Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

সংঘবদ্ধ জীবনের রূপকল্প : প্রসঙ্গ বাংলাসাহিত্য

Icon

আহমেদ বাসার

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাহিত্যের উত্থান মূলত ব্যক্তির চিন্তাচেতনা-বিশ্বাস ও স্বকীয় অভিব্যক্তি থেকে। ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসাবে সাহিত্য পালন করে এক যুগান্তকারী ভূমিকা। ব্যক্তির মনোগহিনে কিংবা অবচেতনে লুকায়িত আকাঙ্ক্ষা কিংবা অভিপ্রায়গুলো ভাষা খুঁজে পায় সাহিত্যের আঙ্গিকে। ফলে সাহিত্য ব্যক্তির আত্মগত অনুভূতি প্রকাশের অকৃত্রিম হাতিয়ার হয়ে ওঠে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত কিংবা বিপর্যস্ত ব্যক্তি-মানুষ সাহিত্যের কাছে প্রার্থনা করে আশ্রয় ও প্রশান্তি। আত্মগত সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা সাহিত্যে সঞ্চারিত করে ব্যক্তি এক ধরনের বিমোক্ষণ (Cathersis) লাভ করে। কখনো প্রতীক সংকেত কিংবা রূপকের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার মনোব্যস্ততার ভিন্নতর উদ্ভাসন ঘটায়। সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম কবিতা ব্যক্তি-অনুভবের বৈচিত্র্যময় বর্ণ-বিভায় সমুজ্জ্বল। ব্যক্তি অনুভব কবিতায় যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। ব্যক্তি চেতনা প্রথম শিল্পরূপ পায় লোকজ ছড়া ও প্রবাদ-প্রবচনে। কোনো একক ব্যক্তির একান্ত মুহূর্তের অনুভব ছড়ার আঙ্গিকে হয়তো প্রথম রূপ পায়। তারপর অন্য কারও মুখে তা কিছুটা ভিন্ন রূপে উচ্চারিত হয়। এভাবে একেকজনের কাছে একেক অভিব্যক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে অবশেষে তা সাধারণ জনগণের কিংবা একটি জাতির মানসসম্পদে পরিণত হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিক চেতনার সামাজিকীকরণ ঘটে যায়।

ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ-আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন। এ আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি একদিকে যেমন স্বকীয় অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়, অন্যদিকে তেমনি অন্যের সঙ্গে সম্পর্কও স্থাপন করে। ‘মানুষের মৌল প্রবৃত্তিই হচ্ছে তার আত্মপ্রকাশ প্রবণতা-যে প্রবণতা ব্যক্তিকে সমষ্টিগত জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে। এ প্রকাশ-আকাঙ্ক্ষার গভীরে নিহিত রয়েছে মানব মনের সেই মৌল অভীপ্সা, যা সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষকে সামূহিক জীবন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামরত বিচ্ছিন্ন মানুষকে অনিবার্য কারণেই গ্রহণ করতে হয়েছিল যৌথ জীবন প্রণালিকে। অতঃপর সংঘ জীবনের প্রয়োজনে ও সংঘাতে মানুষের ধ্বনি রূপান্তরিত হলো ভাষায় এবং সেই জীবনের বিস্তার ও চৈতন্যগত উৎকর্ষ আদিম শব্দপুঞ্জকে প্রার্থনা-সংগীতে পরিণত করতে সক্ষম হলো।’ লিপিরূপ প্রাপ্তির পূর্বে মানুষের মুখে মুখে ও স্মৃতিতে কবিতা প্রবহমান ছিল। ব্যক্তি ও সংঘচেতনার যৌথপ্রবাহ তাতে দৃশ্যমান। তবে এর পেছনে ব্যক্তির অস্তিত্ব রক্ষার অভিপ্রায় ও পরিবেশ-বাস্তবতার ভূমিকাও কম নয়। জন্মগতভাবে অসহায় মানুষ বাঁচার তাগিদে গড়ে তুলেছে সমাজ ও সংঘবদ্ধ জীবনের রূপকল্প। সমাজের যৌথ কণ্ঠস্বরেও ব্যক্তি নিজেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে চায়। কালের বুকে এঁকে দিতে চায় স্বকীয়তার চিহ্ন। ফলে ব্যক্তিচেতনার স্বর তাতে স্পন্দমান। আবার সমাজে প্রচলিত কোনো বিশ্বাস, মূল্যবোধ ব্যক্তির অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে। সমাজ বাস্তবতার কোনো অনুষঙ্গ ব্যক্তি প্রতিভার আলোয় শিল্পীত হয়ে অন্যের অভিব্যক্তির সঙ্গে মিশ্রিত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। ফলে ব্যক্তিক ও সামাজিক চেতনার মিলিত স্রোত এগুলোতে দৃশ্যমান।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য ঐতিহ্য কিংবা লোকজ সাহিত্যের আঙ্গিকেও ব্যক্তিক ও সামষ্টিক চেতনার অখণ্ড প্রবাহ লক্ষযোগ্য। চর্যাপদ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রূপক প্রতীকী সাধন-সংগীত হলেও পদকারদের ব্যক্তিগত জীবনচর্যা এখানে দুর্নিরীক্ষ নয়। ডোম্বিনীর প্রতি কাহ্নপার প্রণয়াসক্তি কিংবা দারিদ্র্যপীড়িত জীবন ও সংসারযাত্রার নিবিড় চিত্র চর্যাপদের পদগুলোতে সহজলক্ষ। ব্যক্তিক ক্ষোভ বিক্ষোভ; হতাশা, বেদনা কিংবা ব্যর্থতার হাহাকারও এখানে দৃশ্যমান। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :

ক) ‘আলো ডোম্বি তো এ সম করিব মই সাঙ্গ,

নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ’

‘ভাব ন হোই অভাবণ জাই।

অইস সংবোহেঁ কো পতিআই ॥’

প্রথম উদ্ধৃতিতে প্রণয় সম্ভাষণের চিত্র লক্ষযোগ্য। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে প্রাধান্য পেয়েছে অভাবগ্রস্ত জীবনের সংক্ষোভজনিত ব্যক্তিক অভিব্যক্তি। তবে সমষ্টি জীবনের উত্তাপকেও চর্যাপদ ধারণ করেছে নিবিড়ভাবে। মূলত চর্যাপদ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ধর্মানুভূতিরই সংহত ও প্রতীকী রূপ। ফলে একটি সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক জীবনের পরিচয় এখানে সুস্পষ্ট। পাশাপাশি চর্যাপদে বিভিন্ন পেশা, শ্রেণি ও বর্ণের মানুষের পদচারণায় মুখর। শবরী, ব্যাধ বা নিষাদ; ডোম, চণ্ডাল কিংবা কাপালিকের জীবনচিত্র চর্যাপদে নানাবর্ণে মুদ্রিত। শ্মশানে শবদাহ করে চণ্ডালের জীবিকা নির্বাহ; আর্যপূর্ব অস্ট্রিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত শবরদের কৃষি ও ব্যাধবৃত্তির অবলম্বন কিংবা সমাজে অস্পৃশ্য ডোমদের নগরের বাইরে অবস্থানের কথা চর্যাপদে বিধৃত।

মধ্যযুগের সাহিত্যে ব্যক্তিচেতনা প্রকাশের সুযোগ সীমিত হলেও কবিদের ব্যক্তিগত অনুভব কোনো বিশেষ চরিত্র কিংবা ঘটনার আড়ালে প্রকাশরূপ পেয়েছে। রাধা ও কৃষ্ণ মধ্যযুগের সাহিত্যের দুটি অপরিহার্য চরিত্র। মানবকুলের প্রতিনিধি রাধা ও ঈশ্বরের রূপক কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে কবিগণ আত্মানুভবকে কবিতায় সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কবিদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার চিত্র। কৃষ্ণের নাম শুনে রাধার আকুলতা, হৃদয়ে প্রেমের উন্মেষ, দেহ সম্ভোগের অভীপ্সা কিংবা কৃষ্ণের অভিসারে ঝঞ্ঝামুখর রাতে রাধার ছুটে চলা, কখনো কখনো কৃষ্ণের রাধা দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় বৃষ্টি-ভেজা রাতে আঙিনায় এসে দাঁড়িয়ে থাকার চিত্র কবিরা নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই অঙ্কন করেছেন। নিজস্ব প্রণয়-ভাবনা কিংবা যন্ত্রণার অনুভূতিও তারা নির্দ্বিধায় সঞ্চারিত করেছেন কৃষ্ণ কিংবা রাধার প্রেম ও বিরহের সমান্তরালে। বিদ্যাপতির একটি পদে রাধা-বিরহের দৃশ্যটি লক্ষ করা যাক-

‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর,

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর॥

ঝম্পি ঘন গর- জন্তি সন্ততি

ভুবন ভরি বরি খন্তিয়া,

কান্ত পাহুন কাম দারুণ

সঘনে খর শর হন্তিয়া॥’

ভাদ্র মাসের ভরা বাদলের রাতে প্রিয় সঙ্গহীন রাধার যে হৃদয় বেদনা ও শরীরী চেতনা উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে তাতে কবির ব্যক্তি চেতনার প্রক্ষেপ না ঘটলে চিত্রটি এতটা প্রাণান্ত হতো না। কবিদের ব্যক্তিচেতনার প্রক্ষেপ ঘটায় কেউ কেউ বৈষ্ণব পদাবলিকে গীতিকবিতার মর্যাদা দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে তৎকালীন সমাজ ও সংসার জীবনের রেখাচিত্র বৈষ্ণব পদাবলিতে লক্ষণীয়। মধ্য যুগের অন্যতম সাহিত্যধারা মঙ্গলকাব্যে বাঙালির গোষ্ঠী জীবনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির বিশ্বাস-সংস্কার, চিন্তাচেতনা ও জীবনযাপন পদ্ধতি মঙ্গলকাব্যে নিপুণভাবে উঠে এসেছে। আবহমানকাল ধরে বয়ে আসা লোকজ জীবনবলয় এখানে নানাভাবে উদ্ভাসিত। মনসামঙ্গল কাব্যধারায় জল ও জঙ্গলবেষ্টিত বাংলার সর্পভয়ে ভীত মানুষের সামাজিক, সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের রূপরেখা বিন্যস্ত হয়েছে। সর্পদেবী মনসার উত্থান ও প্রতিষ্ঠা এ শ্রেণির কাব্যধারার মৌল প্রবণতা হলেও বাঙালির সংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব চাঁদ সদাগর ও বেহুলা চরিত্রের মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়েছে। সনকা হয়ে উঠেছে আবহমান বাঙালি নারীর প্রতিনিধি। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য ধারায় কালকেতু ফুল্লরার দারিদ্র্যপীড়িত সংসারযাত্রা, কালকেতুর ব্যাধবৃত্তি, ফুল্লরার সপত্নী সন্দেহ, স্বামীর প্রতি আনুগত্য বাঙালির অন্দরের চিত্রকেই যেন আভাসিত করে। অন্যদিকে খুল্লনা ও লহনার স্বামীর সংসারে আত্ম প্রতিষ্ঠার লড়াই, সপত্নীর প্রতি অসহিষ্ণুতা, এছাড়া বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রথার বিষবাষ্প এ কাব্যধারায় প্রতিভাত হয়েছে। আর অন্নদামঙ্গল কাব্যে অন্নচিন্তায় ত্রস্ত মানুষের সন্তানসন্ততি কিংবা ভাবী প্রজন্মের অন্নের নিশ্চয়তার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে সমষ্টির কণ্ঠস্বরই মুখ্য, ব্যক্তিকে সেখানে ঠিক স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। আধুনিক সাহিত্যে ব্যক্তি তার স্বকীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ব্যক্তির দৃষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত হয় সমাজ-সংসার-জনপদ। অর্থাৎ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় পারিপার্শ্বিক আবহ। আধুনিক কবিতায় ব্যক্তির কণ্ঠস্বর খুব স্পষ্ট। মাইকেল মধুসূদন দত্তের চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬) তে তার ব্যক্তিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্র কাব্যের বিস্তৃত ভূখণ্ডে ব্যক্তি অনুভবের স্পন্দন লক্ষযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের মানস বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর তার কাব্যে রেখাপাত করেছে। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতায় কবির যে আত্মবোধের জাগরণ তার বিস্তার ঘটেছে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোয়। পাশাপাশি সমসাময়িক সমাজ-সময়-পরিপার্শ্ব সংশ্লিষ্ট বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তির রূপায়ণ ঘটেছে তার সৃজনবিশ্বে। বাংলা কবিতায় আত্মবোধের দীপ্ত অভিব্যক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবিতায় ‘আমি’র সর্বগ্রাসী উত্থান এক নতুন বোধ ও ভাষায় উৎসারিত। তবে এই ‘আমি’ নৈঃসঙ্গ্যচেতনাতাড়িত নয়, বরং সমষ্টি জীবনের উত্তাপে উজ্জীবিত ও উচ্চকিত-

‘আমি সন্ন্যসী, সুর-সৈনিক,

আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!

আমি বেদূঈন, আমি চেঙ্গিস,

আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুনির্শ!’

এই আত্মমগ্ন, দুর্বিনীত ও বিদ্রোহের বীজমন্ত্রে দীক্ষিত ‘আমি’র ব্যক্তিবোধের মধ্যে একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টির জেগে ওঠার অভিনব প্রণোদনাও লক্ষযোগ্য।

তিরিশের দশকের কবিদের মনোবিশ্ব কবিতায় বিম্বিত হয়েছে নানাভাবে। ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, ক্ষোভ, বিক্ষোভ কিংবা বিষাদের বিষবৃক্ষ ডালপালা মেলেছে তাদের সৃষ্টিলোকে। তবে কেউ কেউ সমষ্টি জীবনের সঙ্গেও একাত্ম হতে চেয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের শেষ দিক্কার কাব্যগ্রন্থগুলোতে সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক সমস্যার স্পন্দন লক্ষযোগ্য। সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮) বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১) কাব্যগ্রন্থগুলোতে কবির সমষ্টি চেতনার প্রকাশ সুস্পষ্ট। বিষ্ণু দে’র কাব্য মার্কসবাদী চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত। অর্থাৎ সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তাকে আলোড়িত করেছিল। তবে ব্যক্তিক চেতনার প্রক্ষেপই সামগ্রিকভাবে তিরিশের দশকের কবিতায় প্রবল, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। জীবনানন্দের ব্যক্তিচেতনার বর্ণিল বিভা কিংবা বুদ্ধদেব বসুর আত্মমগ্ন কল্পবিশ্বের হাতছানি তিরিশের কবিতাকে বিশেষত্ব দিয়েছে। তবে চল্লিশের দশকের কবিতা সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না। চল্লিশের দশকের কবিরা অনেক বেশি সমাজসংশ্লিষ্ট। তারা সচেতনভাবে সমাজের গভীর সমস্যাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সেখানে খুঁজে পেয়েছেন শ্রেণিভেদ ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অনিবার্য শোষণ-বঞ্চনার ইতিবৃত্ত। তাদের কবিতায় এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্র্য প্রমুখ কবির কবিতায় এ প্রবণতাগুলো সহজলক্ষ। আবার এ সময়ই ফররুখ আহমদ এবং সৈয়দ আলী আহসান মুসলমান জাতির মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন। আহসান হাবীব সামাজিক সমস্যাকে প্রত্যক্ষ করেছেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে ব্যক্তিক অভীপ্সার নিপুণ রূপায়ণেও তিনি সুদক্ষ।

সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত লোকজ সাহিত্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গ ব্যক্তিক ও সামষ্টিক চেতনার মিলিত স্রোতে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। রূপকথা, লোককথা, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতিতে ব্যক্তিচেতনার সমষ্টিমুখী অভিযাত্রা লক্ষযোগ্য। এসব লোককথা, ছড়া কিংবা প্রবাদ-প্রবচনের জন্ম মূলত মানুষের মুখে মুখে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, কোনো বিশেষ ব্যক্তির মুখে জন্মলাভ করে ধীরে ধীরে এগুলো অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকে, ফলে সর্বজনীন একটি আবহ লাভ করে। কখনো কখনো দেখা যায় প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলোর যে ভাব-রূপ কিংবা আকৃতি থাকে, ধীরে ধীরে তাতেও আমূল পরিবর্তন আসে। লোকসাহিত্যের উপাদানগুলোর একটি বড় বৈশিষ্ট্য অকৃত্রিমতা। এগুলো কৃত্রিম সাহিত্যিক প্রসাধন থেকে বহুদূরবর্তী। সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম অনুভব এখানে নিবিড়ভাবে উঠে আসে। ফলে একটি জাতির হৃদস্পন্দন এগুলোতে যতটা স্পষ্টভাবে শোনা যায়, অন্য কোথাও ততটা নয়। রূপকথায় মানুষের অসম্ভব কল্পনা শিল্পিত রূপ লাভ করে। বাস্তবে যা কখনো সম্ভব নয় তাই উঠে আসে রূপকথার আঙ্গিকে। এ রূপকথাগুলো যুগ যুগ ধরে লোকের মুখে মুখে প্রবহমান। এগুলোর উদ্ভব সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রূপকথাগুলো অঞ্চলভেদে কিছুটা ভিন্নতা লাভ করে। আবার অঞ্চলভেদে রূপকথার ভিন্নমাত্রিক উদ্ভাসনও লক্ষযোগ্য। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তি-স্বভাব কিংবা সামাজিক প্রবণতাগুলোও এর সঙ্গে কখনো কখনো অঙ্গীভূত হয়ে ওঠে। বাঙালির চিন্তাচেতনা ও জীবনযাত্রার নির্যাস স্ফটিকরূপ লাভ করেছে প্রবাদ-প্রবচনগুলোতে। প্রবাদ-প্রবচন বিশদ জ্ঞান কিংবা অভিজ্ঞতার সার-সংক্ষেপ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এগুলোর জন্মস্থল হলেও বহুজনের প্রয়োগ-বৈচিত্র্যে প্রবাদ-প্রবচন সমষ্টির সম্পদে পরিণত হয়েছে। প্রবাদ-প্রবচনকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই ‘প্র’ অর্থাৎ বিশিষ্ট এবং ‘বাদ’ বা ‘বচন’ মানে উক্তি। অর্থাৎ বিশিষ্ট বা তাৎপর্যপূর্ণ কথাই প্রবাদ-প্রবচন। সাধারণ মানুষ কিংবা গ্রাম-গঞ্জের খেটে-খাওয়া মানুষের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার নির্যাস প্রবাদ-প্রবচন। অর্থগত দিক থেকে প্রবাদ-প্রবচনগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়-অভিজ্ঞতামূলক, নীতিকথামূলক, ইতিকথামূলক, ঐতিহাসিক, মানবচরিত্রের সমালোচনামূলক, সমাজের রীতি-নীতি, প্রসিদ্ধ ঘটনাকেন্দ্রিক প্রভৃতি। এ প্রবাদ-প্রবচনগুলো বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন প্রচলিত তেমনি সাহিত্যিক সৃষ্টিতেও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রবাদ-প্রবচনের সংযোগ সাধিত হয়ে বৃহত্তর বোধ ও লোকাত্তর অনুভবে উত্তীর্ণ হয়। ব্যক্তির সামাজিক ও মনোজাগতিক বাস্তবতায় প্রবাদ-প্রবচন সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে যায়। ব্যক্তির জীবনদৃষ্টি ও জীবনভাবনার বিনির্মাণেও এগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক চেতনার যুগলপ্রবাহ প্রবাদ-প্রবচনে দৃশ্যমান। এগুলো একদিকে যেমন ব্যক্তিক চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যদিকে তেমনি সামষ্টিক চেতনাকেও ধারণ করে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। ডাক ও খনার বচনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ডাক ও খনার জীবন, জগৎ প্রকৃতি ও কৃষিবিষয়ক বচনগুলো ব্যক্তিক চেতনার ফসল হলেও এগুলো ধীরে ধীরে সমষ্টির সম্পদ হয়ে উঠেছে।

লোকজ জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যময় অনুষঙ্গকে সহজ-সরল ভাষায় ধারণ করে ছড়াবিশিষ্ট ও জনপ্রিয় সাহিত্য আঙ্গিকে পরিণত হয়েছে। ছড়া মানুষের মনের তাৎক্ষণিক অনুভবকে ছন্দোবদ্ধভাবে ধারণ করে। ফলে খুব সহজেই তা মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে যায় এবং ব্যপ্তি লাভ করে। মানুষের মুখে মুখে বিস্তার লাভ করে ছড়া ধীরে ধীরে গণমানুষের মানসসম্পদে পরিণত হয়। ছড়ায় ছোট ছোট ও সহজ সরল শব্দের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ ঘটে। জটিল ভাব ও জটিল শব্দ ছড়ায় সাধারণত ব্যবহৃত হয় না, যদিও কখনো কখনো বৃহৎ ভাব সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশরূপ পেতে পারে। কিন্তু ছড়ার মৌল প্রবণতা সারল্য। সরলতাই ছড়ার অলংকার। ছড়ায় ব্যক্তিপ্রতিভার স্পর্শ সহজলক্ষ। কিন্তু মানুষের স্মৃতি ও মুখে পুনরাবৃত্ত হতে হতে শেষ পর্যন্ত তা সার্বজনীন রূপ লাভ করে। আধুনিককালে ছড়া ছড়াকারদের ব্যক্তিগত সৃষ্টি হলেও আবহমানকাল থেকে যেসব ছড়া আমাদের সমাজে চলে আসছে তাতে সমষ্টিচেতনার উত্তাপ খুব সহজেই টের পাওয়া যায়। মূলত বাংলাসাহিত্য প্রারম্ভিক সময় থেকেই ব্যক্তিক ও সামষ্টিক চেতনায় আন্দোলিত। ব্যক্তিগত অভীপ্সা যেমন সাহিত্যে ভাষা পায় তেমনি সমষ্টি জীবনের আকাঙ্ক্ষাও তাতে স্পন্দিত হয় স্বাভাবিকভাবে।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম