মার্কসের চিন্তার বিকাশ এবং ট্র্যাজেডি
গাজী গিয়াস উদ্দিন
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আধুনিক বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের শোষণ মুক্তির বিপ্লবী কণ্ঠস্বর কার্ল মার্কসের দুর্ভাগা স্ত্রী ও চার সন্তানের অমানবিক দুর্দশার চিত্র পড়ে আমি অঝোরে কেঁদেছিলাম। তারপর ভাবলাম, সভ্যতা ও ইতিহাসের একি ভাগ্য প্রহসনের চিত্র? মার্কস মানব ভাগ্য পরিবর্তন ও বঞ্চনার অবসানে গবেষণা আর সংগ্রাম করে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে (১৮১৮-১৮৮৩) পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
বলা হয় ডারউইনের জীববিজ্ঞানের বিবর্তনবিধি আবিষ্কারের মতো মার্কস আবিষ্কার করেন মানুষের ইতিহাসের বিবর্তনবিধি। মার্কসের কথা ছিল ‘জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প-রাজনীতি, ধর্ম প্রভৃতি চর্চা করার আগে মানুষকে খেয়ে পরে বাঁচতে হয়’। অর্থাৎ খাওয়া পরার অধিকার আদায়ে যিনি চিরসোচ্চার, তারই পরিবার স্ত্রী সন্তান খাওয়া পরার অধিকার বঞ্চিত। যে উৎপাদন ব্যবস্থা বুর্জোয়া সমাজের জন্ম দিয়েছে, সে উৎপাদন ব্যবস্থা কোন নিয়মে চলে তাও দেখিয়ে দিয়েছেন কার্ল মার্কস। মনে প্রাণে বিপ্লবী মার্কস মনে করতেন, ‘বিজ্ঞানই ইতিহাসের চালিকাশক্তি’। বিজ্ঞানের শক্তি বৈপ্লবিক। শ্রমজীবীদের সমাজের মৌলিক চালিকাশক্তি হিসাবে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য ও গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা। এটা তার আপসহীন অক্লান্ত সংগ্রামের স্বাক্ষর বহন করে।
মার্কসবাদ শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে ন্যায়সংগত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। বিশ শতকের রাশিয়া, বুলগেরিয়া, ভিয়েতনাম, চীনসহ বহু রাষ্ট্রে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার নজির স্থাপিত হয়েছে। বিশ্বে বহু রাষ্ট্রে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আর প্রগতিশীল মার্কসবাদীদের মধ্যে। বস্তুবাদী চিন্তাচেতনা বিকাশের ফলে রক্ষণশীল ধর্মপন্থি ও স্থানীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতি পশ্চাৎপদ হয়ে গেছে। কার্ল মার্কসের মৃত্যুর শতবর্ষ পর একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিসসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভোটযুদ্ধে জয়ী হয়ে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে আসছে।
উল্লেখ্য, ১৮ শতকের শেষ দিকে ইউরোপজুড়ে সামন্ততন্ত্র ভেঙে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজের বিকাশ ঘটেছিল। তরুণ মার্কস ছিলেন জার্মান দার্শনিক হেগেলের শিষ্য। বার্লিনে হেগেলপন্থি তরুণ লেখক অধ্যাপকদের ‘ডক্টর ক্লাবে’ তিনি যাতায়াত করতেন। ১৮৪২-৪৩ সালে ‘রাইন গেজেট’-এর সম্পাদক হিসাবে কাজ করার সময় মার্কসের চিন্তাচেতনার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।
জার্মান আদর্শবাদী দার্শনিকদের চেয়ে হেগেলের চিন্তাধারা ছিল অগ্রসর। অবশ্য তিনি Absolute Idea-পরম সত্তায় বিশ্বাস করতেন। হেগেলীয় দর্শনে ‘বস্তুর অন্তর্গত বিপরীতমুখী শক্তির দ্বারাই পরিবর্তনশীলতার জন্ম দেয়। গতি এ পরিবর্তিত অবস্থাকে নিয়ে যায় সমন্বয়ধর্মী পরম এক ভাবরাজ্যের দিকে হেগেল বলতেন, এ পরমভাব থেকে বিশ্বের উৎপত্তি।
১৯ শতকের সূচনালগ্নে তরুণ হেগেলপন্থিরা প্রচলিত ধর্ম, সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক রীতিনীতির বিরোধিতা শুরু করেন। তারা জীবনের যৌক্তিক ও বাস্তববাদী ব্যাখ্যা খুঁজছিলেন। ১৮৩৮ সালে বিদ্রোহী হেগেলেপন্থিরা রুগে সম্পাদিত ‘জার্মান বার্ষিকী’ নামে নতুন মুখপত্রের মাধ্যমে তাদের নতুন চিন্তার প্রচার শুরু করেন। স্টাউস, বয়ার কোপেনের মতো মার্কস হয়ে ওঠেন র্যাডিকেল মতামত ও নাস্তিকবাদে বিশ্বাসী। এ সময় মার্কস বার্লিনে আইন পড়া শেষ করে দর্শনশাস্ত্রে গবেষণা শুরু করেন। তার গবেষণার কন্টেন্ট ছিল ‘গ্রিক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস ও এপিকিউরাসের দার্শনিক মতবাদের পার্থক্য’। ডিমোক্রিটাসের মতে, পরমাণু থেকে জগতের উৎপত্তি। মানুষের জীবনও পরমাণু দ্বারা গঠিত। উভয় দার্শনিকই ধর্ম ও ঈশ্বরের মহিমা স্বীকার করতেন না। এপিকিউরাস বিশ্বাস করতেন, ‘মানুষ ইচ্ছার দ্বারা তার জীবনকে বদলাতে পারে’। এ স্বাধীন ‘জীবনতত্ত্ব’কে মার্কস গ্রহণ করলেন। মার্কস বলতেন, ‘মানুষ প্রকৃতিকে রূপান্তরিত করে নিয়ে বেঁচে থাকে। তাই তিনি ছিলেন ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। মার্কস আরও বিশ্বাস করতেন, জগতের পরিবর্তন সাধন দর্শনের কাজ। ধর্ম বা ঈশ্বর নয়, দর্শন থেকেই মানুষ পাবে পরিবর্তনের প্রেরণা এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। মনির জামানের মতে, ‘এভাবে রাইন গেজেট সম্পাদনার সময়ই আদর্শবাদের উচ্চ চূড়া থেকে বস্তুবাদের সহজ মাটিতে নেমে আসেন মার্কস এবং বৈপ্লবিক গণতন্ত্রবাদ থেকে সাম্যবাদে দীক্ষিত হন। দর্শনকে নামিয়ে আনেন রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে। (পৃষ্ঠা ১৫, কার্ল মার্কস)’ মার্কস বলেন, শ্রম আর দার্শনিক পরস্পরে গড়ে তুলতে পারে এক আদর্শ সমাজজীবন।
মার্কস ও তার পরিবারের ওপর যে করুণ ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়, তা ১৮৪৩ সালের ১৯ জানুয়ারি জার্মান সরকারের কোপানলে পড়ে ‘রাইন গেজেট’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারিয়ে মার্কস ফিরে আসেন মোজেল নদী তীরবর্তী শৈশবের স্মৃতির শহর ট্রিয়ারে। বিয়ে করলেন আবাল্য সহচরী ও প্রণয়িণী জেনি ভন ওয়েস্ট ফানেলকে।
মার্কস আত্মমগ্ন গবেষক ও মানবদরদি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাকে আগলে রাখতেন সাংসারিক দুর্দশা থেকে স্ত্রী জেনি। মার্কসেরও ছিল তার ওপর পরম নির্ভরতা। ১৮৫০ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপনের সময় অবর্ণনীয় অর্থকষ্ট এবং রোগে ভুগে ফ্রান্সিসকা নামের জন্মরুগ্ণ শিশুকন্যার মৃত্যুর দিনগুলোতে স্ত্রী জেনির ত্যাগের ভূমিকা এক পরমোজ্জ্বল ইতিহাস। নিদারুণ অভাব ও দুঃখের মাঝেও স্ত্রী জেনির এ আত্মোৎসর্গ সমালোচকদের মতে পৃথিবীর যে কোনো বিপ্লবীর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এ যেন মাইকেল মধুসূদন এবং কবি নজরুলের জীবনে ঘটে যাওয়া নিয়তির অমোঘ পরিণতি। এ চরম দুঃসময়ে মার্কসের জীবনে বন্ধু এঙ্গেলস ছাড়া লন্ডন নগরীতে আর কেউ ছিল না।
সংস্কারমুক্ত জ্ঞানী এবং নির্ভীক সাম্যবাদী ব্যক্তিত্ব এঙ্গেলস মার্কসের গবেষণা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহকর্মী-পৃষ্ঠপোষক। এঙ্গেলস তখন ম্যানস্টারে তার বাবার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে চাকরির মাইনে থেকে নিয়মিত কিছু টাকা পাঠাতেন পরম বন্ধু মার্কসের জন্য। এঙ্গেলস একা কত সাহায্য করবেন। তাই জেনি উপয়ান্তর না দেখে মার্কসের অগোচরে তার আরেক বন্ধু ওয়েডমেয়ারের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখলেন। সংসারের দুঃখ-কষ্টের বিবরণ দিয়ে লেখা এ চিঠি। এত চিঠি নয়। ইতিহাসের এক মহানায়কের ভাগ্য বিড়ম্বনার করুণ দুঃসহ ট্র্যাজেডির আখ্যান। আমৃত্যু সীমাহীন কষ্টের যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে মার্কসের আগেই পৃথিবী ছেড়ে যান দুর্ভাগা স্ত্রী জেনি। দীর্ঘ পত্রের এক স্থানে জেনি লিখেন-
...আপনি জানেন মিস্টার ওয়েডমেয়ার, নিজের বলতে আমরা কিছুই রাখিনি। সর্বস্ব খুঁইয়েছি পত্রিকার খরচ চালাতে গিয়ে। পত্রিকার দেনা মেটানোর জন্য আমি ফ্রাঙ্কফুর্টে গিয়েছিলাম রুপোর বাসন বন্ধক রাখতে। আমার স্বামী প্যারিসে গেলেন প্রতিবিপ্লবের সময়। তিনটি শিশুকে নিয়ে আমিও গেলাম তার সঙ্গে নিদারুণ ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতে আবার নির্বাসিত হলাম। আবার আমরা ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে লন্ডনে এলাম। একমাস পর আমাদের চতুর্থ সন্তানের জন্ম হলো। লন্ডনের মতো ব্যয়বহুল জায়গায় নিঃস্ব অবস্থায় তিনটি সন্তানের ব্যয়ভার বহন করতে পারি না। তার ওপর আবার চতুর্থের আবির্ভাব। আমাদের অল্প যা কিছু বিষয় সম্পত্তি ছিল তা বিক্রি করে যা পাওয়া গিয়েছিল তা ফুরিয়ে গেল কয়েক মাসের মধ্যে। ‘রিভিউ’ পত্রিকা থেকে চুক্তিমতো টাকা এলো না। যা-ও এলো তা অতিসামান্য। আমরা ভয়াবহ দুরবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমি আপনার কাছে মাত্র একটি দিনের কথা বর্ণনা করব, তা থেকে বুঝতে পারবেন, আমাদের মতো দুঃখ-কষ্ট পৃথিবীর খুব কম বাস্তুত্যাগী বা নির্বাসিত ব্যক্তি ভোগ করেছেন। আমাদের নবজাতক শিশুটির জন্য একজন ধাত্রী রাখা অসম্ভব আমাদের পক্ষে, এজন্য আমার বুক ও পিঠে দারুণ যন্ত্রণা সত্ত্বেও নিজেই শিশুটিকে দেখাশোনা করতে লাগলাম। শিশুটি ছিল জন্ম থেকেই ভীষণ রোগা। এক অজানা রোগযন্ত্রণায় দিনরাত শুধু চিৎকার করত। রাতে এমনকি দু-তিন ঘণ্টাও ঘুমাত না। রোগযন্ত্রণার তীব্রতায় মাঝে মাঝে আমার স্তন এমনভাবে টানাটানি করত যে, আমার স্তনে ঘা হয়ে গেল। দুধ খেতে গেলে দুধের পরিবর্তে ছিদ্রটি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসত তার মুখে। এভাবে একদিন আমি সেই রুগ্ণ মৃতপ্রায় শিশুটিকে নিয়ে বসে আছি আমাদের বাসায়, এমন সময় হঠাৎ আমাদের বাড়িওয়ালা এসে হাজির। আগেকার চুক্তিমতো তাকে আমরা বাড়িভাড়া বাবদ আড়াই থ্রেডার দিয়ে দিয়েছি। আর কথা দিলাম, বাকি টাকা বাড়ির মালিককে পাঠিয়ে দেব পরে। কিন্তু তিনি বললেন, সে চুক্তি তিনি মানবেন না এবং সে মুহূর্তে তিনি বাকি বাড়িভাড়া বাবদ পাঁচ পাউন্ড চাইলেন। কিন্তু তখন ওই টাকা দিতে না পারায় দুজন পুলিশ নিয়ে এসে আমাদের যাবতীয় জিনিসপত্র বিছানা এমনকি দোলনা ও খেলনাগুলোও দেনার দায়ে ক্রোক করলেন। ছেলেগুলো একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তারা মাত্র দুঘণ্টা সময় দিয়ে বলল, এরপর আমাদের সব জিনিস নিয়ে যাবে। আমি তখন নিরুপায় হয়ে খালি ঠান্ডা মেঝেতে যন্ত্রণায় ছটফট করছি আর আমাদের শিশুগুলো আমার চারপাশে কাঁদছে...।’
এ সময় কার্ল মার্কস মগ্নভাবে গবেষণা করছিলেন, একই সঙ্গে কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের মতো জটিল রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছিল। ফলে সংসার আগলে রাখতে সংগ্রাম চালাতে হতো একা জেনিকে। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে এবং আমৃত্যু ঝঞ্ঝার ভেতরে কাটিয়ে মার্কসের আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। মার্কস হেগেল এবং ফয়েরবাখের দার্শনিক চিন্তাগুলোকে আরও একবার পরখ করে নিয়ে বুঝতে পারলেন-প্রচলিত প্রথা ও সমাজব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করাই হলো প্রগতিবাদী দর্শনের কাজ। কারণ, প্রথা বা সামাজিক ব্যবস্থাদি ও আদর্শ একইভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে তা ক্রমশই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, বাধা সৃষ্টি করে মানুষের অগ্রসরতায়।
১৮৪৩ সালের নভেম্বর মাসে প্যারিসে আসেন কার্ল মার্কস। সিদ্ধান্ত নেন, পত্রিকা বের করবেন। পত্রিকার নামকরণ করা হয়-‘ডয়েশ্চে ফারৎসেসিশ্চে ইয়ারবুখের’। সম্পাদক নিযুক্ত হন দুজন-রুগে ও মার্কস। মেহনতি মানুষের মুক্তির পথ একে একে দেখিয়ে দিতে গিয়ে নিজেকে ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ রোগাক্রান্ত করে মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে যান মাত্র ৬৫ বছর বয়সে। বিশ্বের জন্য রেখে যান মেহনতি মানুষের মুক্তির মন্ত্র ‘মার্কসবাদ’। আর নিজেকে উজাড় করে বলে যান-‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’।
প্রতিবেশী চাচা সমতুল্য উচ্চপদস্থ অভিজাত সমাজের লোক ওয়েস্টফ্যালেন-এর ছিল কাব্য সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্য। অল্প বয়সে মার্কস কবি হোমার, গ্যাটে, শেক্সপিয়র, দান্তে, শেলি প্রমুখ মনীষীর সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। সে ছেলেবেলায় মার্কস এতই চিন্তাশীল হয়ে ওঠেন যে, ক্লাসে ছেলেদের ভবিষ্যৎ পেশা, ঠিক করার বিষয়ে রচনা লিখতে গিয়ে তিনি শিক্ষকদের অবাক করে দিয়ে লিখেন, ‘মানুষ পরিপার্শ্বিক বাস্তব অবস্থার প্রভাব কাটিয়ে উঠে স্বাধীনভাবে কোনো পেশা বেছে নিতে পারে না, তাই দেখা যায় ডাক্তারের ছেলে প্রায়ই ডাক্তার হয় আর উকিলের ছেলে উকিল।’
১৮৩৬ সালে মার্কস বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলেন। বার্লিন শহরে তার অভিজ্ঞতা হলো ‘এখানে সরকারি আমলাদের সহযোগিতায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো নিজেদের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন, অন্যদিকে চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীরা সে শক্তিগুলোর ফাঁদ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য চিন্তাভাবনা করছে’।
বার্লিনে আসার কিছুদিনের মধ্যে জেনির সঙ্গে বিয়ের বিষয় পাকা করে ফেলতে চাইলেন মার্কস। চার বছরের বড় মিষ্টি মেয়ে জেনি জন্ম ১৮১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, মৃত্যু ১৮৮১, ২ ডিসেম্বর। মার্কসের শৈশবের গুরু ওয়েস্টফ্যালেনের মেয়ে। পুরো নাম জোহান্না বার্থা জুলি জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেন। মেয়েটির রূপে গুণে সবাই মুগ্ধ। মনের দিক থেকেও জেনি সহজ-সরল এবং দৃঢ়চেতা।
জেনির মতো মেয়েকে পেয়ে মার্কসের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। এ সময় কার্ল মার্কস কিছু কবিতা রচনা করেন। বার্লিন থেকে তিনটি কবিতার সংকলন বের করে জেনির কাছে পাঠিয়ে দেন। ১৮৩৭ সালের ১০ নভেম্বর বার্লিনে বসে বাবার কাছে চিঠি লিখেন মার্কস-
‘...মানুষ উপযুক্ত মনের অবস্থাতে পড়লেই কবিতা লিখতে শুরু করে... আমিও অনেক লিখেছি। জেনিকে পাঠিয়েও দিয়েছি। ....কবিতা আমাদের সব সময়ের সঙ্গী নয়। মাঝে মাঝে হঠাৎ আসে, আবার চলে যায়, কবিতা মানে কামনার গান।’ কবিতার সঙ্গে মানুষের মনের অবস্থা আর বাইরের সঙ্গ ছেড়ে নির্জন আত্মচিন্তা এবং পড়াশোনার গভীরে কবিতার যে সম্পর্ক, সেটা মার্কস যথার্থই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক