হারিয়ে যাওয়া জাসদ
সালেহ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: যুগান্তর
তরুণদের স্বপ্ন দেখানো জাসদ এখন কোথায়? কীভাবে হারিয়ে গেল জাসদ? কেন হারিয়ে গেল? এসব প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনায়। অনেকে অনেক গুরুগম্ভীর তত্ত্ব দিয়েছেন। জাসদের মৃত্যু ইতিহাস বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে কীভাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের জন্ম হয়েছিল।
ছয় দফা
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সভায় তার বিখ্যাত ছয় দফা দাবি পেশ করেন, যাতে দাবি করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য সর্বোচ্চ স্বাধিকার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছাড়া আর সবই থাকবে পূর্বাঞ্চলের জনগণের হাতে। সম্মেলনে উপস্থিত সব বিরোধীদলীয় নেতাই শেখ মুজিবের দাবির বিরোধিতা করলেন, এর মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং বাঙালি নেতারাও। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বললেন, ওদের পয়সাকড়ি, সম্পদের সব যদি ওরা নিয়ে যায়, তাহলে কী আর রইল পাকিস্তানের জন্য! নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ভাসানী ন্যাপ, জামায়াতে ইসলামী তুমুলভাবে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করল। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মওলানা তর্কবাগীশ, শাহ আজিজ প্রমুখ নেতাও ছয় দফা দাবির বিরোধিতা করলেন।
জাসদি ধারণার শুরু
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের বিরাট একটি অংশ, যাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন দেশের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুসুলভ অসমতা ও শোষণের রাজনীতিতে দারুণভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। মন্ত্রী আসন বণ্টনে অসমতা, কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি সংখ্যায় অসমতা, সামরিক বাহিনীর পদ উন্নীতে অসমতা, সম্পদ বণ্টনে লুণ্ঠন ইত্যাদি দারুণভাবে উচ্চারিত ছিল ছাত্রদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যায় হলগুলোর করিডরের আনাচে-কানাচে এ নিয়ে যাদের ক্রোধান্বিত উক্তি শোনা যেত।
ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিগুলোর রচনা এবং সমর্থনের মূলে ছিলেন কয়জন তুখোড় অর্থনীতিক-রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, মোশাররাফ হোসাইন এবং নুরুল ইসলাম; যাদের কয়েকজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষকদের আরও যাদের ছয় দফার সমর্থক ধরা হতো, তাদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মুজাফ্ফর আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক, বাংলা বিভাগের আহমেদ শরীফ ও নীলিমা ইব্রাহিম। বৈষম্য নিয়ে শিক্ষকদের লেখালেখিও দারুণভাবে ছাত্রদের প্রভাবিত করত।
এ প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের সদস্যরা এটিকে লুফে নিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছয় দফা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সভা-মিছিল করে ছয় দফার পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকে। শেখ মুজিবও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমিতি করে ছয় দফার পক্ষে গণসমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।
জাসদের জন্ম কখন হয়েছিল? ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদের জন্ম হয়। সেট আনুষ্ঠানিক জন্ম। কিন্তু জাসদ গর্ভধারণ করেছিল অনেক আগে, পরিপক্ব হতে সময় লেগেছিল আরও কয়েক বছর। ছাত্রলীগের প্রগতিশীল একটি অংশ থেকেই জাসদের জন্ম, এটি কোনো অজানা কথা নয়। ছাত্রলীগের এ অংশ থেকেই শুরু হয় জাসদি ধারণার। তখন থেকেই যারা এ ধারণার সঙ্গে যুক্ত হন, তাদের সবাইকে বলা যায় জাসদি। যদিও তখন জাসদ নামটির অস্তিত্ব ছিল না।
ছাত্রলীগের সদস্যরা ছয় দফা নিয়ে দারুণভাবে আলোড়িত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, হলগুলোর করিডরে, মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রদের তুমুল আলাপ-আলোচনা চলতে থাকত, কখনো তা ছিল বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক, কখনো আবার খুব আবেগপূর্ণ। এ আলোড়ন আস্তে আস্তে ঢাকার বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়ও ছড়িয়ে গেল।
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা ও বাদানুবাদ শুরু হলো। ছাত্রলীগের প্রগতিশীল একটা পক্ষ ছয় দফাকে স্বাধীনতাসংগ্রামের সূত্রপাত হিসাবে দেখল এবং অন্যপক্ষ এটিকে আক্ষরিক অর্থে ধরে নিয়েছিল-স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার একটা দরকষাকষি। যার যাই মত হোক না কেন, ছয় দফা নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত ছিল না ছাত্রলীগে। ছয় দফার গুরুত্ব নিয়ে ছাত্রলীগের মতভেদ প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল অনেকটা তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিগত। তখন বিভেদ বা বিভাজন ছিল না।
তখনকার ছাত্রলীগ নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। এটি ছিল একটি আদর্শভিত্তিক দল, পূর্ব বাংলার জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একচেটিয়া শাসন ও শোষণ থেকে রক্ষা করার ব্রত নিয়েই তখন ছাত্ররা রাজনীতি করত। এরা চাঁদা তুলত না, এরা চাঁদা দিত। হলের সিট বরাদ্দ দিতেন হলের প্রভোস্ট, হাউজ টিউটররা এসে রাতে চেক করতেন রুমে কে থাকে। ছাত্ররা রাজনীতি করত, পড়ালেখা বাদ দিয়ে নয়, পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে। তখন শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছিল এনএসএফ। মাঝেমধ্যে এনএসএফ-এর ছেলেরা হকিস্টিক হাতে অন্য ছাত্র সংগঠনের ছেলেদের দৌড়াত, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি ছিল এ পর্যন্তই।
প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিবের সভা ও প্রচারণা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ নিয়ে জনগণকে সচেতন ও হুঁশিয়ার করার প্রচেষ্টা। কারণ, সাধারণ মানুষ ছাত্রদের মতো এসব বিষয় নিয়ে এত সচেতন ছিল না। জনগণের সাড়া ছিল প্রথমদিকে খুবই ধীরগতির; কারণ, ছয় দফার বিরুদ্ধে অন্যান্য দলের, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রচারণা ছিল খুবই ধারালো। শেখ মুজিবও আস্তে আস্তে ছয় দফার পক্ষে তার প্রচারণা আরও ঝাঁজাল করলেন।
উনসত্তরের আন্দোলনে জাসদিদের পরিপক্বতা
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার একটি প্রেস নোট জারি করল।
সেখানে বলা হলো, পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার জন্য আগরতলায় বসে পাকিস্তানে একটি সশস্ত্র হামলার নীলনকশা তৈরি করা হয়েছে, যার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে দুজন সিএসপি অফিসারসহ আট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয়, এ ষড়যন্ত্রের প্রধান আসামি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯ মে আরও অনেককেসহ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে জেলখানায় নেওয়া হলো। শেখ মুজিবকে একবার অল্প কয়দিনের জন্য ছেড়ে দিয়ে আবারও গ্রেফতার করে সামরিক আইনের আওতায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হলো। বলা হলো, তাদের সবাইকে সামরিক আইনে বিচার করা হবে। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, তার ‘উন্নয়নের দশ বছর’ উদযাপনের জন্য সারা দেশে খুব জমজমাট আয়োজন করছেন এবং তার ক্ষমতাকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য শাসনক্ষমতাকে যথেচ্ছাচার কাজে লাগাচ্ছেন। বাঙালি জাতি স্তম্ভিত হয়ে গেল-ছয় দফার মাধ্যমে যা কিছু আশা দেখা দিয়েছিল, মনে হলো তাও উবে যাচ্ছে।
১৯৬৮ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১৯৬৯-এর এগারো দফা (যাতে ছিল মুজিব ঘোষিত ছয় দফাও) আন্দোলনে ছাত্রলীগের দুই অংশ আবারও পথে নামাল, আন্দোলন ছিল ঐক্যবদ্ধ; কিন্তু যারা ভেতর থেকে দেখেছেন, তারা দুপক্ষের বিভাজন সুস্পষ্টভাবে লক্ষ করেছেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রেহমান সোবহান নিউজপ্রিন্ট কাগজে ‘ফোরাম’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক বের করতেন, এর সম্পাদক ছিলেন হামিদা হোসেন (ড. কামাল হোসেনের স্ত্রী)। যেখানে বৈষম্য নিয়ে পরিসংখ্যান ও সুচিন্তিত পর্যালোচনা ও রচনা ছাপা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে এ পত্রিকা ছিল খুবই জনপ্রিয় এবং এর রাজনৈতিক পর্যালোচনা তাদের চৈতন্যকে দারুণভাবে নাড়া দিত। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান ছিল জাসদিদের মূল চালিকাশক্তি।
স্বাধীনতা বনাম স্বাধিকার বিতর্ক
ছাত্রলীগের কথাতেই ফিরে যাই। ছাত্রলীগের একটি পক্ষ ছয় দফাকে স্বাধীনতার সংগ্রাম হিসাবে দেখল এবং সেভাবে তারা তাদের স্লোগান ও প্রচারণা চালাতে থাকে, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন আ স ম আবদুর রব। রবকে মনে করা হতো আদর্শিকভাবে সিরাজুল আলম খানের লোক। এ পক্ষের মনোভাব ছিল তারা শেখ মুজিবকে সর্বতোভাবে প্রভাবিত করবেন, যেন তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেন। ছাত্রলীগের এ অংশটাকে বলা হতো রবপন্থি; পরবর্তীকালে তারাই হয়ে ওঠে জাসদি।
ছাত্রলীগের অন্য পক্ষ ছয় দফাকে স্বাধিকার অর্জনের দরকষাকষির হাতিয়ার হিসাবে দেখল। এদের নেতৃত্বে ছিলেন একাধিক নেতা; যেমন-নূরে আলম সিদ্দিকী, শেখ শহিদুল ইসলাম। ১৯৬৯-এর আগে তোফায়েল আহমেদ ছাত্রলীগ রাজনীতিতে ছিলেন অপরিচিত। এ পক্ষের নীতি ছিল, এ সময় কোনো হঠকারিতা না করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করা এবং তাকে কোনোরকম চাপ না দিয়ে, তার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এদের বলা হতো মুজিববাদী।
মুজিববাদীরা রবপন্থিদের বলত হঠকারী এবং রবপন্থিরা মুজিববাদীদের বলত প্রতিক্রিয়াশীল। এখানে বলে রাখা দরকার, সেসময় দুদলই শেখ মুজিবকে তাদের সুপ্রিম রাজনৈতিক নেতা মনে করত এবং এ নিয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। এ ভেতরগত বিভক্তিতে কোনো মারামারি বা উচ্ছৃঙ্খলা ছিল না। পার্থক্যের প্রতিফলন ছিল সভা, সমিতি ও মিছিলে; যেখানে অনেক বক্তব্য ও স্লোগানই ছিল দুপক্ষের জন্য কমন, আবার অন্যগুলো ছিল নিজস্ব। ক্রমান্বয়ে ছাত্রলীগের রবপন্থিরা একটি পরিচ্ছন্ন রাজনীতির অনুঘটক হয়ে আদর্শবান ও সংগ্রামী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করল। মুজিববাদী গ্রুপ তাদের গতানুগতিক রাজনীতির অনুসারী হিসাবে দাঁড় করল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, তখন ছাত্ররাজনীতিতে দখলত্ব বা চাঁদাবাজি কিংবা হানাহানি ছিল না। এ দ্বন্দ্ব ছিল এক পক্ষের নেতাকে চাপ দিয়ে বা ডিঙিয়ে নিজেদের পথে আনার প্রচেষ্টা এবং অন্য পক্ষের ছাত্রলীগের ঐতিহ্যকে মেনে, নেতার পেছনে থেকে অনুসরণের প্রতিশ্রুতি।
স্বাধীনতার আন্দোলন
৬ মার্চ ১৯৭১ সাল। আগামীকালই হবে ৭ মার্চের জনসভা রেসকোর্স ময়দানে, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ছাত্ররা সারা দিনই মিছিল করে প্রচারণা চালাচ্ছে। সন্ধ্যায় মগবাজার-রাজারবাগ হয়ে একটি মিছিল থামল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। মিছিলের ক্লান্ত দুজন তরুণ এসে বসল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক কোণে। সামনে আলো জ্বালিয়ে কাজ করছে কর্মীরা, সভার প্যান্ডেলের শেষ কাজগুলো শেষ করতে। দুই তরুণের একজন ছাত্র তৎকালীন ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনিই সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা; তার মাত্র চার দিন আগে, ২ মার্চ। আ স ম আবদুর রবকে তার সহযোগী জিজ্ঞেস করলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যদি ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা না দেন, তাহলে আপনারা কী করবেন? এ পতাকা বানানো ও ওড়ানো কি বৃথাই যাবে?’ আ স ম আবদুর রব বললেন, ‘নিশ্চয়ই না। তিনি যদি ঘোষণা না দেন, তাহলে আমরাই এগিয়ে যাব সেই পতাকা হাতে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে।’ এমনিই বলিষ্ঠ ছিল তখনকার প্রত্যয়। বিশ্রাম শেষে দুজনে রিকশা করে তাদের হলের পথে রওয়ানা দিলেন। তখন ছাত্রনেতাদের গাড়ি ছিল না।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। জাসদিদের সেই প্রত্যয় স্বাধীনতাসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করল। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলো স্বপ্নের বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রয়োজন পড়ল পরিপূর্ণ বিরোধী দলের। ১৯৭২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নিয়ে জাসদ সেই দাবিও মেটাল।
পথ হারালো জাসদ
জাসদ হোঁচট খেয়েছে রাজনৈতিক পরিপক্বতার দীর্ঘ অনুশীলনের পথ ছেড়ে অবাঞ্ছিত সংক্ষিপ্ত পথে এগোতে গিয়ে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম পার্লামেন্টারি নির্বাচন হয়। নতুন গড়ে ওঠা জাসদই তখন আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের একমাত্র কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই নির্বাচনে জাসদ তিনশ আসনের প্রতিটিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। জাসদের বেশির ভাগ প্রার্থী ছিল সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া একঝাঁক আদর্শবান তরুণ কর্মী, যারা ছাত্রজীবনে আদর্শের অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রবেশ করেছিল রাজনীতিতে। আ স ম আবদুর রব তাদের বেছে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মতো এক প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এ অল্পবয়সি তরুণদের নিয়ে তিনি কি জয়ের আশা করেন? আ স ম আবদুর রবের উত্তর ছিল, আড়াই-দশ বছর পর বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। তখন তাকে অবিশ্বাস করার কারণ ছিল না, সবাই তখন ধরে নিয়েছিল, আ স ম আবদুর রবই হবেন শেখ মুজিবুর রহমানের পরের ক্ষমতাসীন ব্যক্তি। সেই নির্বাচনে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও জাসদ পেয়েছিল দুটি আসন, আওয়ামী লীগ পেয়েছিল বাকি সব আসন।
যে দশ বছরের কথা রব বলেছিলেন, জাসদ সেই দশ বছর সময় পায়নি। দুই বছরের মধ্যেই জাসদ যোগ দিল এক বিপ্লবী জোটে; এ জোটের অন্য শরিক ছিলেন গণবাহিনী ও কর্নেল তাহেরের সিপাহি বাহিনী, যারা সংবদ্ধভাবে খালেদ মোশাররফকে পরাজিত করে মেজর জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসালেন। তার পরিণতিতে জাসদ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, ফাঁসির দড়িতে প্রাণ হারালেন কর্নেল তাহের। সেখানেই কার্যত জাসদের মৃত্যু হলো।
কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হলো, কিন্তু জিয়াউর রহমান তো সব জাসদিকে ফাঁসি দেননি। তাহলে ১৯৭৫ সালের পর তারা কোথায় গেলেন? তখনকার তরুণ ছাত্ররা, যারা ১৯৬৬ সাল থেকেই পরিচ্ছন্ন ও স্বাধীনতার রাজনীতির জন্য ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে থেকেও নিজেদের আলাদা করে দেখেছিল, তারাও এ দুই প্রশ্নের উত্তর দিতে দারুণ হোঁচট খাবেন। তাদের কাছে এ জাসদ ফেডারেশন ছিল অপরিচিত। তাদের অনেকেই ফেডারেশনের রাজনীতি গ্রহণ করেননি এবং জাসদ রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এতে জাসদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। জাসদ যদি নিজেদের রাজনীতি নিয়ে এককভাবে কাজ করত, হয়তো তাদের সাফল্য আরও অনেক বেশি হতো, তাদের অকালে পথহারা হয়ে হারিয়ে যেতে হতো না।
হারিয়ে গেল জাসদ
জাসদ কেন নিজের শেকড় ভুলে গিয়ে অন্য আদর্শের আশ্রয় নিল, সেটি নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য বা বিচার-বিশ্লেষণ শোনা যায়নি। আমি শুধু একটা তত্ত্ব দিতে পারি। জাসদের আদর্শে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কথাটা বারবার উঠে এসেছে। এটার কোনোরকম ব্যাখ্যা কখনো দেওয়া হয়নি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যা অবস্থা ছিল, রাষ্ট্রীয় পুঁজি বা ব্যক্তিগত পুঁজি ছিল অনেকটা শূন্যের পর্যায়ে। শূন্যকে দশ দিয়ে ভাগ করেও শূন্য, দশ কোটি দিয়ে ভাগ করলেও শূন্য। তবু তখন সব প্রগতিশীল দলই সমাজতন্ত্র কথাটা ব্যবহার করত, এমনকি আওয়ামী লীগের একটা বড় মন্ত্র ছিল সমাজতন্ত্র, দেশের শাসনতন্ত্রেও সমাজতন্ত্রের উল্লেখ আছে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে। অন্যান্য দল থেকে স্বাতন্ত্র্য বা ডিফরেনশিয়েট করতেই সমাজতন্ত্রের আগে বৈজ্ঞানিক শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। অন্তত জাসদের সাধারণ কর্মীদের ধারণা তাই ছিল। এ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কথাটা অনেকের পক্ষে জাসদকে কোনো একটা বিপ্লবে জড়াতে প্রলুব্ধ করে। এটি একটি হাইপোথিসিস বা অনুমান।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির রাজনীতির একটি প্রসঙ্গ না বললেই নয়। গত পনেরো বছরে তাদের ওপর অনেক অত্যাচার করা হয়েছে। কিন্তু তারা বিভ্রান্ত হয়নি, তারা বাহিনী করেনি, তারা সেনা বিশৃঙ্খলা করায়নি। তারা তাদের রাজনীতির শেকড় কামড়ে পড়েছিল। তারা বাইরের লোককে এনে তাদের রাজনীতিকে হাইব্রিড করেনি। যারা বিএনপির মূল লোকজন, তাদের ঘর গুছিয়ে রেখেছে, যারা নতুন এসেছে, তারাও বিএনপির মূল রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছে। এটাই তাদের মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। আপনি বিএনপির রাজনীতি পছন্দ করুন বা না করুন, তাদের রাজনীতির এ দিকটি সত্যি প্রশংসনীয়।
অনেকেই দায়ী করেছেন আ স ম আবদুর রবকে, কেন তিনি এরশাদের বিরোধী দলের নেতা হলেন? তাতে তার নামে কালিমা পড়েছে, তা অবশ্যই সত্য। কিন্তু ১৯৮৮ সালে আ স ম আবদুর রব বিরোধী দলের নেতা হওয়ার অনেক আগেই জাসদ বিলুপ্ত হয়েছে।
জাসদিরা সময়ের দাবি মিটিয়েছে। যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বলিষ্ঠ উচ্চারণের প্রয়োজন ছিল এবং একে স্বচ্ছভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক অনেক আদর্শবান তরুণের, তারাই এগিয়ে এসেছিল সর্বপ্রথমে।
লেখক : লেখক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ডাকসুর সাবেক সম্পাদক (১৯৭০-৭২)
salehpublic711@gmail.com