদের পক্ষে। আন্দোলনে থাকায় আমাদের ওপর অনেক হুমকি আসছিল। তবে দমে যাইনি। আমরা কয়েকজন (শিল্পী) মিলে একসঙ্গে ছিলাম। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার মতো চিন্তা বা হেরে যাওয়ার চিন্তা কখনো মাথায় আসেনি। শুধু একটা উদ্দেশ্য ছিল, আমার ভোটের অধিকার আনতে হবে। আন্দোলন সময়টাতে গানের প্রতিবাদও জারি রেখেছিলাম। শিল্পী হিসাবে যে কোনো অন্যায়ে এটাই আমার প্রতিবাদের অস্ত্র। আন্দোলনের সময় আমার প্রকাশ করা গান বেশ সাহসও জুগিয়েছিল ছাত্রসমাজকে। তবে সে চিন্তা থেকে গানটি তখন প্রকাশ করিনি। কোনো নির্দিষ্ট বয়সের অডিয়েন্স টার্গেট করে কখনো আমি গান করিনি। আমার গানের ভাবনাগুলো আসে বিভিন্নভাবে। কোনো একটা ঘটনা আমার ভেতর ঘটে, সে ঘটনা প্রেম কিংবা রাজনৈতিকও হতে পারে। সেসব বিষয় আমি গানে তুলে আনার চেষ্টা করি। ২০০১ সালের দিকে দুই নেত্রীকে নিয়ে ‘আমিই বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানটি করেছিলাম। তখন জেন-জি জেনারেশনের অনেকের জন্মও হয়নি। কিন্তু এখনো তারা এ গানটি শুনছে। সেটি আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার ভাবনা প্রকাশ করাটাই ছিল মুখ্য এখানে। কিন্তু জেন-জি গানটির সঙ্গে রিলেট করতে পেরেছে। আমার গান তৈরির সময় অডিয়েন্সের বয়স কিংবা তাদের মনোরঞ্জনের চিন্তা মাথায় থাকে না। তবে ‘আমিই বাংলাদেশ’ গানটি নতুন করে এ সময়ে এসে মানুষ পছন্দ করেছে, এটি আন্দোলনে একটা প্রভাবও ফেলেছে। ছাত্রসমাজের আন্দোলনের সময় নিজের মতো করে নিজের ভাষায় অনেকেই গান প্রকাশ করেছে। তাদের সে গানগুলোর অবদানও আমরা অস্বীকার করতে পারব না। হান্নান, সেজান, পূর্ণির গানগুলোও কিন্তু আমাদের জাগিয়ে তুলেছে। ওরা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
৫ আগস্টের পর নতুন এক বাংলাদেশের সূচনা হলে আমরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। মাত্র ছয় মাস হলো তারা কাজ করছেন। তাদের নিয়ে আমার কোনো কিছু বলার নেই। আমার কোনো আফসোস নেই। সরকার পতনের লড়াইয়ে আমিও ছাত্রদের সঙ্গে ছিলাম, তাই বলে কখনোই বলব না, ওটাই অনিবার্য ছিল, ওটা হতে পারত। আমি এটাও কখনো বলব না যে, আগেই ভালো ছিলাম। ব্যক্তির পতনের পরে কিংবা ক্ষমতাসীন কিছু মানুষের পতনের পর আস্তে আস্তে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে পচনটা ধরেছে। বিষয়টি এমন যে, আপনাকে বলা হচ্ছে আপনি ক্যানসার থেকে মুক্ত, কিন্তু পুরো সিস্টেমটাই ক্যানসারমুক্ত নয়। এদিকে ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে যা হয়ে গেল, সেটা কিন্তু আমাকে আহত করেছে। নতুন বিজয় উদযাপনে একদল ফুর্তি করছে, কিন্তু তখনো অনেক বাচ্চা হাত-পা হারিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। সারা জীবনের জন্য তাদের শোক নেমে এলো। ওদের পাশে থাকাটা দরকার ছিল খুব করে, এদের অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের একটা শোকের দিন দরকার ছিল। ছাত্র আন্দোলন আমাদের জন্য একটি বিরল ঘটনা ছিল। যে বাচ্চারা রাস্তায় নেমেছে, তারা তো কেউ রাজনীতি করতে আসেনি। তাদের এখন খেলাধুলা করার কথা ছিল, তাদের ডিবেট করার কথা ছিল। কিন্তু, তারা রাস্তায় নেমে এসে যে ইতিহাস সৃষ্টি করল তা সত্যিই বিরল। আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ বাচ্চাদের কাছে। এখনো অবাক হয়ে ভাবি, এতটা নিষ্পাপ ও অদলীয় হয়ে এমন অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভব! অনেককেই পরে বলতে শুনেছি, এটা অমুকের কাজ, তমুকের কাজ। এসব কথা শুনে হাসি পায় আমার। মানুষ সবাইকে বিশ্বাস করতে রাজি আছে, কিন্তু তার জনতাকে বিশ্বাস করবে না। জনগণ যে এটা করতে পারে, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। মানুষকে ছোট করা ও শক্তিহীন ভাবার প্রবণতাও আমাদের থামাতে হবে। সংস্কার দরকার খুব জরুরিভাবে। আমাদের মধ্যে অবিশ্বাসের একটা ব্যাপার আছে। আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। ভরসা করতে পারি না। ধীরে ধীরে যেন আমরা সেই রাজনৈতিক পাটাতনের দিকে না যাই, সেদিকে নজর রাখতে হবে। দেশ যেন আবার বিভাজিত না হয়, সেখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। নির্মাণের যাত্রায় আমাদের স্থির থাকতে হবে। দেশ গঠনের সময় দিতে হবে।
সংস্কারের কাজ চলছে। সরকারকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার। দেশ গড়ে বেঁচে থাকতে সবাইকে পরিশ্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। এমন একটা বাংলাদেশ হোক, যেখানে কেউ নিজেকে শক্তিশালী ভাববে না, আবার কেউ নিজেকে দুর্বলও ভাববে না। একজন কৃষক বা শ্রমিকের মাথায় যেন কখনো এ চিন্তা না আসে যে, তার কোনো দাম নেই। অধিকারের লড়াই করে শ্রমিক মরে যাবে, তবুও নেতারা চুপ থাকবেন-এরকম শ্রমিকের সঙ্গে ভৃত্যসুলভ আচরণ যেন আর না থাকে। শ্রমিকের কর্তৃত্বের বোধ থাকবে। নতুন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অধিকার চাই আমি। আমার ভোট আমি দিতে চাই। (বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যের সংকলন; অনুলিখন : রিয়েল তন্ময়)
লেখক : সংগীতশিল্পী