দেশের মানুষ যেন ভোট ও ভাতের অধিকার পায়
ইথুন বাবু
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইতিহাসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নতুন কিছু নয়। ইতিহাসে অনেক বিপ্লব ছিল, যার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষও বিভিন্ন সময় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু এতসব সফলতম আন্দোলনগুলোর মধ্যেও এ আন্দোলন ছিল অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নিজেদের গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপিকে নানাভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিএনপিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। গত ১৫ বছর ধরেই মাঠে দাপটের সঙ্গে কাজ করে গেছে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এ দল। অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলে তার বড়াই বেশিদিন থাকে না। তারই প্রমাণ এ দেশের মানুষ পেয়েছে। জুন থেকেই ছাত্ররা যে যৌক্তিক আন্দোলন নিয়ে মাঠে নেমেছিল। হাসিনা সরকার তাদের অবজ্ঞা-অবহেলা করে বড় ভুলটা করেছিল। তারা ভুলেই গিয়েছিল, প্রত্যেক যৌক্তিক দাবি ও দেশের জনগণের পক্ষে সব সময় বিএনপি আছে।
ছাত্রসমাজের এ আন্দোলন শুরু হওয়ার তিন বছর আগেই আমি সারা দেশে গানের লড়াই শুরু করি। অন্যায়, অত্যাচার, গুম, খুন, হামলা, মামলা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চুরি, ডাকাতি, টাকা পাচার সবকিছু মিলিয়ে স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আমি মাঠে নামতে বাধ্য হই। সাংস্কৃতিক বিপ্লব তৈরি করি। কথায় কথায় দেশটা ওর বাপের এসব কথা শুনে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পাশাপাশি আরেকটা মূল কারণ ও লক্ষ্য ছিল ‘দেশ বাঁচানো’। এরপর ছাত্র-আন্দোলন যখন বিরাট আকার ধারণ করে, ছাত্রদের যখন হাসিনার পুলিশ রাস্তায় গণহারে গুলি করে মারে, তখন দেশের মানুষ এগিয়ে আসে। আমি তখন রাজপথে সোচ্চার। দিন-রাত রাস্তায় পড়ে ছিলাম। হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি কিছুই আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আজ মরতে হবে এ কথাটি মেনে নিয়েই রাস্তায় নেমেছি। প্রতিটা দিন, প্রতিটা ক্ষণ একটাই চাওয়া ছিল-‘হয় মৃত্যু, না হয় মুক্তি’। জুলাই-আগস্ট সময়টা আমার কাছে ছিল ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা। জাসাসের বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হওয়ায় আমার ওপর রাজনৈতিকভাবেই একটা চাপ ছিল। যদি এ আন্দোলনে আমরা সফল না হতাম, তাহলে আজ হয়তো আমি আর কথা বলতে পারতাম না। আমাকে মেরে ফেলা হতো এটা নিশ্চিত। রাজপথে ছিলাম সব সময়, রাজপথে আছি। এখন পরিবর্তিত বাংলাদেশে প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে বা হবে, সেটা রাজপথ বলে দেবে।
’২৪-এ আমাদের ছাত্রসমাজ বুঝতে পেরেছে, আমাদের জনগণ বুঝেছে আমাদের কী করণীয় ছিল। আমরা রাজপথ থেকে আদায় করা শিখে গেছি। ’২৪-এ দেশের ১৮ কোটি জনতা এক হয়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাসিনার পতন ঘটিয়ে এর ফসল ঘরে তুলেছি। এখন দেশ নিয়ে প্রত্যাশা একটাই-দেশে যেন আর অরাজকতা তৈরি না হয়। দেশ যেন সঠিক পথে চলে। আর কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। দুর্নীতির জালে যেন দেশ আর না জড়ায়। দেশের মানুষ যেন তার ন্যায্য অধিকার পায়। শান্তিতে স্বাধীন দেশে বাস করতে পারে। দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক। ভোটের অধিকার ও ভাতের অধিকার ফিরে আসুক। দেশের স্বার্থে সবাইকেই এখন একমত হয়ে কাজ করতে হবে। বিশ্বের বুকে আমাদের দেশ যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে এর জন্য আমাদের দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখন কাজ করতে হবে। পরিবর্তিত বাংলাদেশে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা অটুট থাকবে এটাই চাইব। দেশে আইনের শাসন যেন প্রতিষ্ঠা পায় ও মানুষের কথা বলার অধিকার যেন খুঁজে পায়। ছয় মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। তাদের প্রতি আমাদের সহযোগিতা সব সময় থাকবে। তারা দেশ সংস্কারের কাজ করতে চাইছে, আমিও সেটা চাই। এ সরকারের কাছে আমার চাওয়া একটাই-খুনি হাসিনার বিচার। যারা দেশের ছাত্রসমাজের মেধা নষ্ট করতে চেয়েছে, যারা শিক্ষার্থীদের গুলি করে মেরেছে, ছোট বাচ্চাদের মেরেছে, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এ সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, তারা যেন সঠিক সময়ে নির্বাচন দিতে পারে। কষ্ট লাগছে একটা জায়গায়, দ্রব্যমূল্য এখনো এ সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। সিন্ডিকেটটা তারা এখনো ভাঙতে পারেনি। এ সরকারের কাছে এখনো দেশের জনগণের অনেক প্রত্যাশা। জনগণ জানতে চায়, এখনো যে পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে যোগ দেয়নি, তারা কারা, তাদের পরিচয় কী? এ ছাড়াও দেশের ৬০০ সাবেক মন্ত্রী-এমপি লুকিয়ে ছিল কোনো এক জায়গায়, তারা কীভাবে পালাল? এটাও দেশের মানুষ জানতে চায়। তাদের সে অধিকার আছে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সরকারের করতে হবে। তাদের অনেক কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, এদিকেও নজর রাখতে হবে। সরকারের মধ্যে অনেক উপদেষ্টা আছেন, তাদেরও সংযত হতে হবে। জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ৭০ হাজার টাকার কম্বল বিতরণে হেলিকপ্টার করে যাচ্ছে ৮-৯ লাখ টাকা খরচ করে। বিষয়টি আমার কাছে শুধু নয়, দেশের মানুষের কাছে খারাপ লেগেছে।
’২৪-এর এ আন্দোলনে কিন্তু ছাত্রসমাজের সঙ্গে দেশের মানুষেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল। তাই দেশ নিয়ে সবার ভাবনা আছে। এমন কিছু করা যাবে না, যা হাসিনার কর্মকাণ্ডের মতো করেই দেশের মানুষ বিবেচনা করে। আমাদের নতুন কিছু করে দেখাতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা ও সমর্থন থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারের মঙ্গল কামনা আমি সব সময় করি। আমার চাওয়া থাকবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তারা এগিয়ে যাবে। বিতর্কিত যেন না হয়। আমি ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারকে নিয়েও অনেক আশাবাদী। হাসিনা সরকার স্যারকে নিয়েও নানা কুৎসা রটিয়েছিল, কুচক্রের ফাঁদে ফেলেছিল। তখনো তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। ছাত্রসমাজের কাছে আমার চাওয়া থাকবে তাদের মেধা যেন ভিন্ন খাতে ব্যবহৃত না হয়, অন্য কেউ যেন তাদের মেধাকে ব্যবহার করে দেশের ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তোমরা তোমাদের মেধা দিয়ে দেশের যে পরিবর্তন এনেছ, সেটা তোমাদেরই ধরে রাখতে হবে। তোমাদের হাতেই আগামীর বাংলাদেশ। তোমাদের মেধাশক্তি যদি কেউ কেড়ে নিতে চায়, আমরা সবাই মিলে তা প্রতিরোধ করব। দেশটা আমাদের সবার। (অনুলিখন : রিয়েল তন্ময়)
লেখক : সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক