Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

নতুন পাঠ্যক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পর্যবেক্ষণ

Icon

আরণ্যক শামছ

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বব্যাপী জাতীয় শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য ও মতবাদ সম্পর্কে হাজারো ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য অনেক ধারণার মধ্যে একটি হচ্ছে :

‘The National Curriculum specifies the minimum standards of knowledge and skills to be achieved at each grade and sets high, achievable standards in all subjects’. অর্থাৎ, ‘জাতীয় পাঠ্যক্রম প্রতিটি গ্রেডে অর্জন করা জ্ঞান এবং দক্ষতার ন্যূনতম মানগুলো নির্দিষ্ট করে এবং সব বিষয়ে উচ্চ, অর্জনযোগ্য মান নির্ধারণ করে।’

উপরোক্ত ধারণার আলোকে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা ও নতুন পাঠ্যক্রম প্রবর্তন সম্পর্কে কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি।

বাংলাদেশের নতুন পাঠ্যক্রম, যা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (NCTB) কর্তৃক পাঠ্যক্রম-২০২২ নামে পরিচিত এবং ২০২৩ সাল থেকে শ্রেণিভিত্তিক পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে বলে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে। এ নতুন পাঠ্যক্রমের লক্ষ্য হলো শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং শিক্ষার্থীদের আরও প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তব শিক্ষা প্রদান করা। এটি শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে উৎসাহিত করার জন্যও ডিজাইন করা হয়েছে।

নতুন কারিকুলামে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ; পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল সাক্ষরতার অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে ডিজিটাল শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া। তাছাড়া নতুন পাঠ্যক্রমে বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করবে।

অধিকন্তু, নতুন পাঠ্যক্রমে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নতুন করে আলোকপাত করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত সমস্যা এবং টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর একটি বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন পাঠ্যক্রমটি এমনভাবে গঠন করা হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে অনেক প্রকল্প এবং গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট রয়েছে, যা সহযোগিতা এবং দলগত কাজকে উৎসাহিত করে। উপরন্তু নতুন পাঠ্যক্রমের লক্ষ্য পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা হ্রাস করে আরও ইন্টারেক্টিভ এবং আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে শেখার অভিজ্ঞতা প্রদান করে শিক্ষার্থীদের আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়া। তাছাড়া প্রতিটি শ্রেণির প্রতিটি বিষয়ের কন্টেন্ট, ইউনিট ও লেসনগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, যা শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক ক্রমবিকাশে সহযোগিতা করবে। সঙ্গে সঙ্গে শিখন পদ্ধতির অভিনবত্ব, শিখনফল ও জীবনকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে পারবে।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের নতুন পাঠ্যক্রম শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং শিক্ষার্থীদের আরও প্রাসঙ্গিক এবং ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদানের একটি উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা। যার সফলতা নির্ভর করবে এর সফল বাস্তবায়ন, শিক্ষক, অভিভাবক এবং নীতিনির্ধারকসহ সব স্টেকহোল্ডারদের সমর্থনের ওপর।

উপরোক্ত ধারণার আলোকে মনে হবে, এবার এনসিটিবি এক অনন্য পাঠ্যক্রমের জন্ম দিয়েছে এবং ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই। ব্যাপারটা সত্যি হলেও মিথ্যা প্রচারণা, ভুল ধারণা ও কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টার কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

একটি দেশের পাঠ্যক্রম যতই ভালো হোক, তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন, সফলতা ও বিফলতা নির্ধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি রয়েছে, তা হলো ‘মূল্যায়ন’। ব্যাপক অর্থে এর একাডেমিক টার্ম হলো Testing & Evaluation (পরীক্ষা ও মূল্যায়ন)। সহজ ভাষায়, যেখানে পরীক্ষা সেখানেই মূল্যায়ন। পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির এলাইনমেন্ট, সিন্ক্রোনাইজেশন ও ইউনিটি যথাযথ না হলে, কিংবা ওই পদ্ধতির প্রয়োগ ত্রুটিপূর্ণ হলে যে প্রতিক্রিয়াটি ঘটে তাকে ইংরেজিতে ‘backwash’ বলা হয়। আর বর্তমানে তাই ঘটছে। ‘ওয়াশব্যাক বা ব্যাকওয়াশ’ হলো শিক্ষায় ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি ধারণা, যা সেই মূল্যায়নের পূর্ববর্তী প্রস্তুতির জন্য শিক্ষা ও শিক্ষার ওপর মূল্যায়নের প্রভাব, উপকারী বা ক্ষতিকর কিনা তা বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। এ ‘backwash’ আবার দুই ধরনের। পজিটিভ এবং নেগেটিভ। আপাতত এ নেগেটিভ ব্যাকওয়াশ কঠিনভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও মুদ্রিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রতিটি বই বিভিন্নভাবে ত্রুটিপূর্ণ, যা পরে আলোচনায় নিয়ে আসব, তথাপি মূল্যায়ন দিয়েই শুরু করি। এখানে মূল্যায়ন কাজ বাস্তবায়নের জন্য তিনটি স্তরের কথা বলা হয়েছে। শিখনকালীন মূল্যায়ন, সামষ্টিক মূল্যায়ন ও রিপোর্টকার্ড তৈরি।

প্রথমে শিখনকালীন মূল্যায়ন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন (Continuous Assessment)-এর ওপর আলোকপাত করা যাক। শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ভূমিকা, শিক্ষকের ভূমিকা, মূল্যায়নে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার স্তর নির্ধারণ, শিক্ষার্থীর শিখন দক্ষতা উন্নয়ন, শিক্ষক কর্তৃক মূল্যায়ন ছক পূরণ ও শিখনকালীন মূল্যায়ন বাস্তবায়নে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবে, এসব বিষয়ে মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এসব মাস্টার ট্রেইনাররা নিজ নিজ দায়িত্বরত এলাকায় গিয়ে সাধারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় পাঠ্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করবেন বলে এক ধরনের অতি-উচ্চবিলাসী ও অবাস্তব ধারণা পোষণ করে নীতিনির্ধারণী মহল তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। আর এদিকে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের চরম হতাশা, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। চলুন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ব্যাপারটা একটু দেখে আসি। প্রথমত ‘ওয়ান টু টুয়েন্টি’ হলো এ পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের আদর্শিক ক্লাস-সাইজ। বাংলাদেশে এ আদর্শ ক্লাস-সাইজ এক স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। ধরে নিই একজন শিক্ষককে প্রতিদিন পাঁচটি ক্লাস নিতে হয়। পাঁচটি ক্লাস মানে পাঁচটি বিষয়। আর প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা গড়ে ৪০ জন। তাহলে একজন শিক্ষক ৫টি বিষয়ে ৫x৪০=২০০ জন শিক্ষার্থীর শিখনকালীন মূল্যায়নের রেকর্ড রাখবেন প্রতিদিন। ধরে নিই একজন শিক্ষকের বাৎসরিক কার্যদিবস ২৮০ দিন। তাহলে প্রতি বছর একজন শিক্ষককে ২৮০x২০০= ৫৬,০০০ বার রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে। আবার ধরুন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (প্রাইভেট) ৪০ জন শিক্ষক রয়েছেন। তাহলে কী দাঁড়াল? একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিবছর ৫৬,০০০x৪০= ২২,৪০,০০০ রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, এ হিমালয়সম এডমিন কার্যক্রম কি একজন শিক্ষকের দ্বারা সম্ভব?

তাছাড়া, ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপস্-এ হাজার হাজার তথ্য ইনপুট কাজে ব্যস্ত শিক্ষকদের পড়ানোর সময় কোথায়?

আরেকটি নতুন বিষয় অনুধাবন করলাম যে, কোর-প্রশিক্ষক থেকে মাস্টার ট্রেইনার, মাস্টার ট্রেইনার থেকে সাধারণ শিক্ষকদের কাছে শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়নসংক্রান্ত তথ্যাদি পৌঁছতে পৌঁছতেই অধিকাংশ তথ্য ও লার্নিং-আউটপুটের সলীল সমাধি হয়ে যায় মাঝপথে। অবশিষ্ট যা থাকে, তার সঙ্গে প্রকৃত তথ্য-উপাত্তের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

দ্বিতীয়ত নতুন পাঠ্যবইগুলোয় প্রায় প্রতিটি সেশনে বিভিন্ন রকমের প্রজেক্ট ওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট ও ব্যবহারিক/প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক কাজ দেওয়া হয়েছে, যা শিক্ষার্থী অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে শিখনকালীন সম্পন্ন করবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সমস্যা অন্যরকম এবং গুরুতর। আগের ফর্মুলা অনুযায়ী একজন শিক্ষকের একটি ক্লাসের উপরোক্ত জীবনভিত্তিক কাজগুলো ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে আদায় করে নিতে হলে তার প্রতিটি ক্লাসের জন্য রিসোর্স ও ম্যাটেরিয়ালস ক্রয় করতে ন্যূনতম খরচ যদি ধরা হয় ২০ টাকা (বাস্তবে অনেক বেশি), তাহলে ৫টি ক্লাসের জন্য তার প্রতিদিন খরচ হবে ১০০ টাকা। আর বাৎসরিক খরচ ২৮০x১০০= ২৮,০০০ টাকা। তাহলে ৪০ জন শিক্ষকের বাৎসরিক খরচ ১১, ২০,০০০ টাকা। এ ব্যয়ভার কে বহন করবে? শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় নাকি ইউনেস্কো? একমাত্র ধনী প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের এসব অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সুষ্ঠু সমাধান ও নির্দেশনা না থাকলে মূল্যায়ন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে আর এ উচ্চবিলাসী পাঠ্যক্রমের নিঃসন্দেহে মৃত্যু ঘটবে। আবার নিরপেক্ষ বিবেচনায় এ যুক্তিগুলো টিকবে না। কারণ প্রশিক্ষণে বারবার বলা হয়েছে যে, শিক্ষকরা নিজেরা সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্ত শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করবে এবং ছাত্রছাত্রীদের/অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলবেন। যাতে করে শিক্ষা উপকরণের ব্যয়ভার বহন করা অভিভাবকদের জন্য সম্ভব হয়। উদাহরণ স্বরূপ এসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের জন্য শিক্ষার্থীরা পুরোনো ক্যালেন্ডার, অব্যবহৃত খাতা, ইত্যাদির অপর খালি পৃষ্ঠা ব্যবহার করতে পারে। শিক্ষকরা একটি রিসোর্স ব্যাংক তৈরি করতে পারেন এবং সেখানে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে জমা রাখতে পারেন, যা হতে পারে প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পদ এবং প্রতিবছর এসব উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীদের এসব উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণে উৎসাহিত করার কথা বারবার প্রশিক্ষণে বলা হয়ে থাকে।

তৃতীয়ত নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের শুরুতে দেশব্যাপী একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করা হয়। এ পাইলট প্রজেক্টের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিকভাবে পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নকল্পে কী কী প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা রয়েছে, তা চিহ্নিত করা এবং প্রেকটিসিং শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা। সেই পাইলট প্রজেক্টগুলোর স্থান ও স্কুল নির্বাচন, প্রজেক্টের স্কুল/কলেজের ফিডব্যাক ও রিপোর্ট, প্রজেক্ট ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং সম্পর্কে যথেষ্ট অব্যবস্থাপনা এবং যথার্থ ও সঠিক তথ্যাদির উপস্থাপন নিয়ে বিভিন্ন মত ও প্রশ্ন রয়েছে। পাইলট প্রজেক্টের রিপোর্ট পত্রিকা ও অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরে যাচাই-বাছাই করলে একটি নির্ভুল, সহনীয় ও বাস্তবায়নযোগ্য মূল্যায়ন পদ্ধতির জন্ম হতো বলে বিজ্ঞজনেরা ধারণা করছেন।

অন্যদিকে, শুরুতে দেশব্যাপী

বিভিন্ন জেলাভিত্তিক আনুমানিক ৬০০০-এর বেশি কোর প্রশিক্ষক তৈরি করা হয়। কোর প্রশিক্ষকরা আনুমানিক ১৭ হাজারেরও অধিক মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করেন, যারা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণের কাজ করছেন। কোর প্রশিক্ষক ও মাস্টার ট্রেইনার, যাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণকাজ ও ম্যাটেরিয়ালস ডেভেলপমেন্টের কাজে দীর্ঘ ৩০ বছর থেকে জড়িত আছি, সেই সুবাদে তাদের প্রশিক্ষণকাজ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ভীষণ ধাক্কা খেলাম। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ইংরেজি বিষয়ের ক্ষেত্রে ELTIP PROJECT এর মাস্টার ট্রেইনার,

ট্রেইনার, রিসোর্স সেন্টারের প্রশিক্ষকরা, টেক্সটবুক রাইটার্স ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ, যারা এ বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, তাদের কাজে লাগানো। কর্মসূত্রে ELTIP PROJECT এর ELT Team-এর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। প্রফেসর এমএস হক, ও প্রফেসর রেহানা শামছ, গৌতম রায়, এদের মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ELT স্পেশালিস্টদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছি। এদের মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের নতুন পাঠ্যক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ের রাইটার্স ও এডিটর প্যানেলে দেখতে পেলাম না। এটা আমাকে বিস্মিত করেছে। বিভিন্ন বিষয়ের নতুন এডিটর ও রাইটার্স প্যানেলে যেসব নাম দেখলাম তাদের বেশির ভাগই টেক্সটবুক রাইটিং কিংবা কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্টের ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। এদের অধিকাংশই পেশাগত ও বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মসূত্রে পরিচিত। উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেই বলছি, দু-একজন ছাড়া ইংরেজি ভাষার পাঠ্যক্রম ও টেক্সটবুক রাইটিং-এর ওপর বেশির ভাগেরই দেশি, বিদেশি কোনো স্বীকৃত প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা নেই। বিদেশি প্রশিক্ষণের কথা এ কারণেই বললাম, বাংলাদেশে ওই বিষয়গুলোর ওপর প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একমাত্র প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, প্রফেসর হামিদুর রহমান, ও প্রফেসর ড. জাফর ইকবাল ছাড়া অন্যান্য রাইটার্স ও এডিটরবৃন্দ কীভাবে ও কোন যোগ্যতায় এসব প্যানেলে জায়গা পেলেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই এডিটর ও রাইটার্স হয়ে যাবেন, এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিসে কর্মরত বন্ধুবান্ধবের প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই এসব প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। যার কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার এমন বেহালদশা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিগুলোতে শেখানোর অভিজ্ঞতাবিহীন ও এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা, তার অবকাঠামোগত অসুবিধা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা যাদের নেই, তাদের হাত দিয়ে যখন এসব লাখো শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রম তৈরি হবে, সেখানে সব প্রচেষ্টা যে অংকুরেই বিনষ্ট হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

অনুধাবন করলাম যে, কোর-প্রশিক্ষক থেকে মাস্টার ট্রেইনার, মাস্টার ট্রেইনার থেকে সাধারণ শিক্ষকদের কাছে শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়নসংক্রান্ত তথ্যাদি পৌঁছতে পৌঁছতেই মধ্যখানেই অধিকাংশ তথ্য ও লার্নিং-আউটপুটের সলীল সমাধি হয়ে গিয়েছে। অবশিষ্ট যা আছে, তার সঙ্গে প্রকৃত তথ্য-উপাত্তের কোনো মিল নেই। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সঙ্গে যারা জড়িত, আমরা সবাই জানি যে, এ রকম ঘটনা সব সময়ই ঘটে। কোর প্রশিক্ষক থেকে গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত আসতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অর্জিত জ্ঞান ও তথ্য লুপ্ত হতে হতে এক সময় তারা সব ভুলে গিয়ে মনগড়া যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকে, যা কোর-প্রশিক্ষক কর্তৃক কখনো শেখানো হয়নি কিংবা বলা হয়নি। তাই এবারের তথ্যবিভ্রান্তিগুলো ভয়াবহ। কারণ বর্তমান কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ‘Zero Error’ অত্যাবশ্যক। কারণ সামেটিভ ও ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টের এ যুগলবন্দি পদ্ধতিতে যেহেতু সুনির্দিষ্ট ছকের মাধ্যমে শিখনকালীন মূল্যায়ন সংরক্ষণ ও সুনির্দিষ্ট অ্যাপসের মাধ্যমে ফলাফল গ্রহণ ও প্রকাশ পাবে, সেহেতু ভুলের কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে যেসব বিষয়গুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি, তা হলো উপযুক্ত মাস্টার ট্রেইনার নির্বাচন এবং রিসোর্সফুল ও প্রশিক্ষণকাজে অভিজ্ঞ স্কুল-কলেজগুলোকে পাইলট প্রজেক্টের আওতায় আনা। তাছাড়া প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষকদের সব রকমের তথ্য সমৃদ্ধ ফাইল ও তার সফ্ট কপি দিয়ে দেওয়া হলে এসব তথ্যবিভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব ছিল। তাছাড়া অভিভাবকদের নতুন পাঠ্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার জন্য একটি হ্যান্ডবুক তৈরি করে দিলে এবং প্রচারিত ভুল তথ্যগুলোর বিপরীতে বিদ্যমান শক্তিশালী যুক্তিগুলো লিখিতভাবে তুলে ধরলে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদ্ভূত নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা সহজতর হতে পারত।

সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নতুন পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর সপ্তাহের একটি সুনির্দিষ্ট দিন নিয়মিত আলোচনা, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা ক্রমাগত দুই বছর চালিয়ে যেতে পারলে উদ্ভূত ভুল ধারণাগুলো নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ হিসাবে কাজ করত।

জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো তে FAQ(Frequently Asked Questions) শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক স্পেস সরকারিভাবে কিনে নিয়ে সেখানে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেত। এখন নতুন প্রশ্ন হলো, প্রথম শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত যে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে একটি শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবনের এতগুলো বছর পার করে এলো, সে পরবর্তী শিক্ষাজীবনের ভর্তি কিংবা প্রবেশের ক্ষেত্রে অর্থাৎ তারা প্রাইভেট/পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, ও বিসিএস পরীক্ষায় কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেবে? বাস্তব জীবনের প্রবেশদ্বারে তাদের জন্য কোন ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি অপেক্ষা করছে? এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। পাঠকরা নিশ্চয়ই ‘মূল্যায়ন’ শব্দটি শুনতে শুনতে বিরক্ত হচ্ছেন! আমি তো খেপেই আছি! কারণ মাস্টার ট্রেইনার ও শিক্ষকদের মাথায় ‘constant hammering’ হচ্ছে যে, তাদের বলতে হবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র দেশ! কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই জানেন যে, পরীক্ষা, টেস্ট, এক্সামিনেশন কিংবা মূল্যায়ন (বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে) হলো পরস্পরের সমার্থক শব্দ। যা সাত তা-ই সেভেন। অর্থাৎ বিভিন্ন রেসিপিতে একই ফলের শরবত। ‘পরীক্ষা’ শব্দটি বাদ দিলেই কি পরীক্ষাভীতি চলে যাবে? ড্রেস ও নাম বদল করলেই বিডিআর এবং বর্ডারগার্ড-এর মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য তৈরি হয়ে যাবে? ভেতরের মানুষগুলো তো একই থাকবে। জানি, ‘psychological impact’-এর কথা আসবে। যাই আসুক, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দিন শেষ।’ বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্য ও জ্ঞানপ্রবাহ খোলা আকাশের মতো। সহজলভ্য। এখানে যাহা test/assessment, তাহা-ই ex examination। যাহা পরীক্ষা, তাহা-ই মূল্যায়ন।

সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৪০ নম্বরের ফরমেট এখনো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে পরিষ্কার নয়। পারদর্শিতার নির্দেশক যোগ্যতাভিত্তিক এবং সেসব যোগ্যতারও নির্দিষ্ট criteria রয়েছে। আবার প্রতিটি যোগ্যতাকে একাধিক পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা ‘পারদর্শিতার নির্দেশক’ বা Performance Indicator নামে অভিহিত। পারদর্শিতার নির্দেশকগুলো শিখন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিকাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের আচরণে (অংশগ্রহণ ও উপস্থাপন) পরিলক্ষিত হবে। নির্দিষ্ট এক বা একাধিক শিখন অভিজ্ঞতার জন্য নির্ধারিত ‘পারদর্শিতার নির্দেশক’ অনুযায়ী শিক্ষার্থীর শিখন দক্ষতাকে তিনটি পর্যায়ে শিক্ষক মূল্যায়ন করবেন। স্তরগুলো হলো: প্রারম্ভিক, অন্তবর্তীকালীন এবং পারদর্শী।

প্রিয় পাঠক, উপরের অনুচ্ছেদটি শুধু পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা শিক্ষকদের কাছে কতটুকু দুরূহ ব্যাপার, তা আপনারা পড়লেই বুঝতে পারবেন। বাস্তবায়ন তো পরের কথা। সত্যি বলতে কি, একটি চমৎকার পাঠ্যক্রমের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এ জটিল মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে ভেস্তে যাবে। মূল্যায়ন পদ্ধতিকে সহজ, সহনীয়, বোধগম্য ও সহজে বাস্তবায়নযোগ্য করে দিলে এতসব বিভ্রান্তির জন্ম হতো না। পাঠ্যপুস্তকের ভুলভ্রান্তি পুনঃমুদ্রণের সময় সহজেই সমাধান করা যেত।

অভিভাবকরা মনে করেন যে, এ পাঠ্যক্রম প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে ক্রমাগত ও ধারাবাহিক ভাবে পরবর্তী শ্রেণিগুলোয় অব্যাহত রাখলে একটি সহনশীল পরিবেশ, গ্রহণযোগ্যতা ও মানসিকতা তৈরি হতো এবং দীর্ঘ মেয়াদি চর্চা ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির জন্য একযুগ পর একটি জাতীয় গ্রহণযোগ্য পাঠ্যক্রম হিসাবে স্বীকৃতি পেতে পারত।

বহুল আলোচিত ও ব্যয়সাপেক্ষ এ পাঠ্যক্রমের পাঠ্যপুস্তকগুলো কীভাবে পড়ানো হবে এবং শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণের জন্য দায়িত্বশীল প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের জন্য কোনো ‘অবজারভেশন চেকলিস্ট’ তৈরি করা হয়নি, যার মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষরা শিক্ষা ও শিখনকালীন কার্যক্রম মনিটরিং করবেন। যার ফলে কে, কী, কখন, কীভাবে নিজনিজ দায়িত্ব পালন করবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় পুরো পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

তবে আশার আলো এই যে, খুবই গোছানো টিচার্স গাইড তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকরাও ঠিকঠাক মতো টিচার্স গাইড অধ্যয়ন ও অনুসরণ করলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের কাজটি করতে পারবেন।

বাংলাদেশের নতুন পাঠ্যক্রম শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং শিক্ষার্থীদের আরও প্রাসঙ্গিক এবং ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদানের একটি উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা। যার সফলতা নির্ভর করবে এর বাস্তবায়ন ও শিক্ষক, অভিভাবক এবং নীতিনির্ধারকসহ সব স্টেকহোল্ডারদের সমর্থনের ওপর।

এবারের পাঠ্যক্রম আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী কিছু ম্যাথোডোলজিক্যাল বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে কার্যকর। যেমন: পিয়ার টিচিং, পিয়ার কলাবরেশন, পিয়ার অবজারভেশন ও কমিউনিটি কোহেসন ইত্যাদি। কিন্তু এসব আধুনিক অ্যাপ্রোচ ও কৌশল, যার নামের সঙ্গেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পরিচয় নেই, তাদের বাস্তবায়ন বেগম রোকেয়ার ‘Sultana’s Dream’-এর কাহিনির মতোই মনে হচ্ছে। তাই দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দিলে ও শিক্ষকদের গবেষণা কর্মে নিয়োজিত করলে এসব অত্যাধুনিক ধ্যান, ধারণা ও শিক্ষাকৌশল বাস্তবায়ন সম্ভব। বর্তমান প্রয়োগকৃত অত্যাধুনিক পাঠ্যপুস্তক ও আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষার গুণগতমান পর্যালোচনা করলে মনে হয় যে, নতুন প্রযুক্তির মার্সিডিজবেঞ্জের গাড়ি, আমাদের সিএনজি চালকদের হাতে তুলে দিয়ে বলা হচ্ছে চালানোর জন্য। যাদের গাড়ির টেকনোলজি, ইনস্ট্রুমেন্টস, ও ম্যানুয়্যাল সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই অথচ চালাতে হবে। সুতরাং দুর্ঘটনা যে অনিবার্য, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। উন্নত বিশ্বের কারিকুলাম বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে সর্বোচ্চ মেধাবী ও সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে। যাদের বেতন হবে ন্যূনতম ১ লাখ টাকা, যারা শিক্ষা নিয়ে সাধনা ও গবেষণা করবে দিনরাত। যাদের হবে একপেশা, এক ধ্যান। একমাত্র শ্রেণিকক্ষে সেরা পাঠদানই হবে যাদের একমাত্র লক্ষ্য। যারা শুধু শিখন (learning)-এর ওপর গুরুত্ব দেবে না, বরং তার অর্জিত জ্ঞান (acquisition) নিশ্চিত করবে। আর তাহলেই ‘project and skill based learning’ এবং ‘research and CPD-based teaching’ এর যুগলবন্দি পদ্ধতিতে একটি কার্যকর ও শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি ও বাস্তবায়ন হবে।

এখন আবার শোনা যাচ্ছে যে, এ শিখনকালীন মূল্যায়নকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। চলমান/ঘটনকালীন এবং সামষ্টিক। এর অবশ্য যথার্থ কারণ রয়েছে। সামষ্টিক মূল্যায়নের বিষয়টি সুস্পষ্ট না হওয়ায় একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। আর সুযোগটি লুফে নিয়েছে উৎপাদন যন্ত্র। পুঁজিবাদীরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এখন থাবা বসিয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে প্রকাশকরা মাঠে নেমে গেছেন। বাজারে নতুন গাইড এসে গেছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। সামষ্টিক ও ধারাবাহিক মূল্যায়নের নিজস্ব উদ্ভাবিত পদ্ধতি তারা শিক্ষার্থীদের ওপর ইতোমধ্যে চাপিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি গাইডের শেষে ‘sample question’ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকরাও এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, তারা স্বপ্রণোধিত হয়ে নিজ কাঁধে দায়িত্বটি সযত্নে নিয়ে নিয়েছেন। নতুন ও অভিনব শিক্ষাপাঠ্যক্রম এখন পুঁজিবাদের দখলে। কোটি কোটি টাকা ইনভেস্টমেন্ট। মূলধন ও হাজারগুণ লাভ বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আমাদের নিষ্ক্রিয়তা ও অক্ষমতার সক্ষম বিকল্প পেয়ে গেছেন। ফেরার সব পথ বন্ধ। এখন তাদের আরোপিত মূল্যায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করা ছাড়া কর্তৃপক্ষের সামনে আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা আছে বলে মনে হচ্ছে না। উল্লেখ্য, মূল্যায়নসংক্রান্ত তাবৎ নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে, বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার নির্দেশক, শিখনদক্ষতার যোগ্যতাভিত্তিক তিনটি স্তরের কোনোটিই গাইডগুলোতে দেওয়া হয়নি। পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে সনাতন পদ্ধতির নম্বর বণ্টন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ প্রশিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ধারণা নেই যে, পাবলিক পরীক্ষায় অর্জিত এ নতুন সনদ উচ্চতর শিক্ষায় অথবা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কীভাবে মূল্যায়ন হবে। পৃথিবীর সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ঈচেঅ গ্রহণ করে। কিন্তু নতুন ফলাফলের তিনটি স্তরের একাডেমিক গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে এখনো পরিষ্কার কোনো ধারণা দেওয়া যাচ্ছে না।

আশঙ্কার বিষয় হলো এই যে, এখন পর্যন্ত হাজার হাজার প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বরাবরের মতো কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই এদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে এখনো কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। তাছাড়া, দুর্বল শিক্ষার্থী, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী, অর্টিস্টিক শিক্ষার্থী ও করোনাকালে হারিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এ মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণে, শিক্ষার্থীদের স্কুলে অনুপস্থিত থাকার কোনো সুযোগ নেই। অনুপস্থিত শিক্ষার্থী প্রতিদিনের ধারাবাহিক মূল্যায়নের কোনো নম্বর পাবে না। তাই স্বাস্থ্যগত কারণে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধানরা দ্বিধায় ভুগছেন।

এখন দেখা যাক, প্রকাশিত, বিতরণকৃত ও পরীক্ষামূলক পুস্তকগুলোয় কী কী রয়েছে।

বিগত বছরের ২৩ মার্চ, দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত হলো বিতরণকৃত পাঠ্যপুস্তকগুলোর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। প্রকাশিত রিপোর্টের বেশির ভাগই সঠিক। বানান, ভুল ট্যাগ কোয়েশ্চন, বিরামচিহ্ন, সিংগুলার-প্লুরাল সমস্যা, দীর্ঘ-অপ্রাসঙ্গিক-কথ্যভাষার ডায়ালগ, ভাষার চারটি সর্বজনীন দক্ষতা, চলমান CLT-এর সঙ্গে ঞেগ এর সাংঘর্ষিক অবস্থান, পাঠ্যবইয়ের thematic unity দুর্বল ভাষা ব্যবহার, দুর্বল নির্দেশনা ও প্রতিটি সেশনে অত্যধিক নতুন ভোকাবুলারি ইত্যাদি হাজারো ভুলে জর্জরিত, রোগাক্রান্ত ও অসুস্থ পাঠ্যপুস্তক পড়াতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকরা।

সংশোধিত নবম ও দশম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের দুটো ভুল তুলে ধরতে চাই। ওই বইয়ের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠার লেসন ফোর-এর সেকশন বি ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে কিউবার প্রধানমন্ত্রী বলা হয়েছে। আবার একই লেসনের ১৫ পৃষ্ঠার শেষের অনুচ্ছেদটিতে ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে কিউবার প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করা হয়েছে। এখন ধরুন ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করা হলো, ফিডেল ক্যাস্ত্রো কিউবার প্রেসিডেন্ট না প্রধানমন্ত্রী? উত্তর কী হবে? আবার একই বইয়ের ১৪৩ পৃষ্ঠার ৩ নং প্রশ্ন এই রকম : What do you mean by the potential danger of nuclear energy? প্রথমত, এখানে সবধহ নু এর পরের অংশ ইনভার্টেড কমা’র ভেতরে থাকার কথা অথবা প্রশ্নটিকে paraphrasing করলে হতো। দ্বিতীয়ত এ প্রশ্নের উত্তর এই লেশনে নেই। কারণ সংশোধনের সময় ওই বিষয়ের কন্টেন্ট সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ভুলবশত প্রশ্নটি রয়ে গেছে। এ রকম আরও ইস্যু রয়েছে, সেদিকে যাচ্ছি না।

বাংলাদেশে এনসিটিবি দ্বারা নির্ধারিত একটি নতুন পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য একটি নতুন মূল্যায়ন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য একটি ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে যাতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ জড়িত-

নতুন কারিকুলাম এবং টেস্টিং সিস্টেম বোঝা : প্রথম ধাপ হলো নতুন কারিকুলাম এবং টেস্টিং সিস্টেম সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা থাকা। এতে পাঠ্যক্রমের নথিপত্র এবং পরীক্ষার নির্দেশিকা পড়া, প্রশিক্ষণ সেশনে যোগ দেওয়া এবং এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ কোর প্রশিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও পরামর্শ নেওয়া। সবচেয়ে ভালো হবে, যদি পুরো পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর একটি হ্যান্ডবুক তৈরি করে প্রত্যেক শিক্ষকদের কাছে হস্তান্তর করা। অভিভাবকরা চাইলে ফটোকপি করে নিতে পারেন।

মূল্যায়নের সরঞ্জামগুলো বিকাশ করা : একবার আপনি নতুন পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়ে গেলে, পরবর্তী পদক্ষেপটি হলো উপযুক্ত মূল্যায়ন সরঞ্জামগুলো বিকাশ করা। এর জন্য নতুন পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরি করতে হবে যা নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পাইলট টেস্টিং : মূল্যায়নের সরঞ্জামগুলো তৈরি করার পর, উন্নতির প্রয়োজন এমন কোনো ক্ষেত্র শনাক্ত করার জন্য তাদের পরীক্ষামূলক পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের একটি ছোট নমুনা দিয়ে পাইলট পরীক্ষা করা যেতে পারে এবং শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া মূল্যায়নের পর সরঞ্জামগুলোকে পরিমার্জিত করে ব্যবহার করা যেতে পারে।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া : নতুন মূল্যায়ন সরঞ্জামসহ নতুন পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কর্মশালা, প্রশিক্ষণ সেশন এবং শিক্ষা কর্তৃপক্ষের অব্যাহত সহায়তার মাধ্যমে করা যেতে পারে। এ প্রশিক্ষণ, সহযোগিতা ও সহায়তা কয়েক বছর ধরে অব্যাহত রাখতে হবে।

বাস্তবায়ন : একবার মূল্যায়নের সরঞ্জামগুলো তৈরি করা হয়ে গেলে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা হলে, নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি স্কুলগুলোতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সিস্টেমটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য সতর্ক পরিকল্পনা এবং সমন্বয় প্রয়োজন। মনিটরিং এবং মূল্যায়ন : বাস্তবায়নের পর, উন্নতির প্রয়োজন এমন ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করার জন্য নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির নিরীক্ষণ এবং মূল্যায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের থেকে চলমান প্রতিক্রিয়া এবং মূল্যায়ন ফলাফলের নিয়মিত পর্যালোচনার মাধ্যমে করা যেতে পারে।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশে এনসিটিবি দ্বারা নির্ধারিত একটি নতুন পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য একটি নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সতর্ক পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং চলমান সহায়তা প্রয়োজন। ‘নতুন ব্যবস্থা কার্যকর এবং টেকসই’- তা নিশ্চিত করার জন্য প্রক্রিয়াটিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকসহ সব স্টেকহোল্ডারদের একত্রিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : ইংরেজি ভাষা গবেষক, কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ, কোর-প্রশিক্ষক ও কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম