Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

ভালোবাসি ঘাস

Icon

খন্দকার জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হে পাঠকবৃন্দ, এ নিবন্ধের শিরোনাম দেখে আপনারা ধরে নেবেন না যে, এখানে ইনিয়ে-বিনিয়ে কোনো গরু, ছাগল বা গাধার আত্মকথা বলা হচ্ছে। এমনকি প্রকৃতিপ্রেমী কোনো মানবসন্তানের কাব্যিক মনোভাবকেও এখানে সুকৌশলে ছন্দোবদ্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হয়নি। স্রেফ কিছু নিরেট তথ্য বেরসিকভাবে তুলে ধরাই এ রচনার লক্ষ্য। ছেলেবেলায় স্কুলজীবনে যেমন কুকুর, গরু, নদী, ইত্যাদি বিষয়ে রচনা লিখতাম, এটিও আসলে ঘাসবিষয়ক তেমনি একটি রচনা ভিন্ন আর কিছুই নয়। লেখাটি পড়তে পড়তে যদি কারও ঘুম পেয়ে যায়, তবে আগেই তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

তো শিরোনাম ‘ভালোবাসি ঘাস’ প্রসঙ্গে ফিরে যাই। শুধু গরু-ছাগল কেন, সমগ্র উদ্ভিদভোজী স্থলচর প্রাণিকুলই ঘাস ভালোবাসে। এমনকি বিশালবপু হাতী কিংবা লম্বাগলা জিরাফের মতো বনেদি পশুরাও বড় বড় গাছপালার ডাল-পাতা ভেঙে খেতেই বেশি পছন্দ করে বটে, তবে তারাও কিন্তু ঘাস ভালোবাসে। আর বাকি সবাইকে তো ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত সেই ঘাসের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হয়। অর্থাৎ ঘাস না হলে এ প্রাণীদের কারোই চলে না। ঘাস খেয়েই তারা বড় হয়, ঘাস খেয়েই তারা বেঁচে-বর্তে থাকে। বলাবাহুল্য, তৃণভোজী প্রাণীদের অতিপ্রিয় এ ঘাসের কথা উঠলেই বিস্তৃত প্রান্তর, উপত্যকা, বনবাদাড় ও মাঠঘাটের দৃশ্য আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে যেখানে চারদিকে সবুজ ঘাসের ছড়াছড়ি। এছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও ঘাসের বিরাট অবদান রয়েছে। সাধারণভাবে মাঠেঘাটে যে ঘাস জন্মে থাকে, তার বৈজ্ঞানিক নাম : Eragrostis leptostachya.

আবার যখন ঘাস কাটার প্রসঙ্গ এসে পড়ে, তখন আমাদের গৃহপ্রাঙ্গণে প্রতিদিন শনৈঃ শনৈঃ বেড়ে ওঠা ঘাসরূপী অনাকাঙ্ক্ষিত জঞ্জালের কথা মনে পড়ে যায়। পাশ্চাত্যের লোকেরা এ জঞ্জাল থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পেতে সদা সচেষ্ট থাকে। তাই গৃহপ্রাঙ্গণের এ ঘাস কাটার কাজটি সেসব দেশে মহাসমারোহে করা হয়। Lawn Mowing সেখানে জীবনের আর সব অপরিহার্য কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো-বাঙালি ও ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতির লোকেরা ঘাস কাটাকে জীবনের খুব তুচ্ছ ও হাস্যকর একটি কাজ বলে গণ্য করে। সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই গোরা সাহেবদের অনেক কাজ-কারবারকে নেটিভ ইন্ডিয়ানরা শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও ঘটা করে তাদের ঘাস কাটার ব্যাপারটিকে তাচ্ছিল্যভরে দেখে এসেছে। তাদের ধারণা, মানুষের হাতে যদি তেমন কোনো কাজ না থাকে, কেবল তবেই সে ‘ঘাস কাটা’ বা ‘খই ভাজা’-র মতো তুচ্ছ কাজে সময় অপচয় করতে পারে। তাই আমাদের সংস্কৃতিতে দীর্ঘকাল ওই দুটি কাজ অকর্মণ্য লোকের সময় কাটানোর ফিকির হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে খই ভাজার বিষয়ে আর গেলাম না। তবে ঘাস কাটা ভারতীয় সমাজে কেন অর্থহীন কাজ, তার একটা নীরব মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কিন্তু রয়েছে। আসলে আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর গ্রামে-গঞ্জে, খেত-খোলায়, রাস্তাঘাটে ও ঘরের আনাচে-কানাচে এত বেশিসংখ্যক গোরু-মোষ আর ছাগল-ভেড়া চরে বেড়ায় যে, ঘাস আর বড় হওয়ার ফুরসতই পায় না। আর দৈবক্রমে কোথাও যদি হঠাৎ ঘাস বড় হয়েই পড়ে, তবে গরু-ছাগল লেলিয়ে দিলেই তো হয়, আলাদাভাবে লোক লাগিয়ে পয়সা খরচা করে বা নিজে গতর খাটিয়ে ঘাস কাটার দরকারটা কী! অনেকটা এ রকম একটা প্রচ্ছন্ন যুক্তিই এসব দেশের মানুষের মন ও মস্তিষ্কজুড়ে বিরাজ করছে। সম্ভবত এ কারণেই তাদের মাঝে ঘাস কাটার কাজকে ছোট করে দেখার এ প্রবণতা। (সাধারণত common lawn grass বলতে আমরা যা বুঝি, তার বৈজ্ঞানিক নাম : Lolium perenne)।

আমরা অর্থাৎ মনুষ্য জাতি সরাসরি ঘাস খাই না বটে, তবে সেই ঘাস খেয়ে যে গরু-ছাগল বেঁচে থাকে, অহরহ তাদের ধরে ধরে ভক্ষণ করি। তাদের মাংস না হলে আমাদের অধিকাংশ লোকের একেবারেই চলে না। আবার যারা মাংস খায় না, তারা দুধ তো খায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের খুব প্রিয় এবং পুষ্টিকর এক খাদ্য ও পানীয়ের ব্যাপারে পরোক্ষভাবে আমরা ঘাসের কাছে বড্ড ঋণী। কথা আরও আছে। আমরা ঘাস না খেলেও দেদার ঘাসের বিচি ভক্ষণ করে চলেছি! আমাদের প্রধান খাদ্যের সিংহভাগই আসে ঘাসের বীজ থেকে। কীভাবে! ব্যাপারটি জলবৎ সোজা। এই যে প্রতিনিয়ত আমরা ভাত খাচ্ছি, খিচুড়ি-পোলাও-পায়েস-জর্দা-ফিরনি উদরস্থ করছি, পিঠেপুলি গিল্ছি, চিড়ে-মুড়ি-খই চিবোচ্ছি, তা আসছে চাল থেকে (বৈজ্ঞানিক নাম : Oryza sativa)। আর চাল আসছে ধান থেকে, যা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের অপেক্ষাকৃত বড় জাতের ঘাসের বীজ। আর সেই বড় জাতের ঘাসটিই হলো ধানগাছ। রুটি বা পরোটা কিংবা লুচি অথবা পাউরুটি-কেক-পিজা, যার কথাই ধরা যাক না, সেখানেও ওই একই ব্যাপার। কারণ গমের গাছও আরেক ধরনের বড় জাতের ঘাস, যা ধানগাছের cousin বা জ্ঞাতি ভাই। এবং সেই ঘাসের বীজই হলো গম (বৈজ্ঞানিক নাম : Triticum aestiuvm)। সারা পশ্চিমা জাতি তো popcorn বলতে পাগল। সেটা আসে ভুট্টা থেকে, যা হচ্ছে আরও এক বৃহত্তর জাতের ঘাসের বীজ। সেই বৃহত্তর জাতের ঘাসই হল ভুট্টাগাছ (বৈজ্ঞানিক নাম : Zea mays)। আর চিনি-গুড়ের কথা বলে তো শেষই করা যাবে না। চিনি-গুড়বিহীন খাদ্য জগতের কথা চিন্তাই করা যায় না! পূর্বে উল্লেখ করা সেই পায়েস-জর্দা-ফিরনি আর পিঠাপুলি ছাড়াও সেমাই-হালুয়া, মিঠাই-মন্ডা, শরবত, কেক, চকোলেট, আর হাজারো ধরনের ড্রিংকস? বানাতে যে জিনিসটির দরকার হয় সবচেয়ে বেশি, তা হচ্ছে চিনি-গুড় তথা আখের নির্যাস। (খেজুর বা মেপ্ল্গাছের রসের সীমিত ব্যবহার এক্ষেত্রে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।) আর এ আখ বা ইক্ষু গাছও এক ধরনের বৃহত্তর জাতের ঘাস (বৈজ্ঞানিক নাম : Saccharum officinarum)।

আসলে ‘ঘাস’ একটি পরিবারের নাম, জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় Poaceae, যা একটি গ্রিক শব্দ এবং যার অর্থ : ‘পশুখাদ্য’। এ পরিবারের অন্তর্গত মোট সদস্যের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। Poaceae বা ঘাস পরিবারের বৃহত্তম সদস্য হল : Mr. Bamboo বা শ্রীমান বাঁশ। ক্ষুদ্রাকার দূর্বাঘাস থেকে শুরু করে ধানগাছ, গমগাছ, বেত, নলখাগড়া, কাশ, ভুট্টাগাছ, আখগাছ এবং ছোট-বড় নানা আকারের বাঁশ-সবাই হলেন গিয়ে Poaceae বা ঘাস পরিবারের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদের অন্যতম হলো এ বাঁশ। ভারতবর্ষে সচরাচর যে বাঁশ দেখা যায়, তার বৈজ্ঞানিক নাম : Bambusa tulda. মানুষ যে কতভাবে বাঁশ ব্যবহার করে, তা বলে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীর জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ বাঁশের তৈরি ঘরে বসবাস করে। এমনকি আজকাল হংকং ও জাপানসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেও বাঁশের তৈরি আধুনিক ধরনের আবাসিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে : Bamboo, like true wood, is very much friendly to environment and it’s a natural composite material with a high strength-to-weight ratio useful for structures.

এটি তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা নয়, বাঁশের তৈরি ক্ষুদ্রাকার দোতলা বাসা। হংকং-এর একটি আবাসিক প্রকল্পে এ ধরনের ৮০টি বাঁশের বাসা মাত্র ৮ দিনে বানানো হয় এবং প্রতিটি বাসা বানাতে মাত্র ৬৫০পাউন্ড মূল্যের বাঁশের দরকার হয়েছে।

চীনের ইউনান প্রদেশের মেঙ্ঘাইতে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁশের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার উচ্চতা ৪৬ মিটার, ব্যাস ৩৬ সেন্টিমিটার এবং একেকটি বাঁশের ওজন ৪৫০ কিলোগ্রাম। অর্থাৎ মেঙ্ঘাইয়ের বাঁশ কেবল বিশ্বের বৃহত্তম বাঁশই নয়, বিশ্বের বৃহত্তম ঘাসও বটে!

প্রাচীনকাল থেকেই বাঁশসহ ঘাস পরিবারের অনেক সদস্যকে কেন্দ্র করে অলংকার শিল্প ও বিভিন্ন ধরনের কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছে। কাগজ তৈরির কাজেও এ ঘাস পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। আর বিশ্বের নানা দেশে আদিকাল থেকেই বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র বানাতে এ Poaceae বা ঘাস পরিবারের কতিপয় সদস্যকে বিশেষভাবে কাজে লাগানো হয়ে আসছে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে বাঁশের তৈরি বাঁশি। সত্যি কথা হলো, ‘বাঁশ’ বা ‘বংশ’ থেকেই ‘বাঁশি’ বা ‘বংশী’ শব্দের উৎপত্তি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মানব সমাজের এক মহান বন্ধু হলো এ ঘাস পরিবার, যা প্রকৃতির এক বিশাল উপহার। তাই আসুন, আমরা সবাই ঘাস ভালোবাসি।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম