Logo
Logo
×

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা

সাক্ষাৎকার

অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে জরুরি সংস্কারগুলো করা হবে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

মিজান চৌধুরী

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে জরুরি সংস্কারগুলো করা হবে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে কানাডার হ্যামিল্টনে অবস্থিত ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামষ্টিক অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন তিনি। গভর্নরের পদ থেকে অবসরের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও সংস্কার সংক্রান্ত নানা বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি মিজান চৌধুরী

যুগান্তর : বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিতে এ সময়ে কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : দুই ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিকের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরূকরণ। দ্বিতীয় হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জগুলো শুরু হয় আরও দুই থেকে তিন বছর আগে, যা আরও প্রকট হয়, যখন রাজনৈতিক নির্বাচন চলে আসে। আমি দায়িত্ব নিয়ে অর্থনৈতিক খাতের এ চ্যালেঞ্জগুলো তাদের কাছ থেকে পেয়েছি। এখন অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি না হলে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মানুষের জীবন ধারণ কোনোটাই স্বাভাবিক থাকছে না। বলতে গেলে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, মুদ্রা বিনিময় হার অনেক বেড়েছে, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ও চলতি হিসাব নেতিবাচক, রেমিট্যান্স কমছে, না কমলেও রপ্তানি বাড়ছে না।

আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতি তো আছেই। দুই থেকে তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর কারণও আছে, আগের সরকার টাকা ছাপিয়েছে, মেগা প্রকল্প হলেও কর্মসংস্থান খুব হয়নি। এরপরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।

জ্বালানি সংকট নিয়েও বড় চ্যালেঞ্জে আছি। গ্যাসের উত্তোলন খুবই কম। বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল, গ্যাস ও কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এ চাপগুলো আছে। পাশাপাশি এতদিন উন্নয়নের বর্ণনা ছিল, ‘আমরা অনেক দূর এগিয়েছি’; কিন্তু অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেনি। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে গেছে। আর সম্পদের বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। অর্থ ও আয়ের বৈষম্য থেকে সম্পদ দিন দিন কুক্ষিগত হয়েছে কিছু লোকের কাছে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের যে কথা ছিল, সেটি হয়নি। মানুষ খুব চাপের মধ্যে পড়েছে। কারণ বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য বেশি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সর্বত্র বাড়তি ব্যয়ের চাপ পড়ছে। এগুলোই এখন অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করছে।

যুগান্তর : বিদেশে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে, তা ফেরত আনার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী আপনি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : নিঃসন্দেহে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে বিদেশে গেছে। যে কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যাংকগুলো খালি হয়ে গেছে, ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি। এ টাকাগুলো দেশে নেই। যেটুকু আছে ছিটিয়ে, তা খুব সামান্য, বিরাট অঙ্ক নয়। ফলে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা বড় চ্যালেঞ্জ। উদ্যোগ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে প্রধান করে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। প্রথম কাজটি হচ্ছে, যারা টাকা পাচার করেছে, তাদের নাম ও ঠিকানা শনাক্ত করা। এরপর তাদের বিরুদ্ধে একটি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) অপরাধীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাদের কর ফাইল দেখে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইভেন্ট শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসএসসি) মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আমরা পাচারকৃত অর্থের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। ইতোমধ্যে একটি কর সংক্রান্ত টিম এনবিআর থেকে দুবাই গেছে। ভিন্ন আরও একটি কর ফাইল নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের এজেন্সির সঙ্গে কথা বলছে। এক্ষেত্রে দরকার মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স (এমএলএ)। কারণ আমরা যখন একটি মামলা অনুসন্ধান করব, মামলাটি যখন আদালতে যাবে, তখন আদালত বলবে, টাকা যেখানে গেছে সেখানে জব্দ করা হোক। তখন বাংলাদেশ থেকে একটি অনুরোধ পাঠানো হবে। এজন্য এমএলএ দরকার।

আমি মনে করি, মানিলন্ডারিং একটি টেকনিক্যাল বিষয়। পাচারকৃত টাকা এক দেশে নয়, অনেক দেশেই গেছে। শুধু তাই নয়, অনেক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে। শুধু রাজনীতিবিদ নয়, ব্যবসায়ী ও আমলারাও রয়েছেন অর্থ পাচারের তালিকায়। এখন অনেকের নাম বেরিয়ে আসছে। এ বিষয়ে কাজ করতে যুক্তরাজ্য থেকে একটি বিশেষজ্ঞ টিম আসছে, যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করবে, সঙ্গে দেশীয় বিশেষজ্ঞরাও থাকবেন। তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারির সঙ্গেও কথা চলছে। তারা আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব বিশেষজ্ঞের সুবিধা হলো, তারা জানেন কীভাবে টাকা ফেরত আনতে হয়। যাদের অনেকেই পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বেলারুসসহ অনেকে দেশে কাজ করেছে।

আপনারা দেখছেন, টাকা পাচারকারী কেউ কেউ উলটো সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্য থেকে আইনি নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ওরা জানে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে একটি আইনি নোটিশ যাবে। হয়রানি করতে এবং নিজেদের সুরক্ষার জন্য তারা করবেই। আমরাও আইনিভাবে মোকাবিলা করব। তবে পাচারের অর্থ সব শনাক্ত করা কঠিন হবে। ফেরত আনতে একটু সময় লাগবে। কারণ পাচারকারী এ অর্থ তাদের ভাই, বোন, ভাতিজাসহ নানা শাখা-প্রশাখায় প্রবেশ করিয়েছে। ফলে এসব টাকা রাখার স্থান শনাক্ত করা কঠিন। আমি মনে করি, পাচারের অর্থ ফেরত আনার যে উদ্যোগ, এটি ভবিষ্যৎ অর্থ পাচারকারীদের জন্য একটি বার্তা। কেউ চুরি ও অর্থ পাচার করতে চাইলে এখন টের পাবে যে ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হবে।

যুগান্তর : রিজার্ভ চুরি ব্যাপারে নতুন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে অনেকদিন, প্রায় ৫-৬ বছর সময় নিয়েছে সিআইডি। দুদক বলছে, এটি আমরা দেখব। ইতোমধ্যে পত্রিকায় অনেকের নাম আসছে। সে বিষয়ে দুদক কাজ করবে।

যুগান্তর : ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ, যা বেড়েই চলছে, এটি নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কি?

ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ : ২৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ২০০৯ সালে ছিল, যা এখন আড়াই লাখ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বিগত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং খুবই রিলাক্স ছিল। ঋণ নিয়ে টাকা ভিন্ন খাতে নেওয়ার পরও দেখার কেউ ছিল না। আর ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের সঙ্গে এমডিরাও (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) এ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সবাই মিলেই ব্যাংক খাত ধ্বংস করেছে। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতকে বের করে আনতে সময় লাগবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি আদায়ে জোর দিয়েছে। শতভাগ খেলাপি আদায় হবে না। কিছু রাইট অফ করতে হবে। এছাড়া খারাপ অবস্থায় থাকা ছোটখাটো ব্যাংকের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে। ইতোমধ্যে কিছু তারল্য সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২ শতাংশ ডাউন্ট পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ রি-শিডিউল আর করা হবে না। এটি করাতেই খেলাপি ঋণ এত বেড়েছে। তবে জুলাই আন্দোলনে এবং আগের সরকারের রাজনৈতিক কারণে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে, সেটি পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেখা গেছে, একটি গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার মধ্যে দুটি খেলাপি। এর ফলে ওই গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানই খেলাপি বলা হচ্ছে। এটিও ওই কমিটি পর্যালোচনা করবে। যে দুটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি, তাদের বাইরে ভালো তিনটি প্রতিষ্ঠানকে যেন ঋণ দেওয়া হয়, সে বিষয়ে ওই কমিটি পর্যালোচনা করে দেখবে। আমরা ব্যবসা বন্ধ করতে পারব না। ছোট-বড় সব ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করব। যদিও এ উদ্যোগ নেওয়ার পর পর্যাপ্ত তারল্যের প্রয়োজন হবে এবং ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে বাড়াতে হবে। এটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বেসরকারি খাতে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে ভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে দেখার জন্য ইতোমধ্যে এনবিআরকে বলেছি। আমরা গ্যাস ও বিদ্যুৎ আনার জন্য রেয়াত সুবিধা দিচ্ছি। অন্যান্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রাংশ আনার জন্যও উৎসাহিত কীভাবে করা যায়, সেটি দেখছে এনবিআর। যাতে ইন্ডাস্ট্রিয়ালের আওতা বাড়ে, সেটি চেষ্টা করা হচ্ছে।

যুগান্তর : ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আপনি কোনো কঠোর বার্তা দেবেন কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এখন ২ শতাংশ দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ করার দিনে শেষ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বলা হয়েছে ঋণ পরিশোধে বকেয়া তিন মাস হলে খেলাপি হিসাবে ঘোষণা দিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। তবে এর আগে খেলাপিদের একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে পরিশোধের জন্য। শতভাগ বকেয়া পরিশোধ করতে পারবে না। যেটুকু পারবে, সে সুযোগ দিয়ে ঋণ পুনঃতফশিলীকরণ বন্ধ করা হবে।

যুগান্তর : আগামী জুনে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার পেছনে আপনি কী ধরনের টুলস ব্যবহার করবেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আমি মনে করি, বন্যায় অনেক ফসল ও পোলট্রি নষ্ট হয়েছে। মূল্যস্ফীতির পেছনে এটি একটি কারণ ছিল। এছাড়া এখন বাজারে অনেক নতুন ব্যবসায়ী আসছেন, পুরোনোদের মনোপলি বন্ধ হবে। আমরা পেঁয়াজ ও আলু আমদানির ব্যাপারটা সহজ করে দিয়েছি। এখন আলু, পেঁয়াজের দাম কমছে। রোজায় পণ্যের মূল্য যাতে না বাড়ে, সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য আমদানির কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সিদ্ধ চাল, গম ও মসুর ডাল আমদানি করে মজুতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ভারত ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আনা হবে। এভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চাচ্ছি। এছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারি ও মার্চে হাওড়ে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন ধান পাওয়া যাবে। এটি চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে। তবে সয়াবিন তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে কিছুটা বেড়েছে। এজন্য শুল্ক কমিয়েছি। রোজার সময় ডাল, ছোলাসহ রোজাকেন্দ্রিক পণ্যের শুল্ক কমিয়ে দিয়ে আমদানি সহজ করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এতে আশা করছি, মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার অনুযায়ী ৮ শতাংশে নেমে আসবে।

যুগান্তর : অর্থনৈতিক সংস্কারের কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয় আছে কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : অর্থনীতি সংস্কার কমিশন গঠন করে কিছু করা সম্ভব নয়। পুলিশ বা নির্বাচন কমিশন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করছে। কিন্তু অর্থনীতির আওতা ব্যাপক, এখানে কৃষি, শিল্প, আমদানি-রপ্তানি, ব্যাংক ও পুঁজিবাজারসহ অনেক খাত আছে। ফলে অর্থনীতি সংস্কারে একটি কমিশন গঠন হবে না। এখন জরুরি যেগুলো, সে সংস্কারগুলো আমি করব। প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা চেয়েছেন আমার কাছে। সেটি আপনারাও জানতে পারবেন। যেমন, এনবিআরকে বলা হয়েছে, করনীতি ও কর আদায় বিভাগ পৃথক করার জন্য। উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়েছে দুটি আলাদা বিভাগ হবে। কর নিয়ে যারা পলিসি করবে, তারা যেন কর প্রশাসন না চালায়। দুটি বিভাগ আলাদা থাকলে ভালো। কারণ, যে কর আরোপ করে, দুদিন পর সে তার সুবিধামতো এসআরও জারি করে, আবার প্রয়োজনে প্রত্যাহারও করে। এছাড়া বন্দর ও কাস্টমস ডিউটি আরও সক্রিয় করা হবে। এসব করলে মোটামুটি সংস্কারের আওতায় আসবে। মানুষ যাতে কর দিতে গিয়ে হয়রানি না হয়। আবার যাদের সক্ষমতা আছে তারা যেন কর দেয়, টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা-পয়সা লেনদেন না হয়, সরকারকে যেন ফাঁকি না দেয়। এসব বন্ধ করা হবে।

যুগান্তর : ভ্যাট বাড়ছে ও সুদহার বেশি, এলসি খোলার জটিলতায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পারছে না-আপনি এ বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : ব্যাংকের সুদহার একটু বেশি। যদি ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পায়, দুর্নীতি না হয়, সেক্ষেত্রে সুদহার বেশি হলেও সহ্য করা যাবে। এক্ষেত্রে অন্যান্য খরচ কমাতে চাই। বিশেষ করে ট্রান্সপোর্ট-একটি জাহাজ বন্দরে পাঁচদিন থাকলে ডেমারেজ দিতে হয়, কাস্টমসের পেছনে দৌড়াতে হয়, এনবিআরের পেছনে ঘুরতে হয়-এসব কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ ওই খরচের কথা চিন্তা করে না। আমরা বলছি, ওই খরচ কমানো হবে। তবে করব্যয় একটু বাড়লে তা সমন্বয় হবে। আমি মনে করি, শুধু সুদহার কমালে হবে না, আগে ঋণের সুদহার ৯/৬ ছিল, লাভ কী হয়েছে? যারা দুর্নীতি করার, তারা ৯/৬-এর মধ্যেই টাকা বানিয়েছে। যারা করতে পারেনি, ৯/৬-এর মধ্যেও করতে পারেনি। চেষ্টা করছি অন্যান্য খরচ কমানোর। কাস্টমসে একটি ভুল হলে চার/পাঁচ দিন ব্যবসায়ীদের অফিসাররা ঘুরায়। কিছু টাকাপয়সা দিলে তা আবার ঠিক করে দেয়। এসব যথাসময়ে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।

যুগান্তর : অভিযোগ উঠছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার জিডিপির তথ্য নিয়ে জালিয়াতি করেছে, আপনি সঠিক জিডিপির পরিসংখ্যান দেবেন কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আমি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে বলেছি জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য নিরূপণ করতে। আগে প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছিল। বিগত দু’বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯-১০ শতাংশ বিরাজ করছে। এক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার লুকিয়া রাখা হয়েছিল। এখন প্রকৃত মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রকৃত মূল্যস্ফীতি নিরূপণ করতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এর আগে রপ্তানি তথ্য নিয়েও জালিয়াতি হয়েছে। এটি ঠিক করা হচ্ছে। এখন থেকে আর কোনো তথ্যের জালিয়াতি করা হবে না। দাতা সংস্থাগুলো অনেক টাকাপয়সা দিচ্ছে, তারাও কিন্তু সঠিক তথ্যের নিশ্চয়তা চাচ্ছে। তারা বলছে, তথ্য নিয়ে আগের মতো যেন বিভ্রান্তি না হয়।

যুগান্তর : বিগত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শেয়ারের ক্রেতারা পুঁজিবাজারের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চান কিসের জন্য? তিনি কি জালিয়াতি করছেন, না তিনি জালিয়াতি ধরছেন, বরং সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কেন করা হলো, তার পেছনে কারও শত্রুতা আছে? নিশ্চয়ই না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিনি বহু টাকা জালিয়াতি করেছেন। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছি, প্রশ্নই আসে না। এছাড়া শেয়ার কারসাজির কারণে ৪২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরা শত শত কোটি টাকা বানিয়েছে। ফলে এখন অনেকের শেয়ার লক করা হয়েছে। বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের শেয়ার স্থানান্তর করতে যাতে না পারে; আমরা চেষ্টা করছি পুঁজিবাজার ঠিক করার। অনেক জেড ক্যাটাগরির শেয়ার ছিল বাইরের বাজারে। এসব শেয়ার লেনদেন করতে বারণ করা হয়েছে। কারণ শেয়ারগুলো বিক্রি করে লাভ করছে। অথচ তারা তো শিল্প না। তারা এখন অনেকে অভিযোগ করছে। আমি মনে করি, শেয়ারবাজারের মূল্য প্রকৃত মূল্য নয়। এখন শেয়ারবাজার সঠিক মূল্যের দিকে যাচ্ছে। তবে যারা দালালের খপ্পরে পড়ে মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে শেয়ার কিনেছে, তারা এখন বিপদে পড়েছে। অনেকটা ১২ শতাংশ সুদে আমানত রাখার মতো। আমার এক বন্ধু ৭০ লাখ টাকা বেশি সুদে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রেখেছে। এখন পুরো টাকা আটকে গেছে। শেয়ারবাজারের অবস্থা একই। আশা করছি, এটি ঠিক হবে।

যুগান্তর : অর্থনীতি পরিচালনায় কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সরকার থেকে কোনো হস্তক্ষেপ নেই। একসঙ্গে যারা কাজ করবে, যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান-এরা যে গতিতে কাজ করার কথা, সেটা ততটা আশানুরূপ হচ্ছে না। তারা মনে করছে দিচ্ছি, দেব। বেক্সিমকোর শ্রমিকদের অনেক টাকার বেতন দিলাম। কিন্তু যারা এর সমস্যার সমাধান করবে, তারাই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তারা মনে করছে, সরকার যেহেতু দিচ্ছে, দেখি। এখানে কিছু সমস্যা আছে। কারণ লোকজন তো একেবারেই বদলে যায়নি। সবাইকে মনিটরিং করা যাচ্ছে না। আর সমস্যাগুলো বেশ জটিল। এলসি খোলা যাচ্ছে না, টাকা নেই। ভালো ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না। অনুরোধ করে ব্যাংককে এলসি খোলাচ্ছি। দশ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছি চাল আনতে। বেসিক সংস্কারগুলো করব। বিশেষ করে টাকা আদায়ের ব্যাপারে পদক্ষেপ, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানো, এনবিআরের দুর্নীতি, আওতা বাড়িয়ে কর আহরণ বাড়ানো-এসব কাজ করব।

যুগান্তর : অর্থবছরের মাঝপথে এসে ভ্যাট কেন বাড়ালেন? আইএমএফের চাপ ছিল কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আইএমএফের কোনো চাপ ছিল না। কর আদায়ের হার বিশ্বের সবচেয়ে কম আমাদের দেশে। পার্শ্ববর্তী ভুটানের মতো দেশও বেশি আদায় করছে। আগামী বাজেটে আয়কর নিয়ে কাজ করব। টাকা বেশি আদায় হলেও ভ্যাটের প্রক্রিয়া ধীরগতি। এটি কাম্য নয়। কারণ ভ্যাট আদায় বেশি করা মানেই সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। আমরা ১৫ শতাংশ ভ্যাট করতে চাচ্ছি। কোথাও ২ শতাংশ, কোথাও ৪ শতাংশ আছে। একটি নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট করতে চাচ্ছি। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার আরোপ আছে। এতে ভ্যাট আদায় সুবিধা হয়। এখন চশমার ওপর ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ, মিষ্টির ওপর ভিন্ন। ফলে ভ্যাট সংগ্রহ করাও কঠিন। এতে নানা ধরনের ফাঁকিবাজি করা হয়। আমি চেষ্টা করছি, যেটি ৫ শতাংশ আছে, সেটি ১০ শতাংশ করার, ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করার। কিছু ক্ষেত্রে বাড়ানোর ফলে লোকজনের হইচই পড়ে গেছে। এটি আমি স্বীকার করি, কিছুটা চাপ পড়েছে। হয়তো কিছুটা কমানো হবে। আমার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। কারণ ব্যয় কমাতে পারব। কিছু উন্নয়ন প্রকল্প আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এদিকে দাতা সংস্থাগুলো বলছে, যেন কোনোভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতে; শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, খাদ্য এসব খাতে ব্যয় কমানো যাবে না। ওষুধে ভ্যাট কমিয়েছি। কিন্তু একটি প্যারাসিটামল উৎপাদন ব্যয় ৫০ পয়সা, আপনি কিনছেন ৫ টাকা দিয়ে; যার বেশিরভাগ অংশ নিচ্ছে ফার্মেসির মালিক, দোকানি ও ডাক্তাররা। আমার ইচ্ছা ছিল খাবার, সেবা, ট্রান্সশিপ্ট ব্যয় সেখানে কমিয়ে দেব।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : ধন্যবাদ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম