আমাদের লক্ষ্য সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ডকুমেন্টে পরিণত করা: আলী রীয়াজ
জুননু রাইন
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের সভাপতি আলী রীয়াজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি এ কমিশন তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে
প্রধান উপদেষ্টার কাছে। সংবিধান, রাষ্ট্র এবং রাজনীতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন জুননু রাইন
সংবিধান সংস্কারকাজে আপনাদের কাজের ধাপগুলো কেমন ছিল?
: আমরা দুভাগে কাজটি করছি। একটি পর্যালোচনা, অন্যটি সুপারিশমালা তৈরি। পর্যালোচনায় নিজেদের সংবিধান ছাড়া আরও ১২০টি দেশের সংবিধান আমাদের গবেষণা টিম পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মাধ্যমে বিগত ৫২ বছরে আমাদের সংবিধানের দুর্বল ও সবল দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা আমরা করেছি। অংশীজনদের কাছ থেকে সংগৃহীত মত এবং কমিশনের সব সদস্যের মত একত্রিত করে সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে। জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সুপারিশমালায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ডকুমেন্টে পরিণত করা, তার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ক্ষমতা যাতে এককেন্দ্রীকরণ না হতে পারে-সেসব বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। আমাদের সুপারিশে কোনো সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। সরকার সেগুলোকে একসঙ্গে নাকি পর্যায়ক্রমে-কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করবে, সেটা তারা নির্ধারণ করবে।
সংবিধান বারবার পরিবর্তন করা কতটা যৌক্তিক?
: কোনো সংবিধান পারফেক্ট নয়, এটা কোনো ঐশী বাণী নয়, এটা জনগণের আকাঙ্ক্ষার ফসল, রাষ্ট্রের জন্য দিকনির্দেশনা। রাষ্ট্র ও জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তা পরিবর্তন হতেই পারে। এক-তৃতীয়াংশ সংবিধান আপনি বদলাতে দেবেন না-এটা নৈতিক, আইনি, রাজনৈতিক কোনো দিক থেকেই সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটাই করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। কাঠামোগত ও মর্মবস্তুর দিক থেকে আমি মনে করি, এ দেশের সংবিধান দুবার পুনর্লিখন হয়েছে। তার একটি হলো ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে চতুর্থ সংশোধনী, যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অপরটি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের খোলনলচে পালটে দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, ওই দুটি সংশোধনীর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে, যা এ দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি।
যে কোনো দেশের সংবিধান হচ্ছে তার একটা রাজনৈতিক দলিল। সে অর্থে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র, সেটাকে আপনি প্রথম সংবিধান হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন। কারণ, সেটা পথনির্দেশক ছিল, রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, এর একটা দিকনির্দেশনা ছিল। আমাদের সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; সেই অর্থে এটা ছিল একটা দিকনির্দেশনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে একটা সংবিধান প্রণীত হয়। এটাকে আমরা সাধারণ কথায় প্রথম সংবিধান বলি, আরও অর্থে দ্বিতীয় সংবিধানও বলা যায়। এটাও একটা রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে; নাগরিকদের অধিকার কী হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করবে, এর একটা দিকনির্দেশনা আমরা পাই। সে প্রতিশ্রুতিগুলোয় কিছু কিছু কার্যকর পদ্ধতির কথা ছিল, প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্রের কথা ছিল-এটা নিঃসন্দেহে একটা অর্জন। কিন্তু তার কিছু ত্রুটিও ছিল। তবে একটা বড় সাফল্যের দিক হলো-অত্যন্ত স্বল্পসময়ে একটা সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, বিষেশত একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বিবেচনায় এটা নিঃসন্দেহে একটা সাফল্য। আর দুর্বলতার জায়গাগুলো হলো-নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করা গেল না। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক যে স্বাধীনতা থাকার কথা ছিল, যেমন বিচার বিভাগের কথাই যদি ধরি, সেটা থাকল না। সেই প্রতিশ্রুতি থাকল না। প্রধানমন্ত্রী আইনসভা থেকে এসেছেন; কিন্তু তিনি তো নির্বাহী বিভাগের প্রধান; তাকে অপসারণেরও কোনো পথ থাকল না, জবাবদিহির কোনো জায়গা থাকল না। ফলে অনেক কিছুর প্রতিশ্রুতি থাকল; কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হলো, কিন্তু অনেক বেশি দুর্বলতাও থেকে গেল। তাহলে সেই সংবিধান আমাদের কী দিয়েছে? একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছে। একটা স্বাধীন সত্তা হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ঘোষণাটা ওর মধ্যেই আছে; যে আমরা স্বাধীন, আমাদের স্বাধীন সার্বভৌমত্ব আছে এবং আমরা আমাদের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চেষ্টা করছি।
৫৪ বছরের বাংলাদেশে অনেকবারই সংবিধানের সংশোধনী হয়েছে। এ থেকে সাধরণ মানুষ কতটুকু সুফল পেয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
: সংবিধানের ১৭টা সংশোধনী হয়েছে। এ সংশোধনীগুলো ক্রমাগতভাবে সাধারণের প্রত্যাশার জায়গাগুলো আরও সংকুচিত করেছে এবং তার দুর্বলতাগুলো আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। যেমন ধরুন; চতুর্থ সংশোধনী রাষ্ট্রের চরিত্রই বদলে দিয়েছে। একটি সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতিকে অভাবনীয় ক্ষমতা দেওয়া, বিচার বিভাগকে সরকারপ্রধানের অধীনস্থ করা, নাগরিকদের অধিকারগুলো সীমিত হয়ে আসা, বিরোধী রাজনীতি করা যাবে না। আবার পঞ্চম সংশোধনী করা হয়েছে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য; সেখানে আবার রাষ্ট্রের অনেক নীতিও পরিবর্তন করা হয়েছে। অর্থাৎ সংবিধানের সংশোধনীগুলোকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ক্রমাগতভাবে তার দুর্বলতাগুলো প্রকট হয়েছে, বিপরীতে শক্তির জায়গাগুলো অত্যন্ত সীমিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীগুলো নিয়ে আমার তিনটা অবজারভেশন আছে-এর মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক করা হয়েছে, ক্রমাগতভাবে জবাবদিহির জায়গাগুলো সীমিত করা হয়েছে, নাগরিকের অধিকারগুলো ক্রমাগতভাবে নাগরিকের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক যে কাঠামো তৈরি করা উচিত, অর্থাৎ একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের যে রকম অন্তর্নিহিত শক্তি থাকার কথা সে শক্তিটা আর থাকেনি।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা কি সংবিধানের কিছু মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত করতে পারি? যাতে সাধারণ লোকজন রাষ্ট্র এবং তার অধিকারের ব্যাপারে শিক্ষিত হতে পারে?
: আসলে আমাদের সংবিধানটাই সবার বিবেচ্য বা সবার বোধগম্য করে লেখা হয়নি। সেটা করা গেলে আমাদের সাধারণ নাগরিকরা সেটা বুঝতে পারত এবং খুব সহজেই সেটার ব্যবহার করতে পারত। এটার একটা অভাব আমাদের সংবিধানে আমরা শুরু থেকে দেখেছি। সেটার কারণেই সংবিধানের ব্যাপারে নাগরিকদের অনীহা, সেটাকে জানার ব্যাপারে নাগরিকের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটা আসলে শুধু শিক্ষার বিষয় নয়, কারণ রাজনৈতিক শিক্ষার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ অনেক এগিয়ে। আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতিতে যুক্ত থাকতে চায় যতক্ষণ না তাদের যুক্ত থাকার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক সময়ই বাংলাদেশের মানুষকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। সেটা সেনাশাসনের সময় হয়েছে, একদলীয় শাসনব্যবস্থার সময় হয়েছে। গত ১৬ বছরে হয়েছে। এখন সংবিধানকে জনগণের কাছে নেওয়ার জন্য একে সহজবোধ্য করতে হবে, জনগণের অধিকারগুলো সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোর কী ভূমিকা, সেটা নাগরিককে বোঝার পথ করে দিতে হবে। প্রশ্ন হলো-সে সুযোগ কি এসেছে? আমি মনে করি, সে সুযোগ এসেছে। এটা রাজনৈতিক দলগুলো করবে-এটা কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোনো কমিশন করবে না।
কমিশনগুলো কিছু সুপারিশ দিয়েছে। আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণও আমরা সেখানে দিয়েছি। সে পর্যবেক্ষণের ভেতরে আছে, মানুষ চাচ্ছে, এমনকি আমরা বিভিন্ন বিজ্ঞজন এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি, তাদের অনেকেই আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন-সংবিধানকে আরও সহজবোধ্য আরও ছোট করার জন্য; যাতে মানুষের আগ্রহ বাড়ে। আমরা সে সুপারিশ করেছি। এটা আসলে রাজনৈতিক দলগুলোকে করতে হবে। আমার মনে হয়, মানুষকে যুক্ত করে সেটা করা সম্ভব, সেসময় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সবার সঙ্গে কথা বলে এটাকে জনগণের অধিকার রক্ষার ঢাল হিসাবে তৈরি করতে পারে, সেই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনাগুলো যেন এখানে স্পষ্ট থাকে।
সংবিধান শুধু আইনের ছাত্র, শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক বা আইন রক্ষাকারীদের বিষয় নয়। সংবিধান তো সবার জন্য। এখন সংবিধান সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হলে আগে তাদের জানাতে হবে। এটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে যেমন করা যায়, তেমনই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গিয়েও করা যায়। এটা এতদিন হয়নি, এর একটি বড় কারণ হচ্ছে-আমাদের এখানে গণতন্ত্রের অভাব। যদি আমরা আমাদের এখানে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে পারতাম, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আলোচনার জায়গা হতো। সংবিধান সব আইনের উৎস; কিন্তু সংবিধান আইন নয়। সংবিধানের আলোকে, সেখান থেকে দিকনির্দেশনা নিয়ে আইনসভা আইন তৈরি করে। এখন গণতন্ত্রের চর্চাটা অব্যাহত রাখা গেলে নিঃসন্দেহে এটা করা সম্ভব।
আপনাদের সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের কোন দিকগুলো বড় ধরনের পরিবর্তন হিসাবে দেখছেন?
: আমাদের সুপারিশগুলোয় বড় বড় পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। যেমন: আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটা প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা বলেছি। যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার থাকবেন। যেটা ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করবে। এটা বাংলাদেশে আগে ছিল না। এটাকে একটা বড় কাজ মনে হয়েছে আমাদের কাছে। আবার আমাদের প্রস্তাবনার মধ্যে আছে প্রধানমন্ত্রীর বিপক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যাবে; এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে সংবিধানে বহুবিদ পরিবর্তন সত্ত্বেও আগে কখনো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন; এমনকি একবার যদি তাকে প্রধানমন্ত্রী নির্বচিত করা হয়, তার দল চাইলেও তাকে সরাতে পারে না। বর্তমান সংবিধান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে অভাবনীয় ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, আমরা আমাদের প্রস্তাবনায় বলেছি যে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেটা যেন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়। এর বাইরে আমরা দুটি হাউজের কথা বলছি। এটা শুধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নয়, এটা আসলে একধরনের ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করবে, জবাবদিহির জায়গাটা নিশ্চিত করবে।
এত বড় একটা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাজনীতিতে কতটুকু সম্ভাবনা দেখছেন, কী রকম হতে পারে আগামী দিনের রাজনীতি?
: আমি মনে করি, এ পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অনেক বড় একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমি এখানে সম্ভাবনার কথা বলছি এ কারণে-যদি আপনি এটাকে একটা ঘর হিসাবেও দেখেন, এখন তার একটা দরজা খুলেছে। এবার সে দরজা দিয়ে আমরা বেরোব, আসব এই তো। সেরকম দরজাটা খোলার কারণে বাইরে থেকে তাজা হাওয়া আসতে পারছে, এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষাগুলো তৈরি হয়েছে, সে আকাঙ্ক্ষাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকেও স্পর্শ করবে। আর এটাও ঠিক-এই যে আন্দোলন, এই যে অভ্যুত্থান, এটা হঠাৎ করে হয়নি কিন্তু। এখানেও রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ভূমিকা আছে। শেষ মুহূর্তে তারা সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। যে মানুষটি ময়দানে নামলেন, তিনি হয়তো জামায়াত করেন, হয়তো বিএনপি করেন বা গণতন্ত্র মঞ্চ করেন; তার সেই পরিচয় থেকে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারাও এ আন্দোলনে যুক্ত হতে চান। ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বর্তমান পরিবেশ একটা সুযোগ। এ সুযোগ তারা কাজে লাগাবেন কি না, এর দ্বারা প্রভাবিত হবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত তাদের। একটা উদাহরণ দিলে এটা আরও ভালো করে বোঝা যাবে-যারা কমিশনে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা সবাই বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে হ্রাস করতে হবে। দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার কথা বলেছেন। আমি মনে করি, এগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের লক্ষণ।
আমাদের দেশের শিক্ষা রাজনীতিকে প্রভাবিত করে নাকি রাজনীতি শিক্ষাকে প্রভাবিত করে?
: আমি মনে করি, এটা পরস্পর সম্পর্কিত। পরস্পর সম্পর্কিত এজন্য বলছি যে শিক্ষা তো নাগরিকের অধিকার; কিন্তু কেবল শিক্ষা পাওয়াই যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করলেই হবে না, শিক্ষার মানও নিশ্চিত করতে হবে। আপনি ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাচ্ছেন, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে যদি আমরা গত তিন দশকের অভিজ্ঞতার দিকে তাকাই, দেখা যাবে এ সময় শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে; কিন্তু গুণগত মানের দিক থেকে শিক্ষার ওই জায়গাটিতে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। এর ফলে আমাদের মতো একটি দেশের যে মানবসম্পদ গড়ে ওঠা প্রয়োজন, সে জায়গাটায় আমরা যেতে পারছি না। এখন এটা কেন হচ্ছে? এখানেই চলে আসে রাজনীতির প্রশ্ন। আপনি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন কি না, আপনার প্রায়োরিটির মধ্যে শিক্ষা আছে কি না, শিক্ষার বরাদ্দ বাড়াচ্ছেন কি না, শিক্ষা নিশ্চিত করছেন কি না।
গত কয়েক বছরে শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আমরা কী দেখেছি? আমরা দেখেছি একেবারে প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষায় একধরনের দলীয়করণ করা হয়েছে। সেটা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। এখন দলীয়করণের এ শিক্ষা দিয়ে আপনি দলের লোক তৈরি করতে পারবেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানবসম্পদ তৈরি করতে পারবেন না। তাই আমি মনে করি, শিক্ষা এবং রাজনীতি পরস্পর সম্পর্কিত। সুতরাং আগামী দিনে আমাদের নজর দিতে হবে-শিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে এবং এটাকে মানসম্মত শিক্ষায় নিয়ে যেতে হবে।