Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি : সুফল-কুফল

Icon

ওয়াহিদ জামান

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা ও রাজনীতি দুটো ভিন্ন পথ হলেও উদ্দেশ্য মহৎ। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোর পথ দেখানো। আর রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো সমাজ ও রাষ্ট্রপরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। যে জাতি যত শিক্ষিত, তার সমাজজীবনও তত উন্নত ও সভ্য। তেমনই যে জাতির রাজনীতি যত সমৃদ্ধ, সে জাতিও তত বেশি উন্নত। তবে সভ্যতার বিকাশ সাধনে শিক্ষার অবদান সবচেয়ে বেশি। তাহলে শিক্ষার অবয়ব এমন হতে হবে, তা যেন রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক না হয়। জাতির চাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে শিক্ষার গুণগত মান নিরূপণ করা দরকার। তা না হলে কোনো জাতি প্রকৃত অর্থে সভ্য জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। এ শিক্ষাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর কথা ভেবে কালের পরিক্রমায় ভিত্তি লাভ করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে কালের চাহিদায়। রাজনীতির উদ্দেশ্যও শিক্ষার মতো মহৎ। জাতি বা রাষ্ট্রের পথপরিক্রমা কেমন হবে, তা নির্ভর করে সেই জাতি বা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চিন্তার ওপর।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সুশিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য বারে বারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপরাজনীতির চর্চার ফলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কাম্য নয়। কিন্তু বিগত তিন দশক ধরে আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা এতটাই বেড়েছে, তার সুফলের চেয়ে কুফল জাতি ভোগ করছে।

একাডেমি শিক্ষাব্যবস্থার স্পষ্ট ইতিহাস জানা যায় না। তবে ধরে নেওয়া হয় গ্রিক শব্দ ‘আকাদেমি’ থেকে এর উদ্ভব হয়েছে। বিশ্বনন্দিত গ্রিক দার্শনিকের হাত ধরে প্রথম আধুনিক একাডেমি শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের উপমহাদেশে আধুনিক একাডেমি শিক্ষা চালু হয় দিল্লির সালতানাত যুগে। তবে এ উপমহাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তন হয় ইংরেজ শাসনামলে। ইংরেজরা উচ্চশিক্ষাকে লাভজনক ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। সামাজিক মর্যাদা, সরকারি চাকরি, ব্যবসায়িক সুবিধা, জমিদারি, ভূমির অধিকার লাভ, আত্মপ্রতিষ্ঠাসহ সামাজিক নাগরিক সুবিধার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষাকে শর্ত করে দেওয়া হয়। ফলে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আগে শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশাকে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করত; কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে শিক্ষকদের মধ্যে সুকৌশলে বৈষয়িক সুবিধা হাসিলের চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্ররাও স্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষা গ্রহণ উদ্দেশ্য মনে করে। ফলে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে নানা টানাপোড়েনের উন্মেষ ঘটে। যে কারণে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির জন্ম হয়। এতে করে নানা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা হয় বিশেষ করে ইংরেজ বেনিয়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি যে পরবর্তীকালে একেবারে ক্ষতির কারণ হয়েছে তা কিন্তু নয়। এর ইতিবাচক ভূমিকাও রয়েছে। বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে ছাত্ররাজনীতি বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা আছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের উত্তাল আন্দোলন পাকিস্তানি শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এত বেশি অবদান রেখেছিল, অন্যান্য গোষ্ঠীগত আন্দোলনের চেয়ে ঢের বেশি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির সবচেয়ে কলঙ্কময় দিক হলো শিক্ষকদের রাজনীতি। যেহেতু শিক্ষকরা মানুষ, কোনো ভিন গ্রহের বাসিন্দা নয়, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ বা পরিচয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সক্রিয়ভাবে কোনো একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ সত্যি দুঃখজনক। যার নেতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে পড়ে এবং শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাল-নীল নানা নামে শিক্ষকদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে। এভাবে হয়তো শিক্ষকরা বৈষয়িকভাবে লাভবান হয়, কিন্তু এর কুপ্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রে তথা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি জীবনে পড়ে।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যারা ছাত্ররাজনীতি করতেন, তাদের মধ্যে আদর্শিক দিকটি ছিল মুখ্য। তারা স্বার্থ চরিতার্থের প্রত্যয়ে রাজনীতি করেননি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্বার্থরক্ষায় আন্দোলন করেছেন। এছাড়া রাষ্ট্রের সংকট মুহূর্তে তারা তাদের প্রজ্ঞা ও মেধার সমন্বয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎকর্ষতায় বড় ভূমিকা রেখেছেন। সেসব ছাত্ররাজনীতিকদের মধ্যে পড়াশোনা ও দেশপ্রেম ছিল। নির্মোহ চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে তারা রাষ্ট্রের সুফল বয়ে এনেছেন; কিন্তু বিগত তিন দশকের প্রেক্ষাপট হিসাব করলে ছাত্ররাজনীতির কলঙ্কিত অধ্যায় ছাড়া আর কিছু পরিলক্ষিত হয় না। মোদ্দাকথা এ সময়ে যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের মুষ্টিমেয়সংখ্যক ছাত্র দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহ্যগত বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। অধিকাংশ ছাত্রনেতার মধ্যে যথেষ্ট পড়াশোনা ও জ্ঞানের অভাব আছে। ফলে ছাত্ররাজনীতি এখন বেনিয়াপনা ছাড়া আর কিছু নয়।

এসব ছাত্র রাজনীতিবিদের মধ্যে অর্থ ও ক্ষমতার লোভ দানাবাঁধে। তারা সহজে বড় রাজনীতিবিদ ও সম্পদশালী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাদের একতরফা দোষারোপ করা যায় না। যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে তারা বেড়ে ওঠেন, সেখানে স্বচ্ছ রাজনীতি চর্চার পরিবেশ একেবারে নেই বললেই চলে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ করা কঠিন। কারণ, এর শেকড় এতটা গভীরে, তার বিস্তৃত প্রভাব সামাজিক ও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে। ফলে এটি উপড়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব। তাহলে এ পরিস্থিতিতে কী করা দরকার? উত্তরে বলব, ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে বিশুদ্ধ করতে হবে, যদিও এটি রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব নয়। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির দুয়ার উন্মোচন করতে হবে। এমনই নীতিগত আদর্শ প্রচার করতে হবে, যেসব শিক্ষার্থী রাজনীতির ছায়াতলে আসতে চায়, তারা দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন। নিজের স্বার্থকে শিকেয় তুলে রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণই হবে তাদের একমাত্র ব্রত; তা নাহলে অদূর ভবিষ্যতে এ জাতি অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম