Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

আইনের শাসন ও রাজনীতি

Icon

এরশাদুল আলম প্রিন্স

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গণতন্ত্রে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। আমাদের সংবিধান সে কথাই বলে (সংবিধান, অনুচ্ছেদ-৭)। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বলছে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মূলনীতি। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব নাগরিক আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার তথা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচারের নিশ্চয়তা পাবে। যদি আরও আগে ফিরে যাই, তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কথা বলতে হয়; যেখানে এদেশের স্বপ্নদ্রষ্টারা বলেছিলেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতেই তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান; কিন্তু সংবিধান বলি অথবা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বলি-শোষণমুক্ত সমাজ, আইনের শাসন, মানবাধিকার, রাজনীতি, সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার-উচ্চারিত ওই শব্দমালাগুলো স্বাধীনতার অর্ধশতক বছর পরেও আমাদের কাছে অধরাই থেকে গেল।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মূল সংগ্রামটি ছিল গণতন্ত্রের সংগ্রাম। পাকিস্তানের অধীনে দীর্ঘ ২৪ বছরে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই ছিল গণতন্ত্রের লড়াই। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে তারা জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ। ফলে, মূল সংকটটি ছিল গণতন্ত্রের সংকট।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণকে ঘিরেই রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়; কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে জনগণের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। জনগণের টেকসই ক্ষমতা মানে টেকসই গণতন্ত্র, টেকসই গণতন্ত্র মানে টেকসই উন্নয়ন। টেকসই গণতন্ত্রে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় থাকে। সেখানে উন্নয়নের গতি শ্লথ হলেও প্রকৃতপক্ষে সে উন্নয়ন জনগণের বৃহত্তর কল্যাণেই হয়ে থাকে ও সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।

রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার প্রাথমিক ও অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো নির্বাচন। নির্বাচনের এ ধারণাটি আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২১ ধারা অনুযায়ী প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছ, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর তিন তিনটি জাতীয় নির্বাচন কি আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড অনুযায়ী অবাধ নির্বাচন হয়েছে? এ প্রশ্ন ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বা মাগুরার নির্বাচন নিয়েও করা যায়। সেসব নির্বাচন যদি অবাধ না হয়ে থাকে, সেটি কার জন্য হয়নি তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে নির্বাচন বিষয়ে আমাদের যে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ছিল তা আমরা রক্ষা করতে পারিনি এটাই চূড়ান্ত সত্য।

একই অনুচ্ছেদের ৩ উপ অনুচ্ছেদ আরও বলছে, জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি। একটি নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে এটাই আকাঙ্ক্ষিত। নির্বাচন মানে জনগণের অবাধ ভোট দান। বিগত ১৫ বছরে একটি নতুন প্রজন্ম এদেশে জন্মগ্রহণ করেছে ও তাদের বিরাট একটি অংশ ভোটার হয়েছে। কিন্তু এ রাষ্ট্রে তাদের অংশগ্রহণ কোথায়? রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন কোথায়?

জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। তবে নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। আবার নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। এ কথাটি অনেকটাই সত্য-তবে, নির্বাচন কমিশনই সব নয়।

দুর্বল গণতন্ত্রে শক্তিশালী কমিশন হতে পারে না। দুর্বল গণতন্ত্রে কমিশনের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা কঠিন; কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন এমন সরকারি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছেন; কিন্তু আমরা কি একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন আজও গঠন করতে পারিনি। ফলে নির্বাচন নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক বিবাদের কোনো সুরাহা হয়নি।

আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনের ওপর মোটা দাগে চারটি দায়িত্ব অর্পণ করেছে। ১১৮ অনুচ্ছেদ বলছে, কমিশন রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন, সংসদ সদস্যদের নির্বাচন, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে। এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে কমিশনকে সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের মাধ্যমে কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা ও সচিবালয় দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন কীভাবে আশা করা যায়? কমিশনের আর্থিক নির্ভরতার বিষয়টি তো রয়েছেই।

নির্বাচনে কালো টাকা ও কালো হাতের প্রভাব ও দাপট আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। নির্বাচনি ব্যয় আইনগতভাবে বাড়ানো হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। আইনগত সীমার বাইরেও কয়েকগুণ বেশি টাকা খরচ করে প্রার্থীরা নির্বাচন পরিচালনা করেন। এর ওপর কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি গত নির্বাচনেও এ নিয়ে কোনো কথা শোনা যায়নি। আমরা ধরেই নিয়েছি, নির্বাচনে কালো টাকার (আইনগত সীমার বাইরে) ব্যবহার হবেই। এভাবে রাজনীতি ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আমরা গোড়াতেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। ফলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতিমুক্ত থাকবেন সেটা আশা করাও কঠিন। এমন বাস্তবতায় রাজনীতি ও নির্বাচন প্রক্রিয়া এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের হাতে। আগে রাজনীতিকরা পেটের দায়ে টুকটাক ব্যবসা করতেন। এখন ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি রাজনীতিতে নেমে গেছেন। মনোনয়ন বাণিজ্যের কাছে প্রকৃত রাজনীতিকরা আজ জিম্মি, অসহায়। প্রতিটি নির্বাচনে বিষয়টি আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। ফলে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন থেকে সত্যিকার রাজনীতিকরা ঝরে পড়ছেন। নির্বাচনে তাদের মনোনয়নও দেওয়া হয় না।

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনেও কিছু সংশোধন করা হয়েছে; কিন্তু যতই আইন সংশোধন করা হোক-সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন দিয়ে প্রকৃত গণপ্রতিনিধিত্বশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তবে, গণতন্ত্র যদি একটি টেকসই ও স্থায়ী রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেখানে সরকারি প্রশাসন দিয়েও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এভাবেই চলে। কিন্তু আমরা এখনো সে অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। তাই দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বারবার উঠছে। সেই দলনিরপেক্ষ সরকারের নাম কী হবে সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু প্রয়োজনটি সর্বজনীন।

আমাদের সব রাজনৈতিক সংকট এ নির্বাচন ঘিরেই ঘুরপাক খায়। কাজেই এ সংকটের সমাধান করতে পারলে অপরাপর অনেক রাজনৈতিক সংকটেরই সমাধান হয়ে যাবে।

আমাদের আরেকটি বড় সংকট হলো আইনের শাসনের সংকট। এটিও মূলত গণতান্ত্রিক সংকট থেকেই উৎসারিত। গণতন্ত্র মানে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। গণতন্ত্র থাকলেই রাষ্ট্রের সবস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চত হয়। গণতন্ত্র না থাকলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই অনিয়ম ও অবিচার বাসা বাঁধে।

গণতন্ত্রহীনতার প্রথম শিকার হয় রাষ্ট্রের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ। কারণ এগুলোই রাষ্ট্রের প্রধান ও প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান। এ তিনটি বিভাগের মূল চালিকাশক্তিই হলো আইন। আইন বিভাগ বা সংসদ আইন প্রণয়ন করে, বিচার বিভাগ সে আইনানুযায়ী বিচারকাজ পরিচালনা করে ও শাসন বিভাগ আইন ও নির্বাহী ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।

আমাদের অনেক রাজনৈতিক বিবাদ থাকলেও নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিবাদ নেই। এ বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ। সব সরকারই একটি নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগ চেয়েছে ও পেয়েছে। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য আইন পাশ করে; কিন্তু সময়ের অভাবে সে সরকার মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আদালতের রায় হয়েছে ২৪ বছর। অথচ রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার মধ্যে মাত্র একটি দফাই আলোর মুখ দেখেছে। বাকি ১১ দফা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বিচার বিভাগকে যদি বিচার কাজের জন্য রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়, সেখানে আইনের শাসন পুরোপুরি আশা করা যায় না। এমন একটি পরিবেশে আইনের শাসনও নিয়ন্ত্রিতভাবেই কার্যকর থাকবে।

আইনের শাসন প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল মতিন বলেছিলেন, আইন হচ্ছে তা-ই, যা বিচারকরা আইন বলে ঘোষণা দেবেন। তিনি মূলত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একথা বলেছেন। ১১১ অনুচ্ছেদ বলছে, আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিমকোর্টের যে কোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় হইবে। কাজেই বিচারকরা যদি স্বাধীন মনোভাব পোষণ করতে না পারেন, তবে আইনের প্রয়োগ ভালোভাবে হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিচারকরা যদি স্বাধীনভাবে বিচার করতে না পারেন, তবে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই আইনের শাসনের নামে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করতে বাধ্য।

আইনের শাসন সম্পর্কে আদালতের ভাষ্য হচ্ছে, ‘আইনের শাসনের মূল বিষয় হচ্ছে সরকারের কাজকর্ম আইনসম্মত কিনা, তা নির্ধারণ করবেন বিচারকরাই। তবে শর্ত এই যে, সেই বিচারকরা নির্বাহী বিভাগ থেকে হবেন স্বাধীন।’ আমাদের বিচারকরা কি নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন।

রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক বা সংস্থা বা অঙ্গসংগঠন সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করে বিচার বিভাগ। এখানেই বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগগুলো থেকে আলাদা। বিচার বিভাগের মাধ্যমেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়; যা রাষ্ট্রের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসনের অবস্থা কেমন, তা বিচার বিভাগের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়। আইনের শাসন বা বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের সংঘবদ্ধ ও যৌথ ধারণাই প্রকৃত অবস্থার নির্দেশক। আইনের শাসন ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের ধারণাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, জনগণ যদি আইনের শাসন ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে, তবে সেখানে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। আর জনগণের ধারণা যদি এ বিষয়ে নেতিবাচক হয়, তবে সে নেতিবাচক অবস্থার আর ক্রমাবনী ঘটে। কারণ, এ অবস্থায় জনগণের মাঝে আইনের শাসনকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

এক্ষেত্রে বিচারকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান অনুযায়ী বিচারক ও বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সংবিধানে যদিও বিচারক নিয়োগে একটি আইন করার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু আজ অবধি সে আইন প্রণয়ন করা হয়নি। সে রকম আইন যে থাকতেই হবে আমি ব্যক্তিগতভাবে তা মনে করি না। কারণ, সংবিধানের এ বিদ্যমান বিধানের আলোকেই এতদিন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হতো। একটা সময় পর্যন্ত বিচারকদের এ নিয়োগ নিয়ে কোনো প্রশ্ন হয়নি। কারণ, তখন জ্যেষ্ঠ ও যোগ্যদেরই নিয়োগ দেওয়া হতো। ধীরে ধীরে সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে।

জ্যেষ্ঠতার ওপর রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য লাভ করতে থাকে।

২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। তৎকালীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই নির্দেশনা দেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাকে প্রয়োজনে বিচারক নিয়োগের জন্য আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের দুজন করে জ্যেষ্ঠ বিচারকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতি যে মতামত দেবেন, তা অগ্রাহ্য করা যাবে না, যদি না সুপারিশকৃত ব্যক্তি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে সম্পৃক্ত থাকেন। বিচারক নিয়োগে এ পর্যবেক্ষণটি আজও কার্যকর হচ্ছে না। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা জরুরি। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে শুধু বিচারকদের ভূমিকাই যথেষ্ট নয়। বিচারকরা আইনানুযায়ী বিচার করেন। বিচার প্রক্রিয়ার নানা স্তরে রয়েছে পুলিশ, প্রশাসনের ভূমিকা। রয়েছে আইনজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুধু পুলিশ আর বিচারকদের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আইনজীবীদের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়।

আইন সবার জন্যই সমান। কিন্তু বাস্তবে তার সমান প্রয়োগ দেখা যায় না। আইনের রাজনৈতিক প্রয়োগ এখানে অতি স্বাভাবিক একটি বিষয়। রাজনীতি করতে হলে জেল-জুলুম সইতে হবে আমাদের মাঝে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু কেন? রাজনীতির সঙ্গে জেল-জুলুমের সম্পর্ক কী? জেল-জুলুমের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অপরাধের। রাজনীতি করাতো কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু এখানে বিরোধী রাজনীতি করা যেন অলিখিত এক অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়েছে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তারা বিরোধীদের ওপর জেল, জুলুম, হামলা, মামলা চালাবে-এ রাজনৈতিক সংস্কৃতিই আমাদের রাজনীতিকে আরও কঠিন করে ফেলছে। এটি আইনের শাসনের পরিপন্থি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হালমা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের কারাজীবন এরই সাক্ষ্য বহন করে।

একই অভিযোগ ও একই সময়ে করা মামলার দ্বিমুখী ফলাফল আমরা দেখেছি। এক-এগারোতে করা মামলাতে খালেদা জিয়ার বিচার হয়েছে। বিচার হয়েছে নাজমুল হুদার। বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাসসহ আরও অনেক নেতাকর্মী। আর সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর একই কায়দায় রাজনৈতিক মামলার খড়্গ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা বারবারই দেখছি। আর এভাবেই আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার ধারণাটি ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এটি জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আমাদের গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে-যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী বছর পরও গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিয়ে আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে অথচ জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আমাদের জন্মই হয়েছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে আমরা আমাদের রাষ্ট্র গঠনের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতেও পিছ পা হয়নি।

১৯৭১ সালে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য, আইনের শাসন ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মাঝে যে রাজনৈতিক ঐক্য হয়েছিল, যার ভিত্তিতে একটি দেশ স্বাধীন হলো অথচ আজ অর্ধশতাব্দী বছর পরে এসে রাষ্ট্রগঠনের সেই মূল চেতনা থেকেই আমরা সরে গেছি যোজন যোজন দূরে। এটি রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের জন্মযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ ও প্রশ্নবিদ্ধ করার শামিল। কাজেই, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ওই চেতনাগুলো আমাদের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠুক এটাই কাম্য। রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এটি সময়ের দাবি।

 

লেখক: আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম