পূর্ব-পশ্চিম

মযহারুল ইসলাম
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কলকাতা নগর প্রতিষ্ঠা এবং রাজধানীর মর্যাদা পাওয়ার অনেক আগে অখণ্ড বাংলার পূর্বাংশ পশ্চিমাংশের তুলনায় ছিল অগ্রসর। কেননা মোগল আমলে বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। মোগলদের সুবাদার, আমীর-উমরাহ্দের আবাসও ছিল ঢাকায়। ঢাকার মোগল স্থাপনাগুলোর অনেক নিদর্শন বর্তমানেও রয়েছে। নবাব মুর্শিদকুলি খান বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করার ফলে ঢাকার ঐতিহ্যে ভাটা পড়ে। তবে ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানীর মর্যাদা দেওয়ার ফলে ঢাকার মান কিছুটা রক্ষা পায়।
পলাশির প্রহসন যুদ্ধের পর অখণ্ড বাংলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করতলগত হয়। এর পর থেকে ঢাকার মর্যাদা-ঐতিহ্যের ক্রমান্বয়ে বিলোপ ঘটে। ঢাকার বিখ্যাত মসলিন বস্ত্র, তাঁতসহ বস্ত্রশিল্পকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গের তাঁতশিল্পের কারিগরদের আঙুল কেটে পর্যন্ত তাঁতশিল্প থেকে বিচ্যুত করা হয়। উৎপাদক থেকে আমরা পরিণত হয়ে যাই ব্রিটিশ পণ্যের ক্রেতায়। ব্রিটিশ পণ্যের বাজারজাত করার অভিপ্রায়েই ইংরেজরা এমন নৃশংস পন্থা গ্রহণ করেছিল। ওদিকে আমাদের কাঁচামাল নিজ দেশে নিয়ে পণ্য উৎপাদন করে আমাদেরই ওই পণ্যের ক্রেতায় পরিণত করেছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বন্দরের সুবিধা বিবেচনায় সুতানটি, গোবিন্দগঞ্জ ও কলকাতা নামক তিনটি গ্রাম নিয়ে লন্ডনের আদলে গড়ে তোলে কলকাতা নগর। রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে কলকাতায় স্থানান্তরিত করার ফলে কলকাতা নগরীর গুরুত্ব ও মর্যাদা দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করে, অপরদিকে বাংলার নিম্নাঞ্চল পূর্ব বাংলার প্রতি কোম্পানির কোনো আগ্রহ না-থাকায় পূর্ববঙ্গ ক্রমেই মফস্বলে পরিণত হয়। দুই বাংলার উন্নতি ও উন্নয়নের বিকাশ ঘটে সম্পূর্ণ বিপরীতে। পশ্চিমবঙ্গের অভাবনীয় উন্নয়ন আর পূর্ব বাংলার প্রতি ইংরেজদের অবহেলার দরুন পূর্ব বাংলার উন্নয়ন-অগ্রগতি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অপরদিকে পুরো ভারতবর্ষকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছলে-বলে-কৌশলে দখল করে নেয়। ভারতবর্ষের রাজধানীর মর্যাদায় কলকাতা শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতর হয়ে ওঠে। ১৯১১ সাল অবধি কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ব্রিটিশরা রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে। ফলে কলকাতার গুরুত্ব-মর্যাদা হ্রাস পায়। কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশরা এক অনুগত শিক্ষিত কেরানি শ্রেণি গড়ে তোলে, যারা ভারতীয় হলেও ইংরেজ সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তিতে ইংরেজ সরকারের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছিল। তারা সুদীর্ঘ ১৯০ বছরব্যাপী ইংরেজ শাসনকে নিরঙ্কুশ ও নির্বিঘ্ন করেছিল।
ইংরেজ শাসনাধীনে পূর্ব বাংলা হয়ে পড়েছিল অবহেলিত এক পশ্চাৎপদ জনপদ, যা সমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের অধীন হয়ে পড়ে। বস্ত্রশিল্পসহ নানা ক্ষুদ্রশিল্পের সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটিয়ে ইংরেজ শাসকরা পূর্ব বাংলাকে কৃষিনির্ভর করে তুলেছিল।
পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় বাঙালিরা এতে করে পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনোভাব পোষণ করত। এর নজির আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পর্যন্ত জেনেছি। বহু আগে থেকে কলকাতাসহ ভারত ভ্রমণের ফলে কিছু ব্যক্তির সঙ্গে আলাপে তাদের মনোভাব জেনেছি। করোনার আগে শান্তিপুর লোকাল ট্রেনে ফুলিয়া থেকে শিয়ালদা ফেরার পথে ট্রেনে জনৈক শান্তিপুরের স্থানীয় এক ব্যক্তি চিৎকার করে অন্যদের শুনিয়ে বলছিলেন, ‘কুকুরকে আশ্রয় দিলেও বাঙালদের আশ্রয় দিতে নেই।’ তিনি কেন অমন কথা বলছেন, জানতে চাইলে বলেছিলেন অনেক কথা। তার কথার সার-সংক্ষেপ ছিল, তার পিতার শান্তিপুরে তিন বিঘা সম্পত্তি ছিল। সাতচল্লিশের দেশভাগে পূর্ব বাংলা প্রত্যাগত মানুষরা তার পিতার হাত-পা ধরে দুই কাঠা, তিন কাঠা করে আড়াই বিঘা জায়গা কিনে নেয়। এতে তাদের পাঁচ কাঠার ওপর বসতভিটায় বসবাস করতে হচ্ছে। আর পৈতৃক জায়গায় বসবাস করা বাঙালদের দাপটে তাদের চুপসে থাকতে হয়। একজনের সঙ্গে বিবাদ হলে বাঁদরের মতো সবাই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালদের দাপটে তাদের কোণঠাসা দশা। এসব কারণেই তিনি পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে অমন কথাগুলো বলেছিলেন।
১৯৮৬ সালে কলকাতায় স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আশি বছর বয়সি ক্ষিতিশচন্দ্র ধর। তিনি পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক এমন সব কথা বলেছিলেন যে তাতে বিষণ্ন হয়েছিলাম। তার কথাগুলো ছিল এমন : পশ্চিমবঙ্গই নানাভাবে পূর্ব বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। পূর্ব বাংলার মানুষদের শিক্ষা ও জীবিকার জন্য কলকাতামুখী হতে হয়েছে। পূর্ব বাংলা আগাগোড়া পশ্চিমবঙ্গের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পূর্ব বাংলা সভ্য মানুষের বসবাসযোগ্য ছিল না। খাল-বিল, নদ-নদী, জলাশয়, কাদা-মাটিতে লেপ্টে থাকা পূর্ববঙ্গ অখণ্ড বাংলার এক পশ্চাৎপদ জনপদ, সভ্যতাবঞ্চিত অজ গাঁ বিশেষ। পূর্ব বাংলার মানুষদের সভ্য বলেও তিনি গণ্য করেন না। দুই বাংলার মানুষের মাঝে প্রত্যক্ষ বিরোধ-বিবাদ নেই সত্য। মনস্তাত্ত্বিকভাবে বৈপরীত্য কিন্তু উভয়ের মাঝে বিরাজ করে আসছে, যার নজির দেখা যায় ইস্ট বেঙ্গল ও মোহনবাগান ফুটবল দলের খেলাকে কেন্দ্র করে ঘটি ও বাঙালদের পরস্পরের বিরোধে।
পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে ক্রমাগত নেতিবাচক কথায় তাকে আমি বলেছিলাম, ‘আজকের পশ্চিম বাংলার খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক, অভিনয় শিল্পী, রাজনীতিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী সবার ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু পূর্ববঙ্গীয়। তিনি দমার পাত্র নন। জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘তারা এখানে আসার ফলেই ঋদ্ধ হতে পেরেছে। আমাদের সংস্পর্শে না এলে কুলি, কামার, মজুর, চাষাই থাকত।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘কিসের মুক্তিযুদ্ধ! বলো ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ, যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাজিত করে ভারত বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তোমাদের উপহার দিয়েছে।’ আমরা বাংলাভাষী রাষ্ট্রের নাগরিক। একজন বাঙালি হিসাবে আপনার তো গর্ব করা উচিত? এ প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘দেখো আমি প্রথমে ভারতীয়। তারপর অন্যকিছু।’ আরও বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গীয়রা শুদ্ধ বাংলাও জানে না। যতটুকু শিখেছে সেটা আমাদের কাছ থেকেই। তোমাদের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সেটা আমাদের জন্যই। টালিগঞ্জের এক বাঙাল অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বাঙাল বলে গর্ব করে। এত বছরেও বাংলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারল না। বাঙাল ভাষায়ই কথা বলে। এমনকি সিনেমাতে পর্যন্ত বাঙাল ভাষায় সংলাপ বলে আসছে।’ আমি তাকে মনে করিয়ে দিই খ্যাতিমান গায়ক, সুরকার শচীন দেববর্মন বাঙাল ভাষায় জীবনভর কথা বলেছেন। এতে তো তার সৃজনশীলতায় কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি? তিনি আমাকে থামিয়ে বলেন, ‘ভুল বকছো কেন? শচীন কর্তা বাঙাল বা বাঙালি নন। তিনি ত্রিপুরার রাজাদের বংশধর এবং জাতিতে বোরো বা ত্রিপুরী। বাল্যকাল থেকে কুমিল্লায় থাকার ফলে বাঙালদের সংশ্রবে বাঙাল ভাষায় অভ্যস্ত হয়েছেন। ত্রিপুরায় থাকলে ককবরক কিংবা বোরো ভাষাই জানতেন।’
সাতচল্লিশের বাংলাভাগ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, ‘বাংলাভাগ অনিবার্য ছিল। কেননা অখণ্ড বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠরা ছিল মুসলমান। এতে হিন্দুরা মুসলমানদের দ্বারা পিষ্ট হতো। অনুন্নত শ্রেণির কবলে চিড়েচ্যাপটা হতে হতো। বাংলাভাগে আমাদের ক্ষতিটা হয়েছে শরণার্থী বাঙালদের আগমনের কারণে। নয়তো বাংলাভাগে আমাদের কোনো সংকট ছিল না।’ ছেচল্লিশের দাঙ্গা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘ওই দাঙ্গা জিন্নাহর ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল। আর কলকাতা দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুরাবর্দী (সোহরাওয়ার্দী)। তবে ওই দাঙ্গা সংঘটনে প্রধান ভূমিকায় ছিল বিহারি মুসলমান ও শিখরা। বাঙালিরা দাঙ্গা সংঘটনে তেমন যুক্ত ছিল না।’ শিখরা তো হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়। তারা কেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করেছিল? এ প্রশ্নে ক্ষিতিশ বাবুর বক্তব্য ছিল, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও আওরঙ্গজেব শিখদের দুজন গুরুনানককে হত্যা করেছিল। ওই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিশোধ হয়তো শিখরা নিয়েছিল। তার সঙ্গে আলাপে আমি হতাশই হয়েছিলাম।
ওই একই সময়ে নিউ আলিপুরে এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা ও আলাপ হয়েছিল। তিনি নকশালবাড়ী আন্দোলনের কর্মী। নির্যাতন ও কারাভোগ পর্যন্ত করেছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নকশালবাড়ী আন্দোলনে সর্বাত্মক ক্ষতিসাধন করেছিল। বাঁকা ঠোঁটে হেসে বলেছিলেন, তোমাদের অবস্থা জলের কুমির ও ডাঙার বাঘের খপ্পরে পড়ার দশা। দেশভাগের তীব্র সমালোচনা করে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের শাসকশ্রেণিকে এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে দায়ী করে খিস্তি করে অনেক কথাই বলেছিলেন।
১৯৮৬ সালে কলকাতা গিয়ে অতিথি হিসাবে ছিলাম ইন্টালি সিআইটি রোডের আত্মীয়তুল্য দীলিপ সেনের বাড়িতে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন আলাপে জানতে পারলাম তাদের বাড়ির দোতলায় ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের একজন সক্রিয় বিপ্লবী-যোদ্ধা থাকেন। তার আদি-নিবাস পুরান ঢাকায়। সাতচল্লিশের দেশবিভাগের পর কলকাতায় চলে এসেছেন। ভারত সরকার কর্তৃক মাসোহারা পেয়ে থাকেন। চিরকুমার ওই বিপ্লবী থাকেন ভাইপোদের সঙ্গে। ঢাকার কলতাবাজারের খণ্ড যুদ্ধে অংশ নেওয়া ওই বিপ্লবী বেশ কিছু সশস্ত্র অভিযানেও যুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার কলতাবাজারের ঘটনায় বিপ্লবীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। আত্মরক্ষার্থে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হয়। তিনি বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে রামেরকান্দা হয়ে দোহারে এক পরিচিতের বাড়িতে আশ্রয় নেন। দেশবিভাগের পর বাধ্য হয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। সেই থেকে কলকাতায় আছেন।
স্বদেশী বিপ্লবীকে স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। শোনা ঘটনাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। রাত্রি-যাপনের পর সকালেই কাউকে কিছু না বলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে যাই। ভেজানো দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখি ৮৫ বছর বয়সি এক বৃদ্ধ পুবের জানালার পাশে বসে সূর্যের আলোয় দৈনিক পত্রিকা পড়ছেন। ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলে তিনি ইশারায় ভেতরে যেতে বলায় আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে তার পা-ছুঁয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি। তিনি আমার এ কাণ্ডে বিস্মিত হয়ে জানতে চান, ‘কে তুমি?’ বলি, আমি ঢাকা থেকে এসেছি। ‘ওহ, তা আমার কাছে ক্যান আইছো?’ আমি আবেগে অনর্গল বলে যাই, ‘আপনারা বীর, আপনাদের বীরত্বের জন্যই ভারতবর্ষ ব্রিটিশমুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতা এসেছে উপমহাদেশের। এটা শোনামাত্র তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। খিস্তিখেউর করে বললেন, ‘স্বাধীনতা! আমার ইয়ের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্য আমরা ব্রিটিশদের খেদানোর সংগ্রাম করি নাই। নিজ দ্যাশ ছাইড়া ভিন দ্যাশে আয়া রিফ্যুজি হইবার লাইগা যুদ্ধ করি নাই। এই দ্যাশের সরকারের ভিক্ষার ওপর ভর কইরা বাঁচবার লেগা যুদ্ধ করি নাই। যৌবনের সবকিছু উজাড় কইরা এইভাবে বাঁচবার চাই নাই। আর কী হুনবার চাও। অহন আমাকে দেখা অইছে। যাও চইলা যাও। আর হুনো, স্বাধীনতার কথা কইছো না, এইটা স্বাধীনতা না। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় দ্যাশ ভাঙনের স্বাধীনতা, যেটা আমাগো স্বপ্নেও আছিল না। যাও বাবা বিদায় হও।’
আমি নত মুখে স্থান ত্যাগ করি। তার খেদোক্তি, ভেতরের আগুনঝরা যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। সত্যি তো, যে স্বাধীনতার জন্য তারা জীবন বাজি রেখে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন, তাদের ওই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তো স্বাধীনতা আসেনি। এসেছে টেবিল ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে, দুই ভ্রাতৃপ্রতীম সম্প্রদায়ের পরস্পরের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। দেশভাগের নির্মমতা যাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটনের চরম মর্মান্তিকতায়, তাদের কাছে সাতচল্লিশের স্বাধীনতা প্রহসন ভিন্ন অন্যকিছু নয়। এ সত্য দুই বাংলার দেশত্যাগী হিন্দু-মুসলমানের জীবনস্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়। তার আক্ষেপ তো অন্যায্য নয়। যথার্থই।
পরে আবার কলকাতায় গেলে তার খোঁজ নিয়েছিলাম, জেনেছি তিনি আর নেই। প্রয়াত হয়েছেন। এটা শোনার পর তার বলা খেদোক্তির কথা মনে পড়ে যায়, আজও পড়ে। তবে তার সঙ্গে দেখা করা, কথা বলার স্মৃতি আমার এই জীবনের অমূল্য বলে আজও মান্য করি।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত