Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

নবান্ন উৎসব ও ইউনেস্কো স্বীকৃতি ভাবনা

Icon

জাহাঙ্গীর সেলিম

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নবান্ন উৎসব ও ইউনেস্কো স্বীকৃতি ভাবনা

বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো নবান্ন উৎসব। উৎসব প্রাচীন কিন্তু স্থিতিস্থাপক সাংস্কৃতিক রূপ। স্থিতিস্থাপকতার গুণে কোনো কোনো উৎসব যেমন আদি রূপ হিসাবে বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা ধর্ম সম্প্রদায় আদিম ইচ্ছাপূরণের বা কল্যাণ কামনার প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা করণ-ক্রিয়ার (Ritual) অংশও হতে পারে। বাংলাদেশে নবান্ন উৎসবের রূপান্তরে তেমনটাই লক্ষ করা যায়।

বহু বৈচিত্র্য সত্ত্বেও উৎসবের কতকগুলো স্বকীয়তা রয়েছে। যেমন- কোনো কোনো উৎসব বর্ষপঞ্জি, ঋতু বা চন্দ্রসূর্যের আবর্তনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উৎসব প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বা কমিউনিটির যেমন হতে পারে, তেমনি তা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বহু মানুষের বা সর্বজনীনও হতে পারে। উৎসবের নবায়ন ও নব বিন্যাসের কারণ হলো আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, জাতিগত বা সাংস্কৃতিক নিপীড়নজাত প্রক্রিয়া।

ড. এনামুল হকের লেখায় পাওয়া যায়, ‘বাংলাদেশের উৎসব প্রধানত আর্তব উৎসব বা কৃষি উৎসব। আর্তব আদিমকালের উৎসব। আদিম অবস্থায় মানুষ যখন যাযাবর জীবনযাপন করত, তখন তারা স্বাভাবিক নিয়মেই ঋতু পরিবর্তনের সময় কালোপযোগী উৎসব পালন করত। মানুষ যখন কৃষি আবিষ্কার করে এক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল, তখন সে হলো গৃহী। উপযুক্ত ঋতু দেখেই গৃহীকে শস্য ঘরে তুলতে হয়। তবে ঋতু ধর্মী উৎসব বা আর্তব উৎসবের নজির হিসাবে নববর্ষের কথা বলা যায়।’ মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিতায় অগ্রহায়ণ বর্ণিত হয়েছে এ ভাবে, ‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জন্ম তার, নাই যার চাষ।’

কবির অগ্রহায়ণ বন্দনার কারণ, যতদূর জানা যায়, অগ্রহায়ণ মাসে নববর্ষ ছিল। ফলে এককালে নতুন ধানের মাস অগ্রহায়ণে বাংলা নতুন বছর শুরু হতো। কৃষির আবিষ্কার মেয়েদের হাত ধরে। তাই বাংলার কৃষিভিত্তিক উৎসবে মেয়েদের প্রাধান্য দেখা যায়। বাংলা নববর্ষের ‘আমানি’ এবং নতুন ফসলের উৎসব নবান্নে মেয়েদের কর্তৃত্ব লক্ষণীয়। কেননা কৃষি আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে নারীদেরই প্রাধান্য ছিল। নবান্ন ধর্মীয় উৎসব না। এর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ, তিথি নখত্রের বা চাঁদের বা অমাবস্যা পূর্ণিমার ব্যাপার নেই। ফসল সম্পর্কিত এ হৈমন্তিক উৎসবটি অগ্রহায়ণ মাসের যে কোনো দিন উদযাপন করা যায়। এ অনুষ্ঠানে আনন্দই প্রধান। অনেকে বলেন-নবান্ন রন্ধনের উৎসব, কেননা নবান্নকে ফসল উৎপাদনের সংস্কৃতি থেকে রন্ধনকলায় বিকশিত করার একটা প্রক্রিয়া হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়।

নবান্ন বাঙালি কৃষকের খাদ্যোৎসব। হতদরিদ্র কৃষকের জীবনে সমবেত উৎসবের আনন্দে মেতে উঠার দিন। ভালো ফসল উৎপাদিত হলে অগ্রাহয়ণের এ উৎসব পৌষেও বিস্তারিত হয়। পৌষ পার্বণ বাঙালিকে পিঠাপুলি খাওয়ার সুযোগ করে দেয়। পৌষ পার্বণে মেলা ও পিঠা-উৎসব যেন নবান্নের বর্ধিত রূপ। নব আঙ্গিকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ পৌষমেলা আয়োজন করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌষে পিঠা উৎসব মহাউল্লাসে ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয়।

প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের কোনো একদিনে ঢাকায় সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। আয়োজনের স্থান হিসাবে চারুকলা ইনস্টিটিউটকে বেছে নেওয়া হয়। এছাড়া ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, লালমাটিয়া কলেজ ও অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন স্থানে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। ঢাকায় নাচগান, আবৃত্তির পাশাপাশি ঘরে বানানো নানা ধরনের পিঠাপুলির পশরা সাজিয়ে আয়োজন দিনব্যাপী চলে। লোক সমাগমের কমতি থাকে না। তবে এসব আয়োজনে শহুরে কালচার প্রাধান্য পায়। অবশ্য বিশ্বায়নের প্রভাবে সবখানেই আধুনিকতার রমরমা উপস্থিতি। ফলে নানাধরনের পিঠাপুলির আয়োজন হলেও সেই অকৃত্রিম পরশ/ছোঁয়া দেখা যায় না।

ঠিক একইভাবে পহেলা বৈশাখ আমাদের যাপিত গণজীবনে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রধান উৎসবের দিন, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার দিন এবং দেশে বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়। তবে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান ঘিরে পুরো এলাকায় যে জন সমুদ্র ও অন্যান্য আয়োজন এবং পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম মেকি শহুরে কালচারে পরিণত হয়েছে। বিগত কয়েক দশক থেকে এ কালচার গড়ে উঠেছে। কেনানা সমসাময়িককালেই দেশ কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তে ভোগবাদী অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে, ইলিশ-পান্তার সংযোজন সে সূত্রে গাথা। বিগত নব্বই দশকের শুরু থেকে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতীয় ও একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে প্রসংশিত এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা UNESCO-i Intangible Cultural Heritage হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

নবান্ন প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এ সর্বজনীন উৎসবটি এক সময় দেশব্যাপী বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হতো। সনাতনধর্মী অনুসারীদের মধ্যে উদ্দীপনা এখনো বিদ্যমান তবে পরিবারকেন্দ্রিক, নতুন ধানের ভাত, পিঠা, পায়েস খাওয়া এবং একই সঙ্গে খাদ্যদ্রব্য কাক পক্ষীদের উদেশ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নতুন ধানের আগমনে গেরস্ত পরিবারে ঘরে ঘরে চিতই পিঠা, আইখা, পায়েস ও অন্যান্য খাওয়া-দাওয়ার প্রচলন আজও বিদ্যমান, কেননা এ সময় আখের নতুন গুড় বাজারে আসে। উত্তর জনপদের চাঁপাইনবাবগঞ্জে চিতই পিঠা গেরস্ত বাড়িতে বছরব্যাপী খাওয়া হয়। তবে নতুন গুড়ের সঙ্গে নতুন ধানের পিঠার স্বাদ বরাবরই আলাদা।

এ চিতই পিঠা সকালের নাশতা হিসাবে খাওয়ার প্রচলন। সাইজে অনেক বড়, গরম গরম খেতে বেশ মুড়মুড়ে, আমিষ বা নিরামিষযোগে খাওয়া হয়। শহরের অলিতে গলিতে যে পিঠা পাওয়া যায় তার থেকে ৫-৭ গুণ বড় এবং কাগজের মতো পাতলা। তবে অনেক ধরনের পিঠা এখন আর দেখা যায় না। বিশ্বায়নের প্রভাব, ঘরে খাদ্যদ্রব্য তৈরি থেকে গৃহিণীদের মুক্তি দিয়েছে। পাড়ার দোকানে বা ভ্যানে ফেরি করে নানা পদের শুকনা খাবারের প্রতি আগ্রহ বেশি। তবে ঘটা করে নবান্ন পালন করা এখনো হারিয়ে যায়নি শুধু আঙ্গিক পালটেছে এবং গ্রাম বাংলায় নবান্ন চালু রয়েছে।

এবার একটি ব্যতিক্রমধর্মী নবান্ন উৎসব পালনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরসংলগ্ন শীর্ণকায়া পুনর্ভবা নদীর ধার ঘেঁষে বাবুরঘোন গ্রামে সূর্য ওঠার আগে কাকডাকা ভোরেই (১ ডিসেম্বর ২৩) দলে দলে লালপাড়-হলুদ শাড়ি পরে মেয়েরা স্কুল শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের বাড়ির পথে হেঁটে চলেছে।

আমাদের গন্তব্যস্থলও ওখানেই, অচেনা গ্রামে শিক্ষিকার বাড়ি চিনতে কষ্ট করতে বা কাউকে জিজ্ঞেস করতে হলো না। একটা দলের পেছনে চলতে চলতে কাক্সিক্ষত বাড়িটি পেয়ে গেলাম। বাড়ির সামনে ছেলে ও মেয়েদের জটলা এবং বিভিন্ন বয়সি লোকজনের আগমন। জটলা অতিক্রম করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া, উঠানে প্রায় ৬০-৭০ জন বিভিন্ন বয়সি মহিলা-স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরীদের সঙ্গে গ্রাম্য বধূ, খালা, ফুপু, চাচি, শাশুড়ি, দাদি, নানিদের সরব উপস্থিতি এবং প্রায় সবাই পিঠা বানানোর কাজে ব্যস্ত। সবার পরনে লালপেড়ে হলুদ শাড়ি। কিশোরী ও অল্পবয়সি বধূদের মাথা ও খোঁপায় হলুদ গাঁদা ফুলের মালা, চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি এবং আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরা। বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর পেয়ে গেলাম, প্রত্যেকেরই একটা করে এ রঙের শাড়ি রয়েছে এবং উৎসবের দিন পরে থাকে। তবে এখানেও মৌলবাদীদের সরব উপস্থিতি রয়েছে, অনেক কিছুতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সংকট উত্তরণের জন্য মেয়েরা সহাবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করে, কোনো তর্কে লিপ্ত হয় না, মানিয়ে চলতে হয়।

নানা বিষয় এখন উভয় পক্ষের কাছে এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে, কেননা দীর্ঘ বারো বছর ধরে দলবদ্ধ হয়ে নবান্ন পালন ছাড়াও অন্যান্য অনুষ্ঠান আয়োজন একইভাবে পালন করা হচ্ছে। তবে মানিয়ে চলার ব্যাপারে এক অভিনব উপায় হলো, অনেক বধূ/বয়স্কা মহিলা লালপাড় হলুদ শাড়ি পরে গ্রামের রাস্তা ধরে আসে, কিন্তু কিছু মেয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক বাধা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে ওইসব মেয়েরা আগের দিন কোনো এক সময় মমতাজ বেগমের বাড়িতে শাড়ি রেখে আসেন। লাল-হলুদ শাড়ি পরা মেয়েদের দল মাদুর, পিঁড়ি, মোড়ায় বসে প্রত্যেকেই নানা উপকরণ হাতে নিয়ে কাজে ব্যস্ত। উদ্দেশ্য পিঠা বানানো তবে এক ধরনের পিঠা নয়, ১০-১২ ধরনের পিঠা।

কেউ আটা গুলাচ্ছে, কেউ ছোট ছোট আটার বল তৈরি করছে, কেউ আটা গোল করে নতুন গুড়ের সঙ্গে তিলমিশ্রিত ঘন হালুয়া পুরে নান্দনিকতার সঙ্গে মুখ মুড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ গনগনে চুলায় ফুটন্ত পানির ভাপে পিঠা সিদ্ধ করতে ব্যস্ত। এ ধরনের পিঠা তৈরির পুরো প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ। এ কাজের আকর্ষণ আরও বেড়েছে, কেননা গোল হয়ে বসে মেয়েদের হাতের কাজে যেমন বিরাম নেই-তেমনি মুখেও বিরাম নেই, সমান তালে সমবেত কণ্ঠে একের পর এক গীত গেয়ে চলেছে।

ধান ভাঙার গীত

সোলাহ কাঠের ঢিকি মারে ভ্যান্না কাঠের পুয়ারে মারে বদলারে (২)

সেনা ঢেঁকিতে বাহানে মারে বাঁশফুল ধানের চাইলো রে মারে বদলারে (২)

সেনা চাইল যাইরে মারে রহনপুর বাজারে (২)

মারে চাইল এর সুন্দর মারে ভানি কতই সুন্দর রে (২)

ভানি দেখ্যা আসিব রে ॥

উল্লেখ্য, উত্তর বঙ্গের গ্রামীণ সমাজে মেয়েদের মধ্যে গীত গাওয়ার ঐতিহ্য বহু শতাব্দী ধরে বিরাজমান ছিল, বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি। এই তো কয়েক দশক আগেও কী হিন্দু-কী মুসলমান পরিবারে গীত গাওয়ার রমরমা উপস্থিতি ছিল। গীত ছাড়া বিয়ে কল্পনা করা যেত না। উচ্চবিত্ত, গেরস্ত বা গরিব বিয়েতে ১০-১৫ দিন আগে থেকে মেয়েরা থুবড়ার চাল তৈরি করতে দলগতভাবে ঢেঁকিতে পা চালানোর সঙ্গে একটানা গীতও চলতে থাকত। এ ছাড়া প্রতি বিকাল বা সন্ধ্যায় বসত গীত গাওয়ার আসর, এমনকি গীত গাওয়ার প্রতিযোগিতাও চলত। জেলাজুড়ে যেখানে প্রতিকূল অবস্থা সেখানে মমতাজ বেগমের ছত্রছায়ায় গীতের পুনর্জন্ম! এর থেকে বিস্ময়কর কী হতে পারে? না, বিস্ময়ের আরও বাকি রয়েছে। উঠানের এক কোণে একচালা ঘরে গীতের সঙ্গে ঢেঁকিতে ধান ভাঙা এবং অন্য কোণে কুলায় চাল ঝেড়ে জাঁতা ঘুরিয়ে আটা তৈরি করা হচ্ছে। সেই আটা দিয়েই পিঠা তৈরি। এ যে এক প্রাণবন্ত জাদুঘর। কিন্তু আমরা জানি বর্তমানে ঢেঁকি স্বর্গে চলে গেছে!

পিঠার গীত

আরশের নানি নিমনমুখী

কিছু নাহি জানেরে, কিছু নাহি জানে রে

পাঞ্জর ভিজিল ঘামে ॥

বড় বড় পিঠাগালা

কোনা তে লুকাইল রে

পাঞ্জর ভিজিল ঘামে ॥

আরশের দাদি বিষনীমুখী

কিছু নাহি জানে রে

পাঞ্জর ভিজিল ঘামে ॥

বড় বড় আন্দেশাগালা

কোনাতে লুকইল রে

পাঞ্জর ভিজিল ঘামে ॥

ছোট ছোট আন্দেশাগালা

দশকে বিলাইল রে

পাঞ্জর ভিজিল ঘামে ॥

সেই সকাল থেকে বিরামহীনভাবে পিঠা বানানো অধ্যায় এক সময় শেষ হলো। কিন্তু চলতে থাকা ঢেঁকি-জাঁতা ও গীতের আওয়াজ তন্ময় হয়ে শুনছি, কেননা ষাট বছরের পুরোনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। এ নস্টালজিয়ার ঘোরে হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে, এক কিশোরী আহ্বান জানাচ্ছে-পিঠা খান। বড় রেকাবিতে নানা ধরনের পিঠার সমারহ, কোনটা খাব আর কোনটা খাব না, কেননা রেকাবিতে থরে বিথরে সাজানো প্রায় অর্ধেক পিঠা কয়েকযুগ থেকে খাওয়া হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমান প্রজন্মের বধূদের পিঠা বানানো এবং মা-বোনেরাও সেসব পিঠা বানানোর কলাকৌশল বোধকরি ভুলে গেছে। ফলে পুরোনো সেকালের পিঠা বেশি খাওয়া হলো এবং পিঠার স্বাদ ষাট বছর আগের মতোই মনে হলো। আমার মতো প্রায় চল্লিশজন বাইরের অতিথি সেসব পিঠার অমৃত স্বাদ গ্রহণ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। দুপুরে খাবার ব্যবস্থা করতেও কমতি ছিল না, যদিও খুব সাধারণ খাওয়া-দাওয়া।

এক ফাঁকে মমতাজ বেগমের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় জানা গেল, বারো বছর আগে স্বল্পসংখ্যক গৃহবধূদের সঙ্গে করে নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। সে সময় ধান মাড়াইয়ের মাঠ থেকে মেয়েরা ২-৩ কেজি করে ধান সংগ্রহ করে আয়োজন করা হতো, তবে বেশি দিন এ অবস্থা টিকেনি। পরবর্তী সময় থেকে আয়োজনের সব খরচপত্র আজ অবধি মমতাজ একাই বহন করে চলেছেন। এসব কাজের ইন্ধন মা নুরজাহান বেগমের কাছ থেকে পেয়েছেন এবং এখনো তিনি উৎসাহ ও প্রেরণাদাত্রী। গ্রামের মেয়েদের অবহিত, একত্রিত করা ও বিভিন্ন খোঁজখবর আনা-নেওয়ার কাজটি গৌরবের সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র নীরব করিম (বোনের ছেলে) পালন করে থাকে, একই সঙ্গে সে নাচ গান আবৃত্তিতে সিদ্ধহস্ত। শুধু নবান্ন উৎসব নয়, প্রতি মাসে একদিন ৩০-৪০ জন মহিলা মিলিত হয়ে পোষালুর (চড়ুইভাতি) আয়োজন। পোষালুর জন্য প্রায় সব মেয়ে ২৫০-৩০০ গ্রাম চাল, একটা করে ডিম ও দু-একটা করে আলু সঙ্গে আনে। এ দিয়েই হাসি-আনন্দ ভাগ করে খাওয়া-দাওয়া, গল্প গুজব করা, মনের ভাব ব্যক্ত করা, কথিকা পাঠ ও অভিনয়, গান গাওয়া, কিছু খেলাধুলাও অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরাও জড়িত। বিকালবেলা গ্রাম্য বধূ/মেয়েদের গান, তাদের সুখ-দুঃখের কথা এবং ছোট ছেলেমেয়েরা নবান্নের গানের সঙ্গে নাচ পরিবেশন করে। মমতাজ বেগমের কৃতিত্ব ধর্মান্ধ সমাজের বাধা উপেক্ষা করে গ্রামের মেয়েদের কুসংস্কাচ্ছন্ন ও অন্ধ গোঁড়ামির অবগুণ্ঠন থেকে বের করে আলোর সন্ধান করে দিয়েছেন।

সম্প্রতি দেশের ঐতিহ্যবাহী রিকশা ও রিকশাচিত্র এবং বাহারি ইফতারসামগ্রী চলতি মাসেই (ডিসেম্বর ‘২৩) UNESCO-i Cultural Heritage হিসাবে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এসব প্রাপ্তির মূলে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং শতশত বছর ধরে বহমান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। নবান্ন উৎসব প্রতিটি বাঙালির জীবন ও সমাজব্যবস্থায় রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ফলে নবান্ন উৎসবের জন্য ইউনেস্কো স্বীকৃতির প্রচেষ্টা চালানো জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন হতে পারে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যচিত্র নির্মাণ করে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ, যেভাবে রিকশাচিত্র ও ইফতারির ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ কাজে জমিন প্রস্তুত রয়েছে বাবুরঘোন গ্রাম এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ। ঢাকাস্থ জাতীয় নবান্ন উৎযাপন কমিটি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসা উচিত। বাবুরঘোন গ্রামের গৃহবধূরা সম্মীলিতভাবে হাজার হাজার বছরের শস্যভিত্তিক লোক-উৎসবকে মহিমান্বিত করে চলেছে। এ আয়োজন হাজার হাজার গ্রাম বাংলারই মুখচ্ছবি। আর হ্যাঁ, আগামী নবান্নে মমতাজ বেগম বাবুরঘোন গ্রামে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

লেখক : গবেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম