দলটি কি কখনো পুনর্গঠিত হতে পারবে?
আতাহার খান
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে প্রায় ছয় মাস আগে। দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার মহা-গণঅভ্যুত্থানে দিশেহারা শেখ হাসিনা শেষ-অবধি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পরে সেখানে আরও আশ্রয় নেন শীর্ষ পর্যায়ের শতাধিক নেতাকর্মী, কেউ কেউ উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। যারা পালাতে পারেননি, তাদের একটা অংশের নেতাকর্মী ধরা পড়ে এখন কারাগারে আছেন। ফলে দলটি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। শুধু কি তাই, দেশের চলমান রাজনীতি থেকে অনেক দূরে সরে রয়েছে দেশের অন্যতম বড় এই রাজনৈতিক দলটি। প্রকাশ্যে তাদের আবার কবে দেখা যাবে বা তারা রাজপথে আদৌ সক্রিয় হতে পারবেন কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। এজন্য দায়ী আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা, শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং দলীয় সুযোগসন্ধানী ক্যাডাররা।
মানবতাবিরোধী গণহত্যা, অর্থ কেলেঙ্কারি, অবৈধ সুবিধা গ্রহণের দায় এখন ঝুলছে শেখ হাসিনার মাথায়। দল ও পরিবারতন্ত্রকে সবকিছুর উপরে স্থান দেওয়ার পরিণতি এখন আওয়ামী লীগ ভোগ করছে। রীতিমতো অস্তিত্বের সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে দলটি। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে যে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি দেশে প্রতিষ্ঠা করে, তার উদ্দেশ্য ছিল পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। এজন্য প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে রাজপথে কোনোভাবেই দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। তাদের নেতাকর্মীরা যেন কথা বলতে না পারেন, তার জন্যও নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয় প্রশাসনকে। বিরোধী জনমত দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও দলীয় অঙ্গসংগঠনের মতো ব্যবহার করে তারা। ফলে বিএনপির নেতাকর্মীদের জেল-গুম-অপহরণের শিকার হওয়ার দৃশ্য অসহায় চোখে দেখা ছাড়া দেশবাসীর অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। অসংখ্য নেতা শুধু গুমই হননি, লাখ-লাখ কর্মীকে জেলবন্দি করা হয়। একটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে-বিএনপির দফতর সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ থেকে শুরু করে ৫ জুলাই ২০২৪ অবধি সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩টি মামলায় ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়। ভেবে দেখুন, প্রধান প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার নামে কী ভয়াবহ দমন আর নির্মমতার আশ্রয় নিয়েছিল আওয়ামী লীগ! বিএনপির অর্ধকোটিরও অনেক বেশি, প্রায় ষাট লাখ নেতাকর্মীকে গত সাড়ে ১৫ বছরের অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়েছে আদালত পাড়ায়। এমনকি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও একটি সাজানো মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে জেলে আটকে রাখা হয়। এসবই ছিল আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির নগ্ন প্রকাশ।
অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেসময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি খণ্ডিত অংশ রোজ গার্ডেনে একত্রিত হয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠা করে। দক্ষিণ এশিয়ার অবিসংবাদিত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হন এ দলের সভাপতি। আর সহসভাপতি করা হয় তিনজনকে-তারা ছিলেন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক আর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ কে রফিকুল হোসেনকে। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। ভাসানীর নেতৃত্বে নানা কর্মসূচির ভিত্তিতে খুব কম সময়ের মধ্যেই রাজপথ সরব করে তোলে আওয়ামী লীগ। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। এর পরের বছরেই দলের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
দল প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৪২ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। শুরুর দিকে তাদের প্রধান দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়। এছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দেশের দুই অঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য দূর করার ইস্যু নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ দলের সভাপতি হওয়ার ৯ বছর আগে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও অগ্রসর চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে করেন ‘আওয়ামী লীগ’। তাছাড়া বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠাসহ দু-দুবার প্রাদেশিক সরকার গঠন আর কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৩ মাসব্যাপী কোয়ালিশন সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এসব কৃতিত্বের কথা স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ খুব একটা স্মরণ করেনি।
স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে দুর্নীতি, লুটপাট, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটাই বিতর্কিত হয়ে পড়ে। বিরোধী মত ও কণ্ঠস্বরকে দমন করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রবিরোধী বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণীত হয় আওয়ামী লীগের হাত দিয়ে। গঠন করা হয় রক্ষীবাহিনী। ১৯৭৪ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে মাঠে নামায় তৎকালীন আওয়ামী সরকার। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটায় আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় সিরাজ সিকদারকে। এর কিছুদিন পর ২৫ জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করা হয়। বাকশাল গঠনের সাত মাসের মাথায় ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তখনই আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। আর দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে ৫ আগস্ট ২০২৪, ছাত্র-জনতার মহা-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর।
শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনা উভয়ই বিরোধী দলে থাকাকালীন রাজপথে আপসহীন ভূমিকা রাখার জন্য অবিস্মরণীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে এ দুজনই ছিলেন গণতন্ত্রবিরোধী স্বৈরশাসক। শেখ মুজিবের আমলে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে গঠন করা হয়েছিল একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল, আর শেখ হাসিনার আমলে তিন তিনটি ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার। দুজনই গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামও করেছেন, কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়েই চরিত্র পালটিয়ে হয়েছেন একনায়কতন্ত্রী স্বৈরশাসক। দুজনের চরিত্রেই এই অদ্ভুত সাযুজ্য আমরা লক্ষ করি। আজ তাদের অফিসে আলো জ্বালানোর মতো একজন মানুষও নেই।
তারপরও মানতে হবে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দল। ৩৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ এ দলের সমর্থক। এই সমর্থকরা চান শেখ পরিবারের বাইরে অন্য কেউ এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করুক। সমর্থকদের এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে নেতৃত্বে অবশ্যই অন্য কাউকে আনতে হবে। সে সম্ভাবনা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আশা করা ছাড়া উপায়ও নেই। যদিও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতা হিসাবে প্রস্তুত করতে; কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আটটি মেগা প্রকল্পের ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে। এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে জয়ের পক্ষে সম্ভব নয় দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করা। তাছাড়া পাশ্চাত্যের ভাষা আর সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষটির নেই দলে কোনো গ্রহণযোগ্যতা। কোনো সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাও তার নেই। ফলে এখানে জয়ের নেতৃত্ব গ্রহণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে এ পদে কাকে চিন্তা করা যেতে পারে? কারও কারও মতে, একজনের কথা ভাবা যেতে পারে। তিনি হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তার একটা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি আছে। রসিক ও সজ্জন মানুষ।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ ভাবমূর্তি দিয়ে কি সম্ভব এত বড় একটি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করা? তার সঞ্চয়ে আছে স্পিকার ও রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করার অভিজ্ঞতা। আর আছে আঞ্চলিক পর্যায়ের রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দল পরিচালনার মতো সাংগঠনিক দক্ষতা কি তার আছে? প্রশ্নটি অবশ্যই উঠবে! ফলে সাবেক রাষ্ট্রপতি আর আলোচনায় আসবেন না। তবে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি রয়েছে দলের দুই প্রবীণ নেতার, তাদের একজন হলেন-আমির হোসেন আমু, অন্যজন তোফায়েল আহমেদ। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমির হোসেন আমুর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। এতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শুধু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি, তার ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। আওয়ামী লীগের পতনের আগমুহূর্ত অবধি তিনি ছিলেন ১৪ দলীয় মহাজোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র। অর্থ কেলেঙ্কারী ও দুর্নীতির অভিযোগে এখন এই নেতা আছেন কারাগারে। বাকি থাকলেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি এখন ভীষণ অসুস্থ, স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন।
পরিবর্তিত রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে সরব হয়ে ওঠা আসলেই অসম্ভব ব্যাপার। সেই পরিবেশ এখন আর নেই। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত থাকছে? যদি ঘটনা সেদিকেই গড়ায়, তাহলে তো এ প্রশ্নও উঠবে যে, একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল কেন নির্বাচনে অনুপস্থিত রয়েছে? তখন বহির্বিশ্বেও সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ তৈরি হবে!
পুনশ্চ : বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে অবস্থিত আওয়ামী লীগের দশতলাবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় অফিসটি কদিন আগেও সর্বস্তরের নেতাকর্মীর পদচারণায় ছিল মুখর। এখান থেকেই দেশের সবখানে, দলের প্রান্তিক পর্যায় অবধি নির্দেশনা যেত। এখন সেই ভবন পুরো জনবিরল, অসীম শূন্যতায় খা-খা করছে। বলা যায়, ভূতুড়ে জায়গায় পরিণত হয়েছে। ৫ আগস্টের পর ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত সাধারণ মানুষ ভবনটি পুড়িয়ে দেয়। এর নিচতলা পরিণত হয় গণশৌচাগারে!
লেখক : সাংবাদিক, কবি ও মুক্তিযোদ্ধা